কথোপকথন ৩

শুভঙ্কর-
কালও ছিল মেঘ, কনস্টেবলের মেঘ।
মরা মানুষের চোখ থেকে রঙ নিয়ে
আকাশ নিজের ট্রাউজারে পরেছিল।
আজ খুলে গেল নীলের দরজা হঠাৎ।
কী আশ্চর্য, সূর্যও দেখ আর নয় ততখানি
সামন্ততান্ত্রিক।
আকাশের খাতা থেকে
‘পেরেস্ত্রোইকা’ শিখে নিয়ে বনবনান্ত জুড়ে হাওয়ারাও দেখ কেমন
বদলিয়ে গেল স্থবিরতা থেকে ফুল্লপ্রাণের যুবকে।
তার মানে আশ্বিন।
নন্দিনী মনে পড়ে
চুয়াত্তরের, পঁচাত্তরের, ছিয়াত্তরের এবং সাতাত্তরের
আশ্বিন যাকে এঁকেছিল ক্যানভাসে?

নন্দিনী-
মহাশয়, স্টেটমেন্টে ভুল।
ক্যানভাস আশ্বিন কেন হবে?
আশ্বিন তো ক্যানভাসের ফ্রেম।
ক্যানভাস আমাদের সেই সব ছিন্ন মুহূর্তেরা
ঘোরতর সংসারের তলপেটে সিঁধকাঠি দিয়ে
চুরি বা ছিনতাই করে যাদের নিঃশব্দে জড়ো করা
কী ভয়, কী ভয় নিয়ে
যেন ব্রীজ ভেঙে পড়বে গম্ভীর চুরমারে
আর আমি ব্রীজের মাঝখানে
এই ভয়ে অন্তরাত্মা প্রাচীন ঘড়ির পেন্ডুলাম।

শুভঙ্কর-
তুমি একটু বেশি ভীতু ছিলে।
সজারুর মতো সাবধানী।
সাহসকে দ্রৌপদীর শাড়ি করতে শেখনি কখনো?
এখন শিখেছ?
পূর্ব ইউরোপের মতো ভেঙে যেতে পার, যদি ভাঙি?

নন্দিনী-
হাসিটা সরাও ঠোঁট থেকে।
তোমার ও দুষ্টু হাসি ছদ্মবেশী ছুরি।
অনেক চিরেছ আগে,
আমার কান্নায় রোজ রক্ত মিশে গেছে।

শুভঙ্কর-
এবং আমার?
আমার কান্নায় বুঝি রক্ত ছোপ লাগেনি কখনো?
সর্বস্ব দেওয়ার ছলে যা দিয়েছ সেই সামান্যের
প্রতিক্রিয়া-জাত কাঁটা রক্তে ডুবো-সাবমেরিন হয়ে
টহল দিয়েছে।
তবু তাকে ঐশ্বর্য মেনেছি।

নন্দিনী-
আমাদের পায়ে-গায়ে-রক্তের নাড়ীতে
অনেক শিকল।
যা উজাড় দিতে পারি
দিতে গিয়ে দিতে যে পরি না
তার শোক শিলাস্তর,
জমতে থাকে চেতনার পরতে পরতে।

শুভঙ্কর-
দুদিকেই ক্ষয় ক্ষতি ক্ষত ছিল বলে
যাকে মনে হয়েছিল অনুল্লঙ্ঘ অমোঘ নিয়তি
সে বার্লিন দেয়ালেরও অবিশ্বাস্য লুণ্ঠিত পতনে
পুনর্মিলনের স্রোতে একাকার হয়ে গেল দুদিকের দুই।
দুদিকেই কান্নার রক্তের
চোরাস্রোত চিরে চিরে পরিপূর্ণ পূর্ণিমার ঘাটে পৌঁছনোর
প্রবল প্রবলতম ইচ্ছা-আলোড়ন ছিল বলে
সুদূর নেপথ্য থেকে রাজহংসী ফিরে এল ফের
রাজহংস যেখানে ঘুমোয়।

নন্দিনী-
এখনো অবাক করে দাও।
এত বছরের পরও সেই কবেকার
ফোটার পরেও আজও ঠিক যেন আজকেরই ভোরবেলার
ভিজে শিউলির মতো অবর্ণনীয়তা নিয়ে আছ।
তুমি বৃদ্ধ হবে না কখনো?
বয়সের কথা থাক,
তোমাকে কি ছোঁয় না অকাল?
তেলের খনির থেকে সাগরে গড়ানো লাভাস্রোত?
কালো বৃষ্টিপাত?
সুচতুর ধ্বংসের খোদায়ে
ইতিহাস আজ যেন অস্থিসার পমপেই হয়েছে।
এইসব অন্তর্ঘাত তোমার পালকে ছ্যাঁকা দ্যায় না কখনো?
তৃণের তানপুরা পুড়ে বাজে না বেসুরো?

শুভঙ্কর-
বাজে। বেজেছিল।
কিন্তু যেই তুমি এলে প্রাঙ্গণের শিরীষের ঘনছায়াতলে
ছেঁড়া কাঁথা শিল্প হয়ে গেল।
তুমি আবিশাগ
তুমি বাইবেলের পরমা রমণী
রাজা দায়ুদের রক্তে শীত
হাড়ে-মাসে শীতের কুঠার
শীত দাঁতে চিবোয় যৌবন।

শীতভারে শতছিন্ন যেন
শীতের ডাইনী কালো চুলে
ঢেকেছে ওষ্ঠেরও আকুলতা।

আজ তার চুম্বনেও শীত।
আলিঙ্গনও শীতে থরোথেরা।
রন্ধ্রে রন্ধ্রে শীতের বৃংহন।

শীতের শ্মশানযাত্রী তিনি।
তবু তাঁকে বাঁচাতেই হবে।
তাই তো তোমার অন্বেষণ।

তুমি আবিশাগ
তুমি আগে ছিলে পুরাণের নারী
রাজ দায়ুদের দেহে লেপ-তোষকের মতো নিজের নগ্নতা ঢেলে দিয়ে
বাঁচাতে পারনি তার প্রবীণতা, যা নষ্টে প্রাচীন।

আজ তুমি অন্য আবিশাগ
আজ তুমি এই শতাব্দীর নক্ষত্র-দীপ্তিতে রাঙা নারী।

পৃথিবীর শত শত কবিতা ও গান থেকে তোমার নির্মাণ।
পৃথিবীর উপন্যাস নিংড়ে নিয়ে তুমি তিলোত্তমা।
পৃথিবীর চলচ্চিত্র তোমাকে দিয়েছে অগ্নিরূপ।
পৃথিবীর নাটকেও তুমি রক্তকরবীর স্পর্ধিত নায়িকা।
পৃথিবীর সব তৈলচিত্র ছেঁকে তোমার প্রতিমা।
পৃথিবীর ভাস্কর্যের সব রত্নকণা দিয়ে অলঙ্কৃত তুমি।

তুমি থাকতে কেন বৃদ্ধ হব?
তুমি থাকতে যৌবনে যযাতি?
আমাকে নির্মিত করো তুমি
আমি মাতি আমার নির্মাণে।