শিকার

(সংলাপ কবিতা)

একজন শিকারি
মিছেমিছি কেন ওই শিকারির সাথে
আমরা শিকারে যাই?

আর জন
শিকার জানে না সে কি?

এক জন
ধলা এক ঘোড়া শুধু আছে;

আর জন
দুধের ভিতর থেকে সেই যে মাখন তোলে
গয়লার ধলা মেয়ে ভোরের বেলায়
ফেনার ধোয়ায় তার দুই চোখ ঘোলা হ’য়ে আসে;
তাদের সবার কথা মনে হয় যেন
ঘোড়ার পিঠের দিকে চেয়ে,-
আমরা ঘোড়ার মুখ দেখি নাকো!

এক জন
কেবল সে চ’লে যেতে আছে;

আর জন
কোথায় সে যায়?
আমরা জানি না কেউ!
তবু তার পিছে যেতে হবে?

স্বপ্নের ভিতরে যেন চলিতেছি!
আমাদের লাল ঘোড়া;

আমাদের ঘোড়া এতো লাল,-
তাহাদের লোম যেন কালো হ’য়ে আসে!

ওদের গায়ের রং আমাদের ক্ষুধার মতন;

পৃথিবীর জল থেকে ফিরে
মিছেমিছি অন্য দিকে যায় এরা;
কোন ঘাস কোন জল এদের সান্ত্বনা দেবে?
এরা ম’রে যাবে,- আমরাও;
আমরা র’য়েছি বেঁচে পৃথিবীতে তবু,
সেইখানে আমাদের খুঁজে পাবে- দেখ;
বুড়ো পাখিদের মতো সেইখানে থাকি না আমরা;
গাঁসের ছানার মতো পাখনায় ভিজে
ছোট এক পুকুরের পাড়ে
আমরা সেখানে থাকি;

তারপর বড় হই;
আমরা হইনা তবু বুড়ো;

হাঁসের মতন ডিম পাড়ে সেইখানে
আমাদের হৃদয়ের আশা!

হাঁসের মতন ডিম,
তবুও সোনার ডিম নয়!
খড়ের কুটার মাঝে অনেক ময়লা ডিমে অন্ধকারে ব’সে
ভেবেছি অনেকদিন এই কথা;-
এই ডিমে ব্যথা পাই!

এর চেয়ে বেশি ব্যথা আছে,-

জানি আমি;
কোনোদিন কড়ি ফেলে তেল আমি নেই নাই,-
তবু কোনো কুনো ব্যাঙ কানাকড়ি দেবে?
কানাকড়ি ছাড়া তবু তেল পাবে না কি?
তাই আমি হিজলের গাছে
এবার লয়েছি নাও বেঁধে!

দাও ছাড়া কথা নেই;
সাড়ে সাত চোর যদি মরে বেঁচে ওঠে
আমি সেই আধখানা চোর হব!
মেয়েমানুষের ব্যথা,-
আমার মদের মুখ নাই!
মদের পিপার ‘পরে সারা রাত একা ব’সে থেকে
আমি তবু মাংসের- মাংসের কথা ভেবে-ভেবে
মেয়েমানুষের স্বাদ চাই আমি শুধু;
এর চেয়ে কম কিছু নয়!

গাছের খোড়লে থেকে সারাদিন ব’সে
পেঁচানীর কাছ থেকে পেঁচার মতন
চুমো খেয়ে তোমরা হয়েছ ক্লান্ত,- জানি
কিন্তু আমি কিছু পাই নাই!

আমরা হইনি ক্লান্ত;

তোমরা অনেক চুমো পেয়েছ তবুও;
পেঁচার মতন তবু,- ঘুঘুর মতন কিছু নয়

জানি আমি;- চুমা তবু চুমা;
তোমরা পেয়েছ চুমা আর সব চুমার সন্তান
তোমরা পেয়েছ;
আমি তবু একদিন ঘুম থেকে উঠে
রাতের বিছানা ধ’রে শুয়ে থাকি;
তবুও দেখিতে হবে চুনের মতন আলো
এসে চূন শাদা ক’রে গেছে জুলপির কাছে;
কাদাখোচা জলপিপি আবার এসেছে
চোখের ঘুমের পাতা খুড়ে-খুড়ে খেতে;
নষ্ট বিড়ালের মতো সারাদিন মন
শুকনো পাতার পিছে ছুটে-ছুটে অবসন্ন হয়!

