হে মনীষীর ভিড়

হে মনীষীর ভিড়,
আমার হৃদয়কে আর এক বার আঘাত ক’রে গেলে তোমরা
আমার হৃদয় ঘুমের থেকে জেগে উঠতে-উঠতে যে-ব্যথা বোধ করছিল
সেই বেদনাকে কেমন একটা ধাতুকঠিনতা দিয়ে গেলে তোমরা
যাতে নক্ষত্রকে পাথর ব’লে মনে হয় শুধু
মানুষের জীবনের নিবিড়তম সম্পাতের ভিতরেও গন্ধকের আস্বাদ পাই
শূন্য হয়ে মিলিয়ে যায় সব
মানুষের জীবনকে দু’-চার দিনের জিনিস ব’লে বোঝা যায়
ব্যক্তি নিজেকে মাছির মতো ব’লে জানতে পারে
মক্ষিকার ভিড়ে পৃথিবীর রৌদ্রের ভিতর সে এসেছে
এখুনি জাফরান আলোর বিকেলবেলা আসবে: হিম হয়ে যাবে সব
এই হৃৎস্পন্দনের বেদনা প্রভাতের নীলিমার থেকেও চোখ
বইয়ের পাতার দিকে ফিরিয়ে নিচ্ছে-
কারণ, জ্ঞানই সত্য, সত্যই বিবেক, বিবেকই শান্তি
যদি জীবনের কথা বলত, আহা, কিন্তু বিবেক আজ মৃত্যুর ও কুয়াশার কথা বলে শুধু
যদি অরণ্যেরই মক্ষিকারই মতো হতাম- আজ এই প্রভাতে-
জীবন যার কাছে রৌদ্রের সমুদ্র
যে কোনও মৃত নক্ষত্রের কথা জানে না-
পৃথিবী গোলাকার কী ত্রিকোণ কিছুই জানে না
দু’এ আর দু’এ যে চার হয়- কিছুই জানে না
আজ এই ভোরের রৌদ্রে
চীনের কোনও চেরিফুলের বাগানে
মক্ষিকা নেই কি?
পাশেই তার- হয়তো দুই ধনু দূরে- কোনও এক গড়খাইয়ে
জাপানি সৈনিক নেই কি?
আজ এই আলোর আস্বাদে কোনও এক জাপানি সৈনিক-
কোথাও দাঁড়িয়ে রয়েছে নিশ্চয়
জাপানি ব’লেই সে অমর নয়- বুদ্ধ, লাওৎসে, কনফুসিয়াস
কেউ-ই শেষ বিশ্বাস দিতে পারেন না মানুষকে
এই নিরস্ত্র যুদ্ধহীন দেশের মাটিতে ব’সে থেকেও আমি
কোনও সুরক্ষার স্বাদ পাই না
এখানে কোনও কামানের গর্জন নেই- কিছুই নেই-
আমি স্থূল যুদ্ধের কথা ভাবছি না
কিন্তু জীবনের ভিতর থেকে কী যেন এক চুম্বক নষ্ট হয়ে গেছে!
সকল মানুষের জীবনের ভিতর থেকে যেন
এই ভোরের রৌদ্রে লাউমাচার পাশে- সবুজ ঘাসে-
গাঁদাফুলের সমস্ত বাগানে ঘুরতে-ঘুরতে
নিজেকে যেন চিনে-সৈনিক ব’লে মনে হয়
অথবা জাপানি সৈনিক
অথবা মাদ্রিদের কোনও জীব ব’লে
লাল রৌদ্রে- গাঁদাফুলের বাগানে- দু’-চারটে মক্ষিকা আলাদা জিনিস
পৃথিবী গোল কী চতুষ্কোণ- মানুষের মাথা ডাক্তারের না পরমাত্মার-
কিছুই জানে না তারা
মরণোন্মুখ চিনে-সৈনিকের মতো মনে হয় নিজেকে
যদিও এখানে কোনও কামানের গর্জন নেই
হে মনীষীর ভিড়,
তোমরা ধারণা করতে পেরেছ আমরা মানুষের মতন মস্তিষ্ক নিয়ে-
মক্ষিকার মতো এই পৃথিবীতে আসি
তার পর মক্ষিকার মতো ফুরিয়ে যাই
ঘাস- রৌদ্র- গাঁদাফুলের সোনালি অজস্রতা কিছু নয়
কঠিন হৃৎস্পন্দনে বৈজ্ঞানিকের সাদা চুল ও নিরপেক্ষ সত্য মুখের দিকে
তাকিয়ে বলছি:
নবতর জ্ঞান আনো- যদিও তা নবতর অবসাদে অন্ধকার হয়ে থাকবে।
নবতম জ্ঞান নবতম অবসাদে অন্ধকার হয়ে থাকবে।
তবুও জ্ঞানই সত্য, সত্যই বিবেক, বিবেকই শান্তি,
হে মরণোন্মুখ মানুষ-সৈনিক,-

