যত দূর চোখ যায়

যত দূর চোখ যায় রাঙা রৌদ্র বিছায়েছে তরমুজ-খেতের মতন
দীর্ঘ ঘন ঝাউ-সারি- পল্লবে-পল্লবে ঘুঘু মনিয়া’র ভিড়
ঘাসের উপরে তুমি ব’সে আছ- বাতাস করিছে আহরণ

তোমার চুলের ধান- অবিরাম বাসমতী ফসলের ঢেউ
রৌদ্র ভাবে ফাল্গুনের নীল তরমুজ যেন তোমার শরীর
দুপুরের কোলে শুয়ে পাকিতেছে- আমি কী যে ভাবি, তাহা কেউ

জানে না ক’;- এ-পৃথিবী সারা-দিন রৌদ্র আর হাওয়ার ভিতরে
ডানা মেলে উড়িতেছে,- মনে হয় এক ঝাঁক বিস্মৃত চিলের মতো যেন
নদীর পারের ঐ ধানখেত- কোলাহল করে- নীল আকাশের ঘরে

উড়ে যাবে; আহা, এই ধানগুচ্ছ সারা-দিন গাহিতেছে কাহাদের গান
পৃথিবীর- জীবনের- সৌন্দর্যের- দেখি নি কোকিল আমি কোনও দিন হেন
রৌদ্রের সাগরে নেচে উচ্ছ্বাসের সেজেছে সন্তান

উচ্ছ্বাস প্রেমের তরে ইহাদের,- এই সব জীবনের বীজ; এই সব
প্রেমেরে পেয়েছে আজ; রৌদ্রে প্রেম রোদ, প্রেম বাতাসে বাতাস
ধানখেতে ফসলের প্রাণ প্রেম, ঘাস প্রেম, প্রেম ঘুঘু- ঝাউয়ের পল্লব

তবুও নিস্তব্ধ তুমি বহু ক্ষণ- যেন এই পৃথিবীর প্রবাহিত রক্তের ভিতরে
যেইখানে অসংযম- ফেনিলতা- অপচয় হতেছে প্রকাশ
সেইখানে নিয়ন্ত্রণ আনিতেছ- যেন এই পৃথিবীরে নিয়ে মৃত নক্ষত্রের তরে

ডানা মেলে দেবে তুমি; তুমি রূপ, তুমি মৃত্যু- তবুও জীবন
তুমি নও; দেখ নি সমুদ্র তুমি- দেখ নাই সমুদ্রসারস
আঁধার জলের সিঁড়ি ভেঙে ফেলে দেখ নি রৌদ্রের আরোহণ

সমুদ্রের রুক্ষ দুর্গে- যেখানে বিছানা পেতে সারা-রাত নিশ্চল কুয়াশা
তোমার প্রাণের মতো শুয়েছিল; তোমার খোঁপার মতো এঁটেসেঁটে করিবে কি বশ
প্রেমেরে সজ্জার মাঝে?- তুমি রূপ, তুমি ছবি- তবু তুমি নও ভালোবাসা!

২.
কিংবা প্রাণে আসে নাই আজও বুঝি প্রেমের সময়?
অথবা তোমার প্রেম আমার প্রাণের মতো নয় এত সংঘর্ষরক্তিম?
রৌদ্রের মতন নয়- সমুদ্রের মতো তাহা নয়

নিবিড় ঘুঘুর মতো নয় তাহা- ব্যাকুল ধানের মতো নয়?
প্রেম তবে কী জিনিস?- হাতির-দাঁতের মূর্তি উর্ণনাভ হিম
প্রেমের দেবতা সে কি?- আমারে বরং দাও প্রাণের প্রচুর অপচয়

মেরুর পাহাড় থেকে যেই নারী লক্ষ মাইল সমুদ্রের তরে
ঝাঁপ দেয়- অথবা সমুদ্র নিজে- কিংবা যেই কবি
পৃথিবীর স্বর্ণশস্য ফেলে দিয়ে চ’লে যায় স্বপ্নের ভিতরে

পাণ্ডুলিপি হাতে নিয়ে নিঃসঙ্কোচে পৃথিবীর পথে
হেঁটে চলে- বহু স্বপ্ন ভেঙে ফেলে- ছিঁড়ে ফেলে অগণন ছবি
লাভের জগত ভুলে- তবুও যে বাস করে বেদনার স্বপ্নের জগতে

এই সব অপচয় নিয়ে প্রাণ- স্পন্দন- জীবন-
কোকিল দু’ কথা ব’লে কখনও সমাপ্ত করে গান?
সুশৃঙ্খল নীড়ে ব’সে সারা-দিন কখনও চিলের মন

শান্তি পায়?- আকাশে-আকাশে উড়ে গাহিতেছে জীবনের জয়
রৌদ্রে ধান ঝ’রে যায়- পেকে যায়- কাস্তে হাতে চাষা তার কেটে লয় প্রাণ-
তবু সে আনন্দে গান গায় রৌদ্রে- কেন এ গানের অপচয়?

৩.
সকল পৃথিবী আজ স্বপ্ন দেখে ঝাউবনে- ঘুঘুদের গানে
সারা-দিন হাওয়া রৌদ্রে ফড়িং বাবুই ফিঙ্গা অনন্ত জীবন
বপন করিছে যেন, আহরণ করিতেছে বার-বার- সারা-দিন প্রাণে

সমুদ্রে নিমগ্ন, রুদ্ধ, নিরালম্ব অন্ধকার পাহাড়ের মতো
ব্যথা এক লেগে থাকে- সারা-দিন রৌদ্র আরও নতুন রৌদ্রের আয়োজন
করিতেছে- আকাশ ছড়ায়ে আছে আরও নীল আকাশের দিকে অবিরত

সারা-দিন ধানখেত থেকে গান মাঠে-মাঠে এলোমেলো ছাগলের কানে
ভেসে আসে- ঘুম পায় তাহাদের- ঢুলুঢুলু চোখ মেলে তবুও বিস্ময়
জাদুর মতন শব্দে লেগে থাকে সারা-দিন তাহাদের নিঃস্পন্দিত প্রাণে

সারা-দিন কত রং কত শব্দ পৃথিবীতে অগোচর মায়াবীর হাত
উড়ন্ত পাতার সাথে ভেসে যায়- চিলের ডানার ছায়া করে সঞ্চয়
যাযাবর হাঁসদের পাখা দিয়ে আকাশ ভরিয়া ফেলে কী যে অকস্মাৎ

৪.
আমরা দু’ জনে আজ ব’সে আছি পৃথিবীর ধারে
এমন ছিলাম ব’লে দুই জনে যেন সব অনন্ত অতীত
সৃষ্টির বুকের থেকে যত ভবিষ্যৎ কাল জন্ম নিতে পারে

আমরা দু’ জনে যেন ব’সে র’ব- তুমি শীত-সমাহিত- জলধনু-রঙের বিস্ময়
আমার হৃদয় ঘিরে- তোমার ধবল নগ্ন হাতখানা শীত-বিপরীত
মসৃণ হাড়ের কন্যা- কোনও দিন ঘুম ভেঙে জাগিবার নয়।