পৃথিবীতে ক্লান্ত হ’য়ে আমরা তো বেঁচে থাকি তবু;
চুমো পেয়ে বেঁচে থাকি;
তবু জানি অন্য দিকে কোনো এক চুমো বেঁচে থাকে
আমাদের সব মেয়েমানুষেরা ম’রে গেলে!…
রুপার হাঁসের পাখা দেখি নাই,
তবুও রুপার হাঁস আছে
কোনো এক পালকের বিছানার ‘পরে;
সাত দিন সাত রাত শেষ হ’লে বনের ভিতরে
যে মানুষ মরেনাক তার মেয়েমানুষ সে আছে-।

আমরা কি সেই দিকে চলিতেছি?

ধলা ঘোড়া সেই দিকে যায়;

আমরাও?
পিছে-পিছে যাই;
তবুও এ-দিকে গিয়ে কেউ খুশি হয়?

আমি খুশি হবো নাকো আর;

কেন তুমি?

আইবুড়ো;
দেশে ফিরে গিয়ে
আমার করিতে হবে বিয়ে!

হাঃ! হাঃ! হাঃ!

আমি এ-সবের নই;

আমিও না;

আমাদের ফিরে যেতে হবে;

হয়তো হিজল গাছ সেখানেও আছে;

হয়তো;

ওর ঘোড়া চ’লে যাক ওর চাঁদকপালের দিকে;

যেই দিকে যায় চ’লে যাক;
(শিকারি দুজন ফিরে চ’লে গেলো।)

তুমি
তোমার পিছনে কারা?

আমি
আমার পিছনে আমি এতোদিন ঘুমে-জেগে কি কয়েছি কথা
কেউ তুমি শুনেছো কি?
চাঁদের আলোয় এসে যেন কোন্ চিতাবাঘ হ’য়ে
ঘাড় ধ’রে কামড়ায়ে গিয়েছে আমারে আকাশের চাঁদ যেন!
ব্যথা পেয়ে তবুও দেখেছি
চিতার উজ্জ্বল ছালে রূপ লেগে আছে!
চোখে তার পৃথিবীর কোনো এক মেয়ের মতন
ভালোবাসা আছে!
তাই আমি ক্লান্ত হ’য়ে গেছি।

তুমি
কোথায় যেতেছো তুমি? পৃথিবীর শেষে?
তুমি খুসি হবেনাকি পৃথিবীতে থেকে?
অন্য সকলের মতো ডিমের হলুদ খেয়ে তুমি
স্বাদ তবু পাবেনাকি?
জলের পদ্মের বড় পাতার নিচেতে
ছায়া খুঁজে থাকিবে না মাছের মতন?
-মাছের আঁশটে গায়ে লেগে
কোথাও পুঁটির মুখে রূপ খুঁজে!
তুমি ধান ভানিবার উঠোনের ‘পরে
ইঁদুরের শরীরের ঘ্রাণ নিয়ে এসে
রবেনাকি ছোট এক ইদুরের সাথে
সকল ভয়ের থেকে ছুটি নিয়ে- ভালোবেসে-?
কমলালেবুর মতো লাল রোদ গিলে?
-অশথ বটের গাছে পাখিদের মতো
ব’সে থেকে দুই ঠোঁট বাঁকা হবে নাকি!
বুড়ো পাখিদের মতো হবে নাকি আর
পৃথিবীতে ব’সে থেকে!

আমি
বেহালার মতো তবু সেই সব প’ড়ে আছে;
তবুও কোথাও কানে দোষ;
তাই আমি অশথ বটের গাছে বাঁকা ঠোঁট লয়ে
পাখিদের মতো বেঁচে বুড়ো হবো নাকো!

