মানুষ ও প্রকৃতি একইভাবে বাঁচে মরে

কতো ভুল বোধ নিয়ে আমরা যে বেঁচে থাকি। আমার ধারণা
ছিলো মানুষেরই বাড়ে বয়স, মৃত্যু হয়, প্রকৃতি চিরকাল
সজীব সবুজ। কী ক’রে এমন বোধ জন্মেছিলো
আমার ভেতরে জানি না তা; তবে বুঝি এ-বোধ আমার
একান্ত নিজস্ব নয়, আমাদের জ্ঞানী পূর্বপুরুষেরাই
দিয়েছিলেন এ-জ্ঞান। তিরিশ বছর পর রাড়িখলে পা রেখেই
কেঁপে উঠি, চেয়ে দেখি আমার বেড়েছে বয়স,
চারপাশে গাছপালা সবুজ উজ্জ্বল। তাহলে আমারই শুধু চামড়ায়
ভাঁজ, আমার মুখমণ্ডলেই শুধু সময়ের কামড়ের দাগ?
দিন দিন প্রকৃতি হয়েছে সবুজ? আমি সামনে হাঁটি,
একটু পরেই চোখে পড়ে যেই হিজলের নিচে
কেটেছে আমার ভীষণ বৈশাখ, যার ছায়া ছিলো দিঘির মতোই
ঠাণ্ডা, ফুল ছিলো স্বপ্নের থেকেও লাল, সেটি ভেঙে
প’ড়ে আছে; আরো এগোতেই চোখে পড়ে জরাজীর্ণ
হয়ে আছে আমার বাল্যকালের বিশাল তেঁতুলগাছ,
আর বহুপ্রসারিত বট। তাদের চারপাশে এখন তরুণ
মেহগনি সেগুনের শিহরণ। বিকেলে বেরোই আমি, বাড়ি বাড়ি
যেতে থাকি, পরিচিত মুখগুলো দেখতে পাই না; অনেকেই
মরে গেছে, অনেকেই অন্ধ আর অত্যন্ত জীর্ণ।
কিন্তু ঘরের পর ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে তরুণতরুণী
শিশু, যাদের চিনি না আমি, যারা শুধু শুনেছে আমার
নাম, আমাকে চেনে না। এই গ্রাম আজ
নতুন মানুষ আর প্রকৃতির, যা ছিলো আমার আর ওই হিজলের;
আমি বুঝতে পারি একই সুতোয় গাঁথা মানুষ ও প্রকৃতি একইভাবে
বাঁচে মরে, পুরোনো গাছের পর দেখা দেয় নতুন গাছেরা।