দিল্লী

হায় দিল্লী, কেন তুমি এ মলিন বেশে
কেঁদে কেঁদে মৃতপ্রায় র’য়েছ পড়িয়া!
কোন্‌ কথা মনে পড়ে বক্ষ যায় ভেসে
কে দিল তোমার প্রাণে এ অগ্নি জালিয়া?


কেথায় তোমার সেই স্বর্ণোজ্জল বেশ,
কোথায় তোমার সেই কান্তি বিমোহন!
কোথায় তোমার সেই গৌরব অশেষ,
কোথায় তোমার সেই বীরত্ব-ভূষণ?


ছিলে তুমি ভারতের চারু রাজধানী,
কে ছিল তোমার সম? ঝলসি নয়ন
শোভিত তোমার শিরে কোহেনুর মণি!
স্তম্ভিত তোমার বীৰ্যে সমগ্র ভুবন!


দিবানিশি এক ভাবে প্রমোদ-সাগরে
রহিতে ডুবিয়া, মুখে ধরিত না হাসি!
আজি কেন ম্লান মুখে বিষণ্ণ অন্তরে?
চাপিয়া রে’খেছ বুকে কি অনল রাশি?


হায় দিল্লি, কে জানিত মুহূর্ত্তের তরে
হইবে যে এত শীঘ্র তোমার পতন!
কত সাধ, কত আশা ছিল এ অন্তরে
কে জানিত দুই দিনে হবে সমাপন!


আগে জানিতাম যদি এই ভব হবে,
তোমার সে রূপ-রাশি নয়ন ভরিয়া
হেরিতাম দিবা নিশি নীরবে নীরবে,
রাখিতাম সেই চিত্র হৃদয়ে আঁকিয়া!


আজিও তো স্বপ্ন প্রায় ধূধূ মনে পড়ে,
যতদিন বেঁচে হায় রহিব ভুবনে!
সুধু সেই স্মৃতিটুকু জাগিবে অন্তরে,
সাক্ষ্য দিবে ইতিহাস সজল নয়নে!


নহবত কি মধুরে দিবস শর্ব্বরী
বাজিত তোমার কীৰ্ত্তি বিঘোষণ ক’রে!
চুম্বিয়া চরণ তব যমুনা সুন্দরী
গাইত গৌরব গীতি দেশ দেশান্তরে!


তোমার সে রণবাদ্য ভীম কোলাহলে
উঠিত বাজিয়া সেই সমর-প্রান্তরে!
তুচ্ছ নর যত জীব অবনী মণ্ডলে
উঠিত কাঁপিয়া সবে সভয় অন্তরে!

১০
পাণিপথে, হল্‌দিঘাটে ভীম পরাক্রমে
খেলেছিলে যেই খেলা স্তম্ভিয়া ভুবন!
উঠেছিল যেই ধ্বনি পর্ব্বতে কাননে
কোটি কণ্ঠে, তার-স্বরে ভেদিয়া গগন!

১১
বহিত যে স্থানে সদা আনন্দ-তুফান,
শত শত ঝাড় যথা ধাঁধিত নয়ন!
সম্রাট বেগম বিনে হায় সেই স্থান
জন শূন্য, শোভা শূন্য কণ্টক-কানন!

১২
সে মতি মহল আজি পেঁচক আবাস
যথায় বেগমগণ করিত বিহার!
শৃগাল বাদুর পূর্ণ সে দেওয়ান্‌ খাশ
ভগ্নপ্রায় অতুলিত কুতব মিনার!

১৩
মৰ্ম্ম-নির্ম্মিত সেই অট্টালিকা সব
সুবর্ণের লতা পাতা অঙ্কিত যাহায়!
যেন আজি প্রাণশূন্য, গভীর নীরব
জগতের নশ্বরতা মুহূর্ত্তে জাগায়!

১৪
সে মসজিদ আজি হায় গভীর নির্জ্জন
লক্ষ লক্ষ লোক যেথা হ’ত সংমিলিত!
আজানের প্রতিশব্দ, পীযুষ বর্ষণ
করিত যেখানে, ভোরে জাগায়ে নিদ্রিত!

১৫
যেখানে রমজান মাসে নিশীথ সময়ে
তারাবির প্রতি শব্দ বায়ু স্তরে স্তরে
ভ্রমিয়া উদাস প্রাণ প্রকৃতি হৃদয়ে
ঢালিত অমৃত, সৃষ্টি আকুলিত করে!

১৬
যেখানে একাগ্র চিত্তে কতলোক হায়
প্রত্যহ মধুর স্বরে পঠিত কোরাণ!
যেখানে পণ্ডিত বর্গ ধৰ্ম্মের চর্চ্চায়
জাগাইত পাতকীর মোহ-মুগ্ধ প্রাণ!

১৭
যেখানে সম্রাটগণ অনুতপ্ত প্রাণে
ভক্তি ভরে নত শিরে হ’ত বিলুণ্ঠিত!
আজি তথা কি বলিব? বলিব কেমনে
বিধর্ম্মীর পাদুকায় ঘোর কলঙ্কিত!

১৮
সে বিগত চিত্ৰ আজি হয় কি স্মরণ?
কি প্রভেদ এ উভয়ে কে বুঝিতে পারে!
ছিলে রাজ রাণী, পদে অসংখ্য রতন,
ভিখারিণী প্রায় আজি আঁধারে আঁধারে!

১৯
কি দুঃখে ধ’রেছ এই উদাসিনী সাজ?
দেখিলে নয়নে ঝরে শোক-অশ্রুজল!
হায় কি ভীষণ দৃশ্য!- বক্ষে তব আজ,
সমাধির পরে হায় সমাধি কেবল?