এক বর্ষ


একটী বৎসর হয় কালের সাগরে
দেখিতে দেখিতে অই গড়ায়ে পড়িল!
রাখিয়া স্মৃতির চিন্তু ভবিষের স্তরে,
জলের বুদ্বুদ আহা জলে মিশাইল!
সম্মুখে নুতন ঢেউ তীর বেগ ধরি
অই দেখ হুহু করে আসিছে ছুটিয়া!
কে জানে জন্মের মত এই স্রোতে পড়ি
কত প্রাণ হাহাকারে যাইবে ডুবিয়া!


পশ্চাতে ভীষণ দৃশ্য, ভয়ে কাঁপে প্রাণ,
কত দেশ, কত রাজ্য লণ্ড ভণ্ড করি
করেছে মানব শূন্য গভীর শ্মশান!
জাগিছে, ত্রিশূল হস্তে নীরব প্রহরী!
অই দেখ মহানদী গভীর গর্জ্জনে
গ্রাসিয়াছে কত চিত্র নয়ন রঞ্জন;
মিশিয়া অনন্ত নীলআকাশের সনে
গর্জ্জিছে বিপুল বেগে তরঙ্গ ভীষণ!


কত সম্রাটের আহা অতুল বৈভব
গ্রাসিয়াছে এই নদী করি হুহুঙ্কার;
চূর্ণ চূর্ণ করি শেষে অট্টালিকা সব
রাখিয়াছে অভাগার কপ্নী মাত্র সার!
কত বালিকারে হায় কাঙ্গালিনী করি
অসময়ে মাতৃস্নেহে করিল বঞ্চিৎ!
দুঃখিনীর সেই অশ্রু মূহুর্ত্তেক হেরি
পাষাণ সদৃশ হৃদি হয় বিচলিত!


কত সাধ্বী রমণীর সতীত্ব-রতন,
খসিয়া পড়িল এই তরঙ্গের ঘায়!
অভাগীর মর্ম্মভেদী করুণ রোদন
মুহূর্ত্তের তরে কেহ শুনিল কি হায়!
শুনিল কি হায় সেই করুণ চিৎকার?
সুষুপ্ত ভারতে যেন নাহিরে জীবন!
নির্ব্বাণ অনল-কুণ্ডে বিফল ফুৎকার,
নহিলে ভারত বক্ষে কেন এ প্লাবন!


অই দেখ কোটি কোটি মানব কঙ্কাল
ভাসিছে দক্ষিণে বামে রক্তের সাগরে,
যন্ত্রণার দুর্ব্বিসহ তরঙ্গ উত্তাল
উঠিছে গর্জ্জিয়া বেগে গগন উপরে!
সাহিত্যের স্বর্ণাকাশে নক্ষত্র নিচয়
শশাভিত যা অবিরাম উজ্জল বরণে,
আঁধারি জগত সেই রত্ন জ্যোতির্ম্ময়
ডুবিয়াছে অতীতের অনন্ত জীবনে!


দু একটী তারা এবে গগনের তলে
জ্বলিতেছে মৃদু মৃদু উল্কার মতন!
ভবিষ্যের নবস্রোতে এই নদী জলে
বুঝিবা জন্মের মত হয় নিমগন!
পড়ি এই ঘুর্ণপাকে ডুবিয়া ভাসিয়া
এসেছি পদ্মর এই ভীষণ সৈকতে!
অবস্থার অন্য স্রোতে লইবে টানিয়া
কে জানে কোথায় হায় পাতালে মরতে!


কাঁদাইয়া চিরতরে জননী আমার
ডুবিয়াছে এ অনন্তকাল-সিন্ধু-জলে!
এজীবনে সেই মুখ না দেখিনু আর
যে মূর্ত্তি রাখিয়াছিনু, হৃদয়ের তলে!
কত আশা, কত যত্ন এঘোর প্লাবনে
এজন্মের মত হায় গিয়াছে ভাসিয়া!
নিরাশার তীব্রতর ঘোর নিষ্পেষণে!
হৃদয়ের কক্ষ, গুলি পড়েছে ভাঙ্গিয়া!


তাহে দারিদ্রের দায় নিত্য উপবাসে,
হইয়াছে দেহ খানি অস্থি মাত্র সার!
শিশু, গুলি কেঁদে মরে দারুণ পিয়াসে,
লজ্জায় সে কথা মুখে নাহি আসে আর!
সম্মুখে অনন্ত, হায় অনন্ত পশ্চাতে,
অনন্তে অনন্তে মরি যুদ্ধ ভয়ঙ্কর!
ভবিষ্যে ঠেলিয়া দুরে তীব্র কষাঘাতে
অতীত টানিয়া নিল একটী বৎসর!


দারুণ সংযোগ স্থলে আবর্ত্তের পাকে
কত মানবের প্রাণ হইল সংহার!
অদূরে দুর্ভিক্ষ পেঁচা অমঙ্গল ডাকে,
এবার অদৃষ্টে বুঝি নাহিরে নিস্তার!
অই শোন চারিদিকে ভীম কোলাহল
ছুটেছে ত্রিদিব পথে তেদিয়া গগণ!
এইবার পৃথ্বী বুঝি যায় রসাতল,
ভয়ে সশঙ্কিত স্বর্গে দেব সেনাগণ!

১০
একটী বৎসরে হায় এ জন্মের মত
আকুল পরাণে করি শেষ সম্ভাষণ!
প্রকৃতির প্রিয় কাৰ্য্যে হইয়া বিরত,
বিষাদে মলিন মুখে ডুবিল তপন!
আজি এ পদ্মার তীরে বিষণ্ণ হৃদয়ে
জীবনের এক ঢেউ ফেলিলাম পাছে!
পড়িলাম অন্য স্রোতে, হায় অসময়ে
নাহি জানি এ অদৃষ্টে আরো কত আছে!