প্রকাশক-দিগের বিজ্ঞাপন

ইংরাজী ১৮৬২ সালের জুন মাসে কবিবর মাইকেল মধুসূদন দত্ত বারিস্টর হইবার মানসে ইংলণ্ড যাত্রা করেন। যাত্রাকালে মাতৃভূমিকে সম্বোধন করিয়া যে একটী কবিতা লিখিয়া যান, তাহা সোমপ্রকাশ প্রভৃতি সম্বাদপত্রে এবং ১ম ভাগ মেঘনাদবধকাব্যের মুখবন্ধে মুদ্রিত হইয়াছে; অতএব সেটী এখানে উদ্বৃত করা আর আবশ্যক বোধ হইতেছে না। মাইকেল মধুসূদন ইংলণ্ডে দেড় বৎসর থাকিয়া ১৮৬৩ সালের অক্টোবর মাসে ফ্রান্স রাজ্যে গমন করেন এবং ভরসেল্‌স নামক তথাকার সুপ্রসিদ্ধ নগরে দুই বৎসর কাল অবিস্থিতি করেন। তিনি এই সময়ে ‘চতুর্দ্দশপদী কবিতাবলি’ নাম দিয়া একশতটি কবিতা ছাপাইবার জন্য আমাদিগের নিকট পাঠাইয়া দেন। কবিতাগুলির প্রত্যেকেই চতুর্দ্দশমাত্র পদবিশিষ্ট। ইউরোপ খণ্ড হইতে ইতিপূর্ব্বে আর কখন বাঙ্গালা কবিতা লিখিত হইয়া মুদ্রিত হইবার নিমিত্ত কলিকাতায় প্রেরিত হয় নাই এই জন্য আমরা কবিবরের বন্ধুদিগের এবং সাধারণের সন্তোষার্থে কবিতাগুলির উপক্রমভাগটা মুদ্রাক্ষরে না ছাপাইয়া যেরূপ লিখিত ছিল অবিকল তদনুরূপ হস্তাক্ষরে ছাপাইলাম। উপক্রমটী দেখিয়া পাঠকবৃন্দ কবিবরের হস্তাক্ষর বুঝিতে পারিবেন এবং যেরূপে কবিতাটী লিখিত হইয়াছে তাহাও দেখিতে পাইবেন।

আমরা গ্রন্থকারের হস্তাক্ষর দেখিয়াই উক্ত কবিতাগুলির মুদ্রাকার্য সম্পন্ন করিয়াছি; পরন্তু কবিবরের অনুপস্থিতি নিবন্ধন প্রুফ সংশোধন করিতে, বোধ হয়, কোন কোন স্থানে ভুল রহিয়া গিয়া থাকিবে, এজন্য সহৃদয় পাঠকবর্গ আমাদিগের দোষ মার্জনা করিবেন। ফলতঃ গ্রন্থকার স্বয়ং প্রুফ সংশোধন করিলে গ্রন্থখানি যেরূপ নির্ভুল হইত, তাঁহার অনুপস্থিতিতে সেরূপ হইবার কোন সম্ভাবনা নাই।

দত্তজ মহাশয় বিদেশে গিয়া এবং বিদেশে থাকিয়াও মাতৃভাষার উন্নতি-সাধনে বিরত হন নাই। তিনি দেড় মাসের পথ হইতেও প্রিয় অমিত্রাক্ষর ছন্দে কবিতা লিখিয়া পাঠাইয়াছেন। দুঃখের বিষয় এই যে, তাঁহার অবকাশ কিছুই মাত্র ছিল না। অবকাশাভাব প্রযুক্ত যত দূর মনে করিয়া ছিলেন, তত দূর কৃতকার্য হইতে পারেন নাই। তিনি সুভদ্রার হরণ-বৃত্তান্ত লিখিতে আরম্ভ করিয়া সময়াভাবে শেষ করিতে পারেন নাই। পাঠকবর্গ ৩৮ সংখ্যক কবিতাটী পাঠ করিলেই জানিতে পারিবেন। তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য আদ্যন্ত্র সংশোধিত করিবার এবং বিদ্যালয়োপযোগী আর এক খানি নীতিগর্ভ পুস্তক রচনা করিবারও মানস করিয়াছিলেন; কিন্তু সময়াভাবে সে গুলিও শেষ করিতে পারেন নাই, সকলেরই কিয়দংশ মাত্র লিখিয়া ক্ষান্ত হইয়াছেন। তিনি ইউরোপে গিয়া আইন অভ্যাস করিতেই ব্যস্ত, অবকাশের অপ্রতুল হইবে তাহার সন্দেহ কি? বিশেষতঃ সেখান হইতে জর্ম্মান, ফেঞ্চ, ইটালিক, লাটিন, গ্রীক, প্রভৃতি অনেক গুলি ভাষা শিখিয়াছেন তাহাতেই তাঁহার যথেষ্ট সময় লাগিয়াছে।

