কথোপকথন ৪

নন্দিনী-
সাত বছরের দীর্ঘ বনবাস পর্ব শেষ করে
ফের কলকাতায়।
আগে শুনব কলকাতার কথা।
কলকাতা কেমন আছে বলো।

শুভঙ্কর-
কলিকাতা আছে সেই কলিকাতাতেই।

নন্দিনী-
সেই একই ইয়ার্কির ঢং।
প্রবাসে দৈবের বশে তোমাকে তো হয়নি কাটাতে।
গুনে গুনে সাতটা বছর।
হলে বুঝতে এই পোড়া শহরটা হৃৎপিণ্ডের কতটা আপন।

প্যারিসেও নদী ছিল
ভেনিসেও ছিল জল টিয়ার পালক দিয়ে ধোয়া।
সুইজারল্যান্ডের লেক চিল্কার বোনের মতো যেন।
লন্ডনের টেমসও নদী? কুটিকুটি হয়েছি হাসিতে।
হাসি থামলে বুক জুড়ে চার্চের ঘণ্টার প্রতিধ্বনি।
কলকাতা, গঙ্গার ঘাট, হাওড়া ব্রীজ আর আমাদের
সূর্যাস্তের রক্তক্ষণে সন্ত্রাসবাদীর মতো ষড়যন্ত্রময় অভিসার
স্মৃতির পুঙ্খানুপুঙ্খ রক্তে যেই সুড়ঙ্গ খুঁড়েছে
অমনি কলকাতা, অমনি দ্রুত ফ্ল্যাশব্যাক।
তুমি হাঁটছো, কাঁধে ঝোলা, কলেজ স্ট্রীটের
পুরনো বইয়ের গন্ধে গা ডুবিয়ে, বোদলেয়ারের
কিংবা রিলকে অথবা র‌্যাঁবোর
সোনার তরীর খোঁজে।
ফ্লোরেন্সে বৃষ্টিতে ভিজছি
দপ করে কলকাতার সাদার্ণ অ্যাভিন্যু।
হাঁটু জলে ডুবো রিকশা, পর্দার ভিতরে
বৃষ্টির কুসুমে গাঁথা ফুলশয্যা, নিভৃত বাসর।

স্মৃতির কি নির্দয় ছোবল!
স্বর্গবাস তৎক্ষণাৎ থানার হাজত।

যদি কলকাতাকে পাই কান ফেস্টিভ্যালে ছুটে গেছি।
ছাপার অক্ষর ফুঁড়ে যদি জেগে ওঠে কলকাতা
ফ্রাঙ্কফুর্টের বইমেলায় দৌড়ে গেছি প্রায় নিঃসম্বল।

কলকাতা, তোমার মুখ
কলকাতা, তোমার আলিঙ্গন
কলকাতা, তোমার সব নীল চিঠি
জুড়ে গেছে দু ফোঁড় সেলায়ে।

ঠাট্টা নয়, সত্যি সত্যি কলকাতার কথাবার্তা বলো।

শুভঙ্কর-
কলকাতা ভালোই আছে।
একটু আধটু অসুখ-বিসুখ, সে তো থাকে, থাকবেই
বয়সের মাধ্যাকর্ষণে।

যদি সত্যি তিনশো হয়, বয়সটা তো বাল্যাবস্থা নয়।
হাঁপানী আগের চেয়ে কম মারাত্মক।
রক্তের ফোটার অর্শ অবশ্য অনেকটা সেরে গেছে।
হার্ট-বিট হাওয়া বুঝে পারদের মতো ওঠে নামে।
প্রেসার হাই কি লো, নিউজপেপারই বলতে পারে
শুধু যা বেড়েছে সেটা চোখের অসুখ
দুচোখেই পুরু ছানি, অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র অন্ধকারে।
আর কি শুনকে বল?
শিকড়-বাকড়, বীজ, বল্কল ও তরতাজা ডালপালা নিয়ে
এখনো যে যথাপূর্ব হাসপাতালেই।
প্রতিদিনই আরোগ্যসম্ভব।

নন্দিনী-
সেই ঠাট্টা! বুঝেছি, বলবে না।
তাহলে তোমার কথা বলো।

শুভঙ্কর-
ফিরেছে সখী, আমার দিনগুলো
এখন কোলা ব্যাঙের মতো ফুলো।
অমাবস্যা লম্বা ছুটি নিয়ে
পগারপার, পূর্ণিমাকে দিয়ে।
আমার কথার মুড়োলো নটে গাছ,
আমি তোমার গহন জলের মাছ।
বলা বাহুল্য; পুনরায়।

নন্দিনী-
বলা বহুল্য, এই স্রোত বছরে
এক ছটাকও বয়স বাড়েনি তোমার ছেলেমানুষির।