তবুও শেখাও
গাছের ছালের পরে ঠোঁট ভেঙে ফেলে
পাখিরা কি ম’রে যায়?
অনেক দেখেছি মেয়ে পড়শিনীদের;
তাদের বুকের থেকে ক্ষুদের মতন ঘ্রাণ পেয়ে
কেউ যেন একবার গিয়েছিলো খেয়ে
মুখের স্বাদের মতো তাহাদের স্বপ্নের হৃদয়!
তারে তারা একদিন মশারির জালের ভিতরে
মাথার স্বপ্নের মতো
কাছে পেতে চেয়েছিলো!
কিন্তু তবু এক ভোরে পচা এক ডিমের মতন
সেইসব ভেঙে ফেলে চ’লে গেছে তারা;
মাংস আর রক্তের বিছানার পরে- তারপর
সন্তানের জন্ম তারা দিয়েছে সকলে;
… আমি তবু তাহাদের মতো নাই।

স্বপ্ন নয়,- কিন্তু তবু যাদের হৃদয় জ্ঞান আছে
তাহাদের ঠোঁট বাঁকা!

জানি আমি;

পৃথিবীতে ব’সে থেকে তাহাদের রোম সব শাদা হ’য়ে গেছে,
তাদের কপালে শিঙ পেঁচার মতন জেগে ওঠে;
অনেক রাতের বেলা জেগে থেকে তাহারা তারার কাছ থেকে
ফিতা আর চাখড়ির শাদা লাঠি ধার ক’রে আনে;
তারপর পৃথিবীর মানুষের হৃদয়েরে মেপে ফেলে।
তাহাদের কথা তবু সকলেই মানে।

-জানি;

স্বপ্ন নয়;- তাদের হৃদয়ে বোধ আছে!
পাঁকের জলের মতো তারা নয়,- তাহাদের গভীরতা আছে!
তবু তারা ভালোবাসে!
তবুও তারার মতো আমি কোনো সবুজ পাহাড়ে
অন্ধকারে তাহাদের দেখি নাই!
তারা পাহাড়ের নিচে তারার আলোর মতো আছে;
সেইখানে? ঘোড়া আর কুকুরের সাথে?

চাঁদের শিঙের দিকে চেয়ে
পাহাড়ের পাথরের গায় মাথা খুঁড়ে
তাহার অলস নয়-!
ছোট মেয়েদের মতো হ’য়ে গেছে আমার হৃদয়!
পৃথিবীর অন্ধকারের ভয় পেয়ে তবুও সে পারেনি ঘুমাতে,
লুকাতে চেয়েছে মুখ বিছানার কাপড়ের তলে;
সেইখানে স্বপ্ন খুঁজে ভুলিতে চেয়েছে ব্যথা,
তবু তার বুড়োরা তো ঘুমায়েছে;
তাহারা ঘুমায়।

কোন্ এক ইদুর এসে ঘুম ভেঙে গেছে?
কোন্ ভয়?

আমি এক বোতলের মতো ক’রে তোমার নিকটে যদি রাখি
আমার এ-হৃদয়েরে,-
তুমি তার ছিপি খুলে দেখো;-
কিছু কি দেখিতে পার?
ছিপি তুমি খুলে দাও;

আমি এক কাচের গেলাসে সব হৃদয়েরে ঢেলে
তোমার ঠোঁটের কাছে তুলে ধরি যদি;

সেই জলে কার যেন মুখ ভেসে ওঠে!
চেয়ে দেখ,-
তবু তারে কোথাও কি দ্যাখা যায়?
… কোথাও সে চ’লে যেতে আছে!
ইঁদুরেরা খুঁজে গেছে সব সব-শেষ শিষ,
ছড়ায়ে-ছড়ায়ে ছিড়ে ইদুরেরে খুঁজে গেছে পেঁচা,
তারে তবু দ্যাখে নাই কেউ!

আমার হৃদয়ে তারে তবুও দেখেছ;
সেখানে পেঁচার পাখা রুপার মতন,
তাদের কপাল থেকে দুই শিঙ উঠে
চাঁদের শিঙের সাথে মিশে গেছে যেন;
সেই সরু পোলের উপর দিয়ে হেঁটে
মুখের রূপের মতো কারা সব আসিতেছে যেন!
রূপ তাই বেড়ে গেলো এতো!