আমরা উপর্য্যুক্ত সুভদ্রাহরণ, তিলোত্তমা, ও হিতোপদেশের যে অংশ প্রাপ্ত হইয়াছিলাম তাহা ‘অসমাপ্ত কাব্যাবলি’ শিরোনাম দিয়া চত্তর্দশপদীর শেষভাগে সংযোজিত করিয়া দিলাম। পাঠকবর্গ দেখিলেই তাহাদের গুণাগুণ বুঝিতে পারিবেন।

চত্তর্দশপদীর ৮০ সংখ্যক কবিতাটী গ্রন্থকার ইটালীর অধিপতি ভিক্‌টর ইমানুয়েলকে উপঢৌকন স্বরূপ প্রেরণ করেন। ইটালীশ্বর স্বীয় প্রধান মন্ত্রীকে দিয়া দত্তজ মহাশয়কে এক প্রশংসাসূচক উত্তর লিখিয়া পাঠান। এই কবিতা ইটালীদেশীয় সুপ্রসিদ্ধ কৰি দান্তের উপর লিখিত হয়। ইনি ফ্লরেন্স নগরে জন্ম গ্রহণ করেন। ১৩০০ খৃঃ অব্দে উক্ত নগরের একজন প্রধান মাজিস্ট্রেটের পদে অভিষিক্ত হইয়া কোন সম্প্রদায় বিশেষের বিরোধে লিপ্ত থাকাতে তিনি স্বদেশ হইতে নির্বাসিত হন। নির্ব্বাসিতাবস্থায় লা কমেডিয়ান নামে জগদ্বিখ্যাত কাব্য ইটালি ভাষায় রচনা করেন। এই কাব্যে স্বর্গ ও নরকের বিষয় অতি সুন্দররূপে বর্ণিত আছে। এরূপ অনুমান করা হয় যে, কবিগুরু দান্তে ভার্জিলের সমভিব্যাহারে নরকে প্রবেশ করিয়া পাপিদিগের যন্ত্রণা ভোগ বর্ণনা করেন। তিনি লাটিন ভাষায় আর কতকগুলি কাব্য লিখিয়া আপন যশঃ আরো বিস্তীর্ণ করেন। ১৮৩০ সালে ফ্লরেন্স নগরে তাঁহার স্মরণার্থে একটী সমাধি-মন্দির নির্মিত হয়।

৮১ সংখ্যক কবিতাটী পণ্ডিতবর গোল্‌ডষ্টুকরকে লিখিত হয়। ইনি জর্ম্মানি দেশ-নিবাসী সংস্কৃত ভাষায় এক জন মহাপণ্ডিত এবং বোডিন কলেজে উক্ত ভাষার প্রধান অধ্যাপক; কতকগুলি সংস্কৃত গ্রন্থ সংশোধনপূর্ব্বক পুনর্মুদ্রিত করিয়াছেন, বিশেষতঃ সুবিখ্যাত উইলসন্‌ সাহেবকৃত সংস্কৃত অভিধানের সংশোধন ও পুনর্মুদ্রাঙ্কন কার্য্যে প্রবৃত্ত হইয়াছেন। প্রায় দশ বৎসর হইল এই কর্ম্মে ব্যাপৃত আছেন, অদ্যাপিও স্বরবর্ণের আদ্যক্ষর “অ” শেষ করিয়া উঠিতে পারেন নাই। ইংলণ্ডে অধুনা সংস্কৃত ভাষার উন্নতি-সাধন বিষয়ক “সংস্কৃত টেক্সট সোসাইটী” নামে যে এক সমাজ সংস্থাপিত হইয়াছে ইনি তাহারও একজন প্রধান সম্পাদক।

৮২ সংখ্যক কবিতাটী আল্‌ফ্রেড্‌ টেনিসনের উপর লিখিত। ইনি ইংলণ্ড দেশীয় ইদানীন্তন সুপ্রসিদ্ধ কবি। ইংরাজী ভাষায় অনেকগুলি প্রসিদ্ধ কাব্য রচনা করিয়া আপন নাম চিরস্মরণীয় করিয়াছেন। ইনি অদ্যাপি জীবিত আছেন।

ভিকটর হ্যূগো ফ্রান্সদেশীয় ইদানীন্তন অতি প্রসিদ্ধ কবি। ১৮০২ খৃঃ অব্দে জন্ম গ্রহণ করেন। দশ বৎসর বয়ঃক্রম হইলে কবিতা লিখিতে আরম্ভ করেন, পরে অনেক গুলি কাব্য, নাটক এবং উপন্যাস লিখিয়া এই জগন্মণ্ডলে বিস্তর যশঃ বিস্তার করিয়াছেন।

স্ট্যানহোপ্‌ প্রেস,
কলিকাতা,
১লা আগষ্ট ১৮৬৬।

শ্রী ঈশ্বরচন্দ্র বসু কোং।