জোড়া-হালদার ব’লে তাদের চিনেছি

জোড়া-হালদার ব’লে তাদের চিনেছি আমি- তাহাদের নাম
প্রায়শই ভুলে যাই- আমার এ-মূর্খ হৃদয়ের
নানা-রূপ মূর্খতর কাজের ভিতরে
ব্যস্ত থেকে- নগরীর পথে হেঁটে- অথবা মিটিংয়ে
দণ্ডিতের মতন ক’রে হাঁটু ভেঙে ব’সে থেকে বহু ক্ষণ
দায়িত্ব আধেক সমাপ্ত রেখে মাঝে-মাঝে হেমন্তের রাতে
তাহাদের কথা তবু মনে হয় দেয়ালের বিদ্যুৎ নিভায়ে
যখন চেয়ারে একা ব’সে আছি- তবুও দেয়াল
পাশের গলির থেকে গ্যাসের আলোক খুঁজে এনে
কিমাকার ছায়াকেও নিয়ে আসে- চেয়ে দেখি আকাশের পথে
আমাদের সেই সব প্রান্তরের মতন তারকা
নেই কিছু- দু’-একটা বেলুন, ফানুস প্যাঙগোলিন
ক্বচিৎ নক্ষত্র এসে দেখা দেয়- সর্বদাই মানুষের প্রয়োজন আমি
অনুভব ক’রে যাই- বিশেষত এই সব রাতে
(স্মরণীয়) হেমন্তের- যখন পৃথিবী কিছু কাজ বুঝে স্তব্ধতর হয়ে
নদী- মাঠ- খেত- আলু- মাথায়-গুনতিহীন মাথা
স্থির হয়ে গুণে যায়- দূরতর কুয়াশায় শুয়ে
সে-সব প্রান্তরে আজ- জানি আমি- কোনও এক কোণে
জোড়া-হালদারদের দু’টো সমাধি রয়েছে
পরস্পরের থেকে হয়তো-বা এক রশি দূরে- দু’টো ইট
(পৃথিবীর) সকল সমুচ্চ বস্তুর চেয়ে এত বেশি নিচে
এত দূরে- এত তবু সমধিক দুরতর হয়ে যায় রোজ
যতই অয়নরেখা অন্ধকারে ঘুরে
নগরীর বড়ো রাতে সর্বদাই আমাদের সবাকে দেখায়
ছুটেছে সে- ছুটায়েছে- সততই পিছনের মানুষগুলোকে
আরও পিছে ফেলে রেখে- হৃদয়ের অপেক্ষাকে কারু
বিলুপ্ত রীতির মতো ভয়াবহ ভাবে একা ফেলে।
বুকের উপরে তবে দুই হাত তুলে দিয়ে ধীরে
আমি তবু এক জন পিছনের মন্থর মানুষ
যাতে পথে বার হলে অনেকেই ভাবে:
এর কোনও কানাকড়ি নেই ব’লে ততোধিক অন্তরঙ্গতার
প্রয়োজন নেই কিছু- আমিও তাদের প্রিয় আন্তরিক হৃদয়ের ‘পরে
হাত রেখে কথা ভাবি- ঘণ্টা-টাক নীরবে দাঁড়ায়ে
অথবা গলির পথে- হৃদয়ের অন্ধকার শিশুদের পিছে
ধাত্রীকে প্রস্তুত হয়ে যেতে দেখে- ম্লান আড়কাঠি
নিজেকেও নিয়ন্ত্রিত ক’রে নিতে প্রয়োজন অনুভব করে
মৃত জননীর মতো- সেই মৃত জননীর আত্মার মতন।
অথবা ট্রামের স্নিগ্ধ স্ট্রিমলাইনটাকে
সমান্তরাল ভাবে রেখে দিয়ে গ্যাসের বাতির সাথে সর্বদাই
যা কিছু সম্মুখে পড়ে তাহাদের কালো- সাদা- বাদামি- হলুদ
বিবিধ রঙের থেকে নিয়তই উদ্গীরিত হয়ে
একটি নির্মল বর্ণ আপনার প্রতিভায় সর্বদাই তবু
বেঁচে থেকে পথ কেটে নিতে চায়- মনে হয়- সকলেই তারা
স্পর্শাতুর- আমার হাতের তবু আজ কোনও স্পর্শশক্তি নেই।

রজনিকে (হালদার) মনে পড়ে- কোদালের ‘পরে ভর দিয়ে
হেমন্তের বার-বেলা সেই সব দূরতর মাঠে
দাঁড়ায়ে রয়েছে একা- পৃথিবীর সব-চেয়ে মন্থর কাজের
খোঁড়লে অধিকতর মন্থরতা খুঁজে নিয়ে সূর্যের কিরণে
লক্ষ মুগ্ধ জীবাণুর শশব্যস্ততার মাঝে প’ড়ে
কোদালের দেবতার মতো জীব দাঁড়ায়ে রয়েছে
দক্ষিণ কানের থেকে বাম কান অবধি দু’ ঠোঁট
ফাঁক হয়ে প’ড়ে আছে- ডাভেন্ট্রি’র রেডিও’র থেকে
সুগভীর বায়ু যেন ভেসে এল- সেই অপরূপ
ধূসর বাতাস তারা- অবশেষে খেত সারা-দিন
সে ও তার যমজের মতো বৌ- পৃথিবীতে আর কোনও খুদ
নেই ব’লে। সেই সব কৃষকের খেতে কোনও মেশিন ছিল না
আজও নেই- তবুও ওয়াইয়ারলেস বিশ্বাসীর হৃদয়ের ‘পরে
কাজ ক’রে চ’লে যায় আপনার নিজের নিয়মে
সে-সব বিশ্বাস তবু আজ এই গোল পৃথিবীতে
নেই আর- কম আছে- যত দিন কেটে যায় ক্রমে
পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে সে-রকম অনুরূপ দূরে
চ’লে গেলে সে-সব বাতাস- মাঠ- দুইখানা ইট
প’ড়ে আছে- তার নিচে তারা দুই জন।
– – – – –
তবুও তাদের ধারা বাংলার প্রান্তরের পথে
এখনও বিলুপ্ত হয়ে যায় নাই- ক্রমশই মুছে গেছে ভেবে
মিছেই সান্ত্বনা দিই হৃদয়কে- যা হতেছে, হয়ে গেছে- সব
সে-সব বিপন্ন কালো অকৃত্রিম ঘটনার স্রোত
আমার কবিতাভাষা বটে, তবু নিজেদের মতো
নিঃসহায়- অথবা যা হবে তারা আরও বহু দিন
সান্ত্বনার অতি বৃদ্ধ প্রপিতামহীর মতো প্রতিশ্রুতি নিয়ে
সময়ের জরায়ুতে বীজ আজ- অন্য কিছু নয়।