-তবু তারে পৃথিবীতে চাই আমি!

যারা চায় তাদের বিষণ্ণ হ’তে হয়!

সব বিষাদের স্বাদ জানি;

তবু তারে পাবে না তো;

হৃদয়ে অনেক স্বপ্ন আছে!

পাখার মতন স্বপ্ন তাহার পায়ের চারিপাশে,-

স্বপ্নের ওপর দিয়ে তবুও সে চ’লে যায়!

গেলাসে-গেলাসে আমি হৃদয়েরে ঢেলে দিয়ে
সেই জলে ছবি খুঁজে-খুঁজে
অবসন্ন হ’য়ে গেছি;

অবসন্ন হ’তে হয়;

চাঁদের আলোয় এক সমুদ্রের নৌকার মতো
আমার হৃদয়; ভূতের নাওয়ের মতো,- আমি তবু একা তার হালে;
কোনোদিকে কোনোখানে কেউ নাই আর!
সমুদ্রের বড় সেই শাদা পাখি চ’লে গেছে উড়ে
যেইখানে জ্যোৎস্নায় ছাওয়া থাকে হয়তো সে দিকে;
অথবা যে ম’রে গিয়ে রয়েছে পিছনে;
ময়লা আলোয় তার ডানা যেন দেখিয়াছি আমি
মাঝ-সাগরের ঢেউ ভেঙে-ভেঙে আসিতেছে কাছে;
আমারে সে নিয়ে যাবে;
শান্ত ঘুঘুর মতো এক রাতে তবুও হৃদয়
শেষের চাঁদের শীতে বইঠার পরে
একাই ঘুমায়ে থাকে;
সেই ঘুম ভেঙে দিয়ে তবু
কোলের ছেলের মতো কেঁদে ওঠে ঢেউ!
মাঝ রাতে মোম জ্বেলে কে তুমি এসেছো!
চোখ কচ্লায়ে উঠে দেখি নাই আর,
বাতাসে মোমের গন্ধ প’ড়ে থাকে পিছের সাগরে!…

অস্পষ্ট ভূতের ছাওয়া দ্যাখা যায় ঢের
মাঝসাগরের পথে চাঁদের আলোয়!

-তোমার হৃদয় মরে গেলে তবু এ-সব থাকে না।

আমার হৃদয় তবু বেঁচে আছে;
খোলা পাখা তবু তার রয়েছে পিছনে;

কখনো সুমুখে;
কখনো বা ডান ধারে,- কখনো বা বাঁয়ে;
ঢেউ ভেঙে বার-বার সে আমার কাছে এসে পড়ে;
কোথায় সে নিয়ে যাবে?

কোথাও সে নিয়ে যেতে পারে;

তবু তার ঢেউ ভাঙা হয়নাক শেষ;
একদিন শেষ হবে,- কেউ জানে?
তবু তার পাখা যেন পৃথিবীর মতো নয়;
কাঁচা চোখে উঠে
ময়লা আলোর ঢেউয়ে দূরে
আর দ্যাখে মাঝসাগরের ঢেউ ভয় পেয়ে ওঠে!
তবু তার মোহ আছে,-
ভয় হয় আমি তারে একদিন ভালোবাসি যদি!

তারে ভালোবেসে তুমি ঢের দূরে চ’লে যেতে পারো,
সেখানেও সুখ আছে;
সেইখানে হৃদয়ের স্বপ্নের শিশুরা সব বড়ো হ’য়ে বেড়ে গেছে,-
ঢের বড়ো সুন্দরীর মাংসের মতন!
সেইখানে রূপসীর মাংসে শুধু রূপসীর মাংস জন্ম লয়,
তারপর মাংসে পোকা প’ড়ে যায়!
সবচেয়ে রূপ যারা ভালোবাসে
তাহারা রূপের স্বপ্ন ভালোবাসে সব চেয়ে!
তবুও সেখানে সব স্বপ্ন নষ্ট হয়!

