আমরা

যেই ঘুম ভাঙে না ক’ কোনও দিন ঘুমাতে ঘুমাতে
সব-চেয়ে সুখ আর সব-চেয়ে শান্তি আছে তা’তে!
আমরা সে-সব জানি; তবুও দু’-চোখ মেলে জেগে
আমরা চলিতে আছি আমাদের আকাঙ্ক্ষার পিছে-
নক্ষত্রগ্রহের পিছে নক্ষত্রের ছায়ার মতন
ভাসিয়া চলিতে আছে ঢেউ তুলে আমাদের মন
নদীর জলের মতো- সিন্ধুর স্রোতের মতো বেগে
পৃথিবীর আকাঙ্ক্ষার পার খুঁজে ছুটিয়া চলিছে।

কিংবা তারে খুঁজে কেউ পেয়েছে কি পৃথিবীর পারে!-
মৃত্যুর শান্তির চেয়ে হৃদয়ের যেই আকাঙ্ক্ষারে
আমরা বেসেছি ভালো; খুঁজে তারে পেয়েছে কি কেউ
পৃথিবীর দিন আর পৃথিবীর রাত্রির আড়ালে!
সকল সাম্রাজ্য ছেড়ে- সকল নিশান ছেড়ে ছেড়ে
হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষারে- আমাদের এই হৃদয়েরে
আমরা বেসেছি ভালো!- থামে যদি সমুদ্রের ঢেউ,
আমরা যাব না থেমে,- যাব না ক’ ডুবে কোনও কালে!

এই পার- ওই পার- কোনও এক পারাপার থেকে
রাত্রিরে ডাকিছে দিন,- দিনেরে যেতেছে রাত্রি ডেকে!
আমরা ডেকেছি তারে আলো-আঁধারের মতো হ’য়ে
আঁধার আলোর খোঁজে; আমরাও তাহার পিছনে
ছুটিতে চেয়েছি সব; আমরাও খুঁজিতেছি তারে
পৃথিবীর পারে গিয়ে, আর ওই নক্ষত্রের পারে
ডাকিতে চেয়েছি তারে; পুবের হাওয়ার মতো ব’য়ে
মিশিতে চেয়েছি গিয়ে পশ্চিমের বাতাসের সনে।

পশ্চিম সিন্ধুর মতো অন্ধকারের ফুলে দুলে উঠে
আমরা চলিতে চাই পুবের সিন্ধুর দিকে ছুটে!
মনের আশার মতো হৃদয়ের নিরাশারে খুঁজে,
আশার আকাশ খুঁজে অন্তরের নিরাশার মতো
আমরা ছুটিতে চাই পৃথিবীর পথ ছেড়ে দিয়ে;
পিপাসা পিছনে ফেলে তোমারে পিছনে ফেলে প্রিয়ে!
যদিও সকল ভুলে কার্তিকের মাঠে চোখ বুজে
ঘুমায়ে অনেক শান্তি, ছুটিতেছি তবু ইতস্ততঃ!

যদিও অনেক ক্লান্ত হ’য়ে গেছি পথে হেঁটে হেঁটে
বারবার জেগে জেগে অনেক সময় গেছে কেটে-
ঘুম ভালো সব-চেয়ে, মৃত্যুর মতন ঘুম ভালো
যদিও সকল শক্তি সার সব ঐশ্বর্যের চেয়ে-
তবুও ঘুমের আগে আকাঙ্ক্ষার অধীরতা এসে
আমাদের সকলেরে চুমো দিয়ে গেছে ভালোবেসে!
আকাশে সূর্যের আলো আর ওই নক্ষত্রের আলো
জ্বলিতেছে আমাদের আকাঙ্ক্ষার কাছে ছন্দ পেয়ে!

কারণ শান্তির চেয়ে অস্থিরতা- বেদনা- বিস্ময়
আকাঙ্ক্ষার পিছে যেই ব্যথা-অধীরতা জেগে রয়-
মৃত্যুর শান্তির চেয়ে আমরা বেসেছি ভালো তারে!
যদিও গিয়েছি চিরে পৃথিবীর বুকের মতন
হৃদয় রয়েছে ভ’রে অন্ধকার গহ্বরে কবরে,
তবুও রয়েছি জেগে রাত্রি-দিন জাগিবার পরে!
রাত মুছে যায় দিনে, দিন ডোবে রাতের আঁধারে;
তাদের মতন হ’য়ে ভাসিয়া চলিতে আছে মন!

