ঢের গভীর রাত

ঢের গভীর রাত- কত রাত তা জানি না
আমার ঘুম ভেঙে গেল-
আরও দূরের ফাঁকা-ফাঁকা বাবলার নির্জন বিমর্ষ গলির ভিতর দিয়ে
একটা জোনাকি উড়ে আসছে-

ধীরে-ধীরে সে বাতাসের ভিতর দিয়ে ভেসে এল;
অন্ধকার জলের আরশি বেয়ে রাজহংসীর নিস্তব্ধ প্রতিবিম্বের মতো
ভেসে এল ধীরে-ধীরে;
সমস্ত শান্ত পৃথিবীকে সে যেন নিয়ে যাচ্ছে আরও গভীরতর সুষুপ্তির মগ্নতায়;
আমার সঙ্গে নীরবতম অন্ধকারে একা কথা বলবে ব’লে-
বাতাসের ভিতর দিয়ে আস্তে-আস্তে ভেসে আসছে
মৃত সন্তানের স্নেহের মতো, মৃত জননীর নির্জন আবেগের মতো
জীবনের যা-কিছু ধূলিসাৎ ক’রে, যা-কিছু হারিয়ে গিয়েছে
ভেসে আসছে
ভেসে আসছে…

অতীত জীবনের শীতের রাত্রির গন্ধ;
মৃত পৃথিবীর শিশিরের গন্ধ;
কত পিতা-পিতামহের রচিত বালক-পৃথিবীর ধূসর বিমর্ষ বিলুপ্ত ঘ্রাণ;
কত মৃত কাক ও শালিখের ধ্বনি
এই জোনাকির নিঃশব্দ ওড়ার ভিতর।

ধীরে-ধীরে ভেসে আসছে
জানালার ভিতর দিয়ে চুপে-চুপে
আমার শিয়রের কাছে- মশারির পাশে
পাখা নিস্তব্ধ হল তার!

রাতের বাতাসে ধীরে-ধীরে মশারি দুলছে
পৃথিবী ভেসে চলেছে শূন্যের ভিতর দিয়ে সময়ের সুতো বুনতে-বুনতে;
কেমন নির্জন ঠিকানাহীন সেই ধ্বনি
ভবিষ্যৎকে অতীতের কোঠায় তুলে দেয়- অতীতকে বর্তমানের হাতে!
মশারির গায়ে জোনাকিকে সময় ও সীমার মায়াবী ব’লে মনে হয়;
জীবনকে গভীরতর- গভীরতর ব’লে বোধ হয়!
নিঃসঙ্গ ধূসর রহস্য-সৌধের মরচে-পড়া আঁকা-বাঁকা দীর্ঘ সিঁড়ির পথে
তোমার মুখ দেখতে পাই আমি-

বিস্মিত আড়ষ্ট হয়ে যাই:
‘তুমি যে কোনও দিন এই পৃথিবীতে বর্তমান ছিলে তা-ও তো জানি না-!’

‘নানা দেশের নানা কালের বিচিত্র কারু-কার্যের নিভৃত রেখার মতো আমাকে দেখেছ অনেক বার;
হৃদয় দিয়ে আমাকে অনুভব ক’রে অনেক বিলুপ্ত নগরীর বেদনাময় আঘ্রাণের মতো তুমি!

আমি শেফালিকা গাঙ্গুলি:
তেরো-শো চব্বিশ সালে তোমাদের পৃথিবী শেষ বার ছেড়ে এসেছি;
চলেছি তোমারই স্মৃতি ও বেদনা সাহস আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নের আঁকা-বাঁকা সুদীর্ঘ সিঁড়ি বেয়ে!
জীবন ও মৃত্যু- সময় ও সীমানার কক্ষ থেকে দূর বিস্ময়ের কক্ষে!
পৃথিবীর ধূলো ও রক্তের হাত ছেড়ে দিয়ে যত বার তুমি স্বপ্নের হাতে ধরা দাও-
সিঁড়ি তোমার আরও দূর আশ্চর্য পর্দায় ঘেরা কক্ষের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়!
আমার সমস্ত হৃদয় অনাদি অতীতের স্ফটিক-মণির ভিতর দিয়ে অপরিসীম ভবিষ্যৎকে খুঁজে পায়;
(নদীর জলে ভোরের রাজহংসীর মতো স্নিগ্ধ হয়ে ওঠে।)’