কারা তবু সেইখানে যায়?

পৃথিবীতে বিবাহের বিছানায়
শুয়ে যাহারা অনেক ক্লান্ত হ’য়ে গেছে।
-তাহাদের ঢের অবসাদ,
তবু তারা আরো ক্লান্তি চায়;
তাহাদের মাংস ছুঁয়ে দেখেছ কি?

দেখি নাই;

হয়তো দেখিবে তুমি একদিন!
আমি মাঝ-সাগরের চাঁদের আলোয় একা আছি;
কিন্তু চাঁদ হেলে প’ড়ে গেলে
কপাল ঘামায়ে প’ড়ে ঘুম থেকে জেগে উঠে,
তখন ব্যথার জন্ম হয়;
পৃথিবীর মানুষেরা সেই ক্ষুধা জানে!
বুড়ো মরা পাখিদের গলার নলির মতো নষ্ট মনে হয়
সকল মাংসের কথা এইখানে!

স্বপ্নের নাড়ির সাথে হৃদয়ের নাভি যারা বাঁধে
তারা কি হয় না নিঃসহায়!
…ভেবে দ্যাখ তবু তুমি।

এইখানে হালে ব’সে
পৃথিবীর মেয়েদের রূপ তবু আমার পড়েছে মনে;
তাদের মাড়িতে আর দাঁত নেই;
তাদের নাকের উঁশা ভেঙে প’ড়ে গেছে;
তাহাদের পেট থেকে অনেক সন্তান
কৃমির মতন ক’রে খেয়ে গেছে তাহাদের;
কোনোদিন যারা আর মরে নাকো তাহাদের মনের ভিতর
রূপ হ’য়ে বেঁচে আছে তারা তবু!

অনেক-বয়সের মেয়ে
তোমাদের সব কথা আমিও শুনেছি,
ঘুমাতে-ঘুমাতে তাই জেগে ব’সে আছি;
হয়তো আমার মুখ ধনেশ পাখির মতো হবে;
তাহার তেলের মতো মন তবু;
আমার হৃদয়ে আছে অসুখের তবুও ওষুধ!

তুমি
কোনো এক মেয়েলোক?

আমি
পৃথিবীর বিছানায় শুয়ে
মানুষের বুক থেকে সেই সব ভালোবাসা ফুরায় না;
ভোরের আলোর মতো আঁশটে জালের থেকে ফেঁসে
তবু আমি চ’লে গেছি!

অনেক-বয়সের মেয়ে
তবু তুমি রূপ ভালোবাসো!

আমি
মাছের আঁশের মতো তবু তুমি;

অনেক-বয়সের মেয়ে
আমার পেটের থেকে যাহারা হয়েছে?-

আমি
তারাও তোমার মতো হবে;

অনেক-বয়সের মেয়ে
তাদের মতন কেউ সুন্দরী কি আছে?

আমি
মন্ত্রী-কোটালের সাথে তাহাদের বিয়ে হ’য়ে যাবে;
পৃথিবীর মানুষেরা তাহাদের নিয়ে ক্লান্ত হবে,
তাহাদের মতো আমি কেউ নই;

অনেক-বয়সের মেয়ে
রূপ নয়- রূপ নয়- কোনো এক ডাইনীর হাতে
কাপাশ তুলার মতো হৃদয় তোমার ধরা প’ড়ে গেছে!
চরকায় সব শেষ সূতা কেটে তোমারে সে ছেড়ে দেবে,
তারপর হৃদয়ের রবে কিছু?

তুমি
কে জানে হয়তো তারা ঠিক কথা বলে
পৃথিবীর এই সব মেয়েমানুষেরা!

আমি
এরা শুধু পৃথিবীর মানুষেরে দেখেছে যে,
সেখানে হৃদয় তবু অনেক সহজে খুশি হয়!
সবুজ তোতার মতো মটরশুঁটির ক্ষেতে থেকে
দুই ঠোঁট লাল ক’রে তারা আর চায়নাকো কিছু!
কিন্তু আমি পৃথিবীর মটরের ক্ষেতে গেলে মরে যাবো,-
দু-ঠোঁট হলুদ হবে,- তারপর শাদা হ’য়ে যাবে;
বল তুমি, এমন বিষণ্ণ মুখ দেখেছ কি!