তোমার বয়স কত? পঁয়ত্রিশ? শরীরের মাংসে কোথাও ক্যানসার জন্মেছে-
তুমি লুকুচ্ছ-
কিন্তু দু’ বছর পরে তোমার মৃত মুখ কিছু লুকোতে দেবে না আর
চার-দিককার অশ্লীল বিরস ঠাট্টার ভিতর তোমার নাভি পুড়বে- পুড়বে-
পুড়বে- পুড়বে-
কয়েক জন কর্তব্যপরায়ণ শ্মশানবন্ধুর লগির খোঁচায় পাক খেয়ে-খেয়ে
কালো বাদুড়ের মতো হিঁচড়াবে
কিন্তু জীবন তার হাতে আর নয়
কোনও দিনের জন্য নয় আর
কোনও আন্তর্নাক্ষত্রিক শূন্যের কুয়াশার ভিতর সেই বাদুড়কে
খুঁজে পাওয়া যাবে না কোনও দিন
যুদ্ধের চেয়েও গভীরতর সে- আজকের ভোরের আলোর ভিতর
শত-শত মৃত প্যাগোডার গাম্ভীর্যে সরস হয়ে রয়েছে
তার পর কোনও ক্যামেরায় কোনও দিন তোমার স্পিরিট-ফোটোগ্রাফ
উঠবে না আর
পৃথিবীর কোনও প্রণয়িনীর নিকটে গিয়ে
তোমার আত্মা কোনও দিন দাঁড়াবে না আর
সেই সব প্যাগোডা চিরদিনের জন্য শব্দহীন
সীমানাহীন সময়ের প্রাণ- তারা নেই ব’লেই সীমানাহীন
চির-মৃত্যুর ভিতর ফুরিয়ে গিয়ে সৃষ্টির বিবেককে
লঘুতা দিয়ে গেছে তারা
তোমার স্ত্রী যক্ষ্মায় মারা গেছে- তোমার শিশুটি ডিপথেরিয়ায়
তোমার মা রক্তের চাপে মারা গেছেন- তোমার বাবা সন্ন্যাসে

আজ এই অজস্র সোনালি গাঁদাফুলের রাজ্যে ভোরের রৌদ্রে
এক ভিড় মক্ষিকা হয়ে জন্মাতাম যদি আমরা সকলে
বুদ্ধ- লাওৎসে- জিন’স- প্রাণতত্ত্বের অধ্যাপক:
সকলকে আমাদের অজ্ঞান অবিনশ্বর আনন্দে পরাজিত ক’রে!
কিন্তু তবুও জ্ঞানই সত্য, সত্যই বিবেক, বিবেক: অবসাদ
নবতর জ্ঞানের নবতর অবসাদ- নবতম অবসাদ
নিরপেক্ষ সত্য মুখের মমতাহীন সাদা অবসাদ
কোথাও মমতা নেই
সব-চেয়ে বড় জ্ঞানীর হৃদয়ে সব-চেয়ে বড় প্রতিভা রয়েছে
কিন্তু মমতা নেই-
কোথাও কিছু নেই: নক্ষত্রের বিচরণ ও গণিত ছাড়া
মৃত্যু ও অন্ধকার ছাড়া
দু’এ আর দু’এ চার ছাড়া কোথাও কিছু নেই আর
সব-চেয়ে সারবান মস্তিষ্কে সব-চেয়ে সারবান সত্য রয়েছে;
আমাদের মাথায় গোবর রয়েছে: তাই আমরা প্রেমকে অনন্ত পরিধির ভিতর পেতে চাই
‘অনন্ত পরিধির ভিতর পেতে পার- কিন্তু সে তোমার প্রেম নয়-
তোমার প্রিয়ের প্রেম নয়’, কে যেন বলে
সে ঢের গণিত শিখেছে- এত শিখেছে যে, আমার প্রেমিক মনকে সে
গণিতানুরাগী করেছে
বুঝেছে গণিতই সব- প্রেম কিছু নয়-
আমরা মৃত্যুর দিকে চ’লে যাচ্ছি
পৃথিবীর কোনও মানুষ আমাদের মাংসের মুখ দেখবে না কোনও দিন আর
আমাদের ছায়ার মুখ দেখতে পাবে না
আমাদের সেই কবেকার মৃত মা’র ও জায়ার মাংসের মুখ
দেখবে না কোনও দিন আর
আমাদের ছায়ার মুখ দেখতে পাবে না
এই গহন সবুজ লাউলতার পাশে
সবুজ ঘাসের গন্ধের ভিতর
কাতারে-কাতারে সোনালি গান্ধাফুলের এই নিরুদ্দেশ বাগানে
মাইলের-পর-মাইল নীলিমার কোলে
চিনেহাঁসের মতো সাদা মেঘের অনন্ত বিস্তৃতির নিচে
গভীরতম গণিতের স্বাদ নিয়ে চিরকালের জন্য
চোখ বুজে থাকবার নির্দেশ রয়েছে।
ঐ সর্ষে-খেতের কিনারে দীর্ঘ রূপসি শিখ মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে
বেরেলি থেকে ওরা এসেছে এই বাংলাদেশে উপনিবেশের জন্য,
দাঁড়িয়ে রয়েছে আদিম সোনালি সর্ষেজননীর মতো যেন এই ভোরের রৌদ্রে
আমার হৃদয় একটা চমৎকারিত্বের আস্বাদ পায়
ধীরে-ধীরে বিশ্বাস জেগে ওঠে
বুদ্ধের নির্বাণ- জিন’স এবং গণিত- প্রাণতত্ত্বের অধ্যাপকের
প্রণিধান সব নয় যেন
কোথাও অন্যতর কিছু রয়েছে
আবার নতুন ভোরের আলোয় মাটির ভিতর থেকেই যেন
ঋজু শস্যের মতো জেগে উঠে
আবার নতুন অন্ধকারে দীর্ঘ মোমশিখার মতো দাঁড়িয়ে থেকে
এক-এক জন মানুষ এসে যেন জানিয়ে দিয়ে যায়
কোথাও অন্যতর কিছু রয়ে গেছে
নীল আকাশের অই পারে প্রগাঢ় নীলিমার অভ্যুদয়ের ভিতর।