কোথায় সে জেগে আছে?- ঘুমায়েছে?- জেগে আছে সে কি!
তোমরা দেখেছ তারে? আমরা চকিতে যারে দেখি।
যাহার ঐশ্বর্য এই পৃথিবীর রাজ্যের মতন
নয়, তবু যে খেলেছে মানুষের ইচ্ছা ক্ষুধা ল’য়ে!
যার শক্তি বেশি ওই নক্ষত্রের প্রভাবের চেয়ে!-
পৃথিবীর মেয়ে সে কি? নক্ষত্রের?- তবে কার মেয়ে!
দেখেছি কোথায় তারে! তারে আমি দেখেছি কখন!
আমরা ঢেউয়ের মতো তাহার পিছনে চলি ব’য়ে!

তারে খুঁজে ব্যথা শুধু, তারে খুঁজে শুধু বিহ্বলতা!
আবার ফিরিয়া এসে হে প্রিয়া তুমিও ক’বে কথা-
কিন্তু সে কি কোনও দিন তাকায়েছে আমাদের দিকে?
পিছনে ফিরেছে সে কি?- আমরা ছুটেছি তার পিছে!
আমরা ডেকেছি তারে- শুধু ব্যথা- ব্যথা তারে ডেকে!
তবুও পাখির মতো কাঁটার উপরে বুক রেখে
আমরা ডেকেছি তারে- আমাদের কাছে গান শিখে
দিনের রাতের ঢেউ জেগে উঠে তাহারে ডাকিছে!

কোথায় গিয়েছে প্রিয়া?- কখন পিছনে প’ড়ে গেলে!
আমরা কাহারে খুঁজে তোমারে ভুলেছি অবহেলে!
পৃথিবীর মাঠে পথে মানুষের মতো কাজ ক’রে
যে-আরাম, বীজ বুনে- মানুষের মতো শস্য তুলে
যেই সুখ, ক্লান্ত মানুষের মতো আঁধারে ঘুমায়ে
যেই শান্তি, পাতার মতন ফ’লে যেই স্বাদ গায়ে-
হিমের হাওয়ার বুকে সহজে পাতার মতো ঝ’রে
যেই স্বচ্ছলতা- সব- আমরা সকলে গেছি ভুলে।

তবু এই পথ ছেড়ে লাঙ্গল-কাস্তে হাতে নিয়ে
আমরা যাব না হেঁটে পৃথিবীর শস্যক্ষেত দিয়ে।
যদিও নদীর জলে, যত দিন কেটে যায়, দেখি-
আরও বেশি- আমাদের মুখ আরও বেশি ম্লান হয়!
যদিও অনেক ঘুম- আরও ঘুম নেমে আসে চোখে-
রাত্রি আঁধারে এই- আর এই তারার আলোকে
নিভিয়া গিয়াছে বাতি পৃথিবীতে- তবু নিভেছে কি
যে-মশাল অন্ধকারে আমাদের হাতে জেগে রয়!

সে-মশাল অন্ধকারে আমাদের হাতে জেগে রয়!-
যদিও পেয়েছে ঘুম, ঘুমের মতন কিছু নয়-
যদিও সকল সাধ অনুভূতি আস্বাদের চেয়ে
সব পিছে ফেলে রেখে- সবাই ঘুমেরে ভালোবাসে-
কারণ, সবাই শান্তি- মৃত্যুর ঘুমে শান্তি চায়-
পথ হেঁটে হেঁটে তবু চলিতেছি- যা চলিয়া যায়
তারই পিছে পিছে গিয়ে- ব্যথা পেয়ে- শুধু ব্যথা পেয়ে
জেগে আছি- যদিও আবার ঘুম- চোখে ঘুম আসে!

জ্বলিতেছে যে-মশাল অন্ধকারে আমাদের হাতে!
সমুদ্র দাঁড়াতে পারে- পারি না ক’ আমরা দাঁড়াতে!
পৃথিবী ঘুমাতে পারে- আমাদের চোখে ঘুম নাই!
নক্ষত্র নিভিতে পারে- আমরা যেতেছি তবু জ্ব’লে!
আমরা বাতাস হ’য়ে চলিতেছি দিকে দিকে ব’য়ে!
সময়ের সাথে সাথে আমরা সময় হ’য়ে হ’য়ে
যত দিন জেগে আছি এমনই জাগিতে শুধু চাই!
আমরা চলিতে চাই আকাশ বাতাস পায়ে দ’লে!