আমি
তবু পারি না কি খুশি হ’তে
পৃথিবীর পথে গিয়ে?

পৃথিবীতে কে তোমারে দেখেছিলো?

হয়তো দেখেছে কেউ,
একজন থাকে, দেখে ফেলে;-

হয়তো সে পৃথিবীর গর্ভের ভিতর আজো এসে জন্মে নাই,
কিংবা তার জরায়ুতে সোনার ডিমের মতো উঠিতেছে ফলে!…
অথবা,-
মাংস আর রক্তের জীবাণুর ঢেউয়ে
কোথাও অনেক স্বপ্ন বেঁচে থাকে!
(সমুদ্রের ভেতর দামি জাহাজ ডুবে যাচ্ছে।)

তুমি
ঐখানে কারা?

আমি
কোনো এক রানী হবে,
আর তার মেয়েমানুষেরা;
কোথায় চ’লেছে তারা?

ওদের জাহাজ ওই সমুদ্রের হীরেকষ ফেনার
ভিতরে ডুবে যায়;- চেয়ে দেখ!

তুমি (অবাক হ’য়ে)
জাহাজের ওই সব পুরুষেরা এই-এই মেয়ে নিয়ে ছিলো!…
পৃথিবীর শেষে গিয়ে কোথাও তবুও
ওই সব মানুষেরা আবার বাঁচিতে পারে।
ম’রে যায়;-
ওদের মেয়েরা তবু এদের এখন ভালোবাসে?

আমি
মখ্মল্ পেটারার থেকে লাল রেশমের রুমালের মতো
এ-সব মেয়েরা;
সাগরের সবুজ চোখের রঙে তাহাদের ভয় নেই,
‘এলডোরেডোর’র থেকে সোনা খোঁজে যারা
তাহাদের হৃদয়েরে জুতোর হিলের তলে
রেখে তাদের সোনার থলি এরা ভালোবাসে-।

তবুও ডাকাত যদি রাজা হয়?

বেদে আর ডাকাতেরা তবুও অনেকবার রাজা হয়,-
তা না হ’লে পৃথিবীতে রুপার পেয়ালা সব চুরি যাবে;
পৃথিবীতে রূপ আর রবে না তো কিছু!
দাঁত থেকে এনামেল নষ্ট হ’লে
সেখানে রুপার দাঁতে রূপ তবু থাকে?

রুপা আর রূপ!…
চাঁদ হেলে চ’লে গেলে অন্ধকারে জলের ভিতরে
মুখ তার,
সে কাহার মেয়ে!

যখন সে চ’লে যাবে
এক মুখ বাতাস সে রেখে যাবে
পাখির মুখের মতো মুখ থেকে;
আর কিছু থাকিবে না!
দেখেছি অনেকবার;
তবুও বুঝেছি- আমারে সে ধরা দেবে!

সময়ের শেষে গিয়ে তারে পাওয়া যাবে!

আমার হৃদয়ে তবু সময়ের শেষ আছে;
তবে তুমি বেঁচে থেকে দেখো,-
সব পেঁচা মরে গেছে জ্যোৎস্নায় হিমশিম হ’য়ে!
ইঁদুরেরা মরে গেছে আগে;
সকল চাঁদের শিঙ খসে গেছে আকাশের থেকে
ভেড়ার শিঙের মতো বুড়ো হ’য়ে;
ফুটোনো জলের থেকে ধোয়ার মতন
আমার হৃদয় তবু ভাসিতেছে!

সব ধোঁয়া কোথায় যেতেছে?

জল হ’য়ে ফিরে আসে সব!

যখন ভেঙেছে সব, হারায়েছে, গেছে সব চুরি
তোমার হৃদয় এক বাসনের মতো তুমি রেখেছ গুছায়ে;
আমার চোখের জল মাংসের মতো তার!
তাই খেয়ে বেঁচে থাকে!

[রচনাকাল ১৯২৯]