কথোপকথন ৫

শুভঙ্কর-
জলকন্যা সম্বোধনে রাগ করনি তো।
কি জানি তোমাকে জল, জলোচ্ছাসে, বিধ্বংসী প্লাবন
এভাবেই ভাবতে ভালো লাগে;
হয়তো ভাসাও বলে ঠিকানাবিহীন বানানীতে।
তোমার চোখের নিচে যতবার পেতেছি রেকাব
দিয়েছ মোহর ঢেলে, ঘরে ফিরে দেখি হাকাকারে
জলবিন্দু, ঘন শ্রাবণের।

যে সাত বছর তুমি কলকাতার চত্বরে ছিলে না
কি করেছি জানাতেই হবে?
এক ঝুড়ি মাটি নিয়ে ঘোরতর জ্বরের ভিতরে
মেদিনীপুরের গালা-পুতুল বা মৈমনসিংহের
আদি-মাতৃকার মূর্তি, ঢোকরাদের, পাঁচমুড়ারও, প্রেরণাচালিত,
জায়কোমিত্তির মতো লম্বা লম্বা মানুষ গড়েছি।
জন বার্জারের ঐ বইখানা পড়েছ নিশ্চয়-
আর্ট অ্যান্ড রেভলিউশন।
তাহলে তো জানা আছে নিজভেস্তিনির ভাস্কর্যের মৌলিকতা
মূর্তির ভিতর থেকে কিভাবে বারুদ মুক্তি চায়।

আসলে বারুদই ছিল প্রিয় খেলা এই সাত বছর
নিজের নিহত আত্মা শত টুকেরা করে
এভাবে ওভাবে জুড়ে কতবার কতরকমের
মানুষের ধাতুরূপ ধরা যায় সেই অনিশ্চয়ই
ছিল প্রিয় লক্ষ্যভেদ, রক্তাক্ত শিকার।

সাত বছরের মধ্যে একদিনও ঝাউপাতা ঘাঁটিনি।
সাত বছরের মধ্যে একবারও নদীকে বলি নি
যেখানে মুকুট জ্বলছে, সেইব্রিস্টলজে নিয়ে চলো।
সাত বছরের মধ্যে গোটাদুই রাজার বাড়ির
খানসামার মোটা মাইনে কলাপাতাশুদ্ধ ছুঁড়ে দিয়ে
নিজের গহ্বরে ধসে নিমগ্ন ও একমাত্র ধ্যান
আমার সৃষ্টিরা পাক তোমার যৌবন।

নন্দিনী-
রোমে, ভার্টিকানে
সিসটাইন চ্যাপেলের মাঝখানে মাইকেলেঞ্জোলোর
বিশ্ব নির্মাণের দিকে ঘাড় উঁচু করে
পরে তাঁরই ‘পিয়েতা’-র মমতামূর্তির কাছে এসে
শুভঙ্কর, সত্যি বলছি তোমাকেই খুঁজেছি ভীষণ।
আমার চেয়েও জানি এই যাগযজ্ঞময় সৃষ্টির সান্নিধ্য ছিল
তোমারই একান্ত প্রয়োজন।

ফ্লোরেসে দান্তের স্টাচু, কী প্রার্থনা করেছি তা জানো?
তুমি যেন হতে পারো আধুনিক নরকের যোগ্য ভাষ্যকার।
সাত বছর আগে আমি ছিলাম তোমারই ঝাউপাতা,
কাগজের পলকা নৌকা, শিখিয়েছ অগম সাঁতার।
সাত বছর আগে তুমি নির্মাণ করেছ এই মাটির ঢেলাকে
তোমারই স্বপ্নের ছাঁচে, কখনো যা সাঁচীর যক্ষিণী
কখনো আবার যেন পিকাশোর প্রথা-ভাঙা নারী।

পরের ঘরনী আজ, আমার অমৃতকুম্ভে সমাজ-স্বীকৃত অধিকার
অন্য একজনের।
কিন্তু বৃন্তচ্যুত তুমি, রয়ে গেছ বুত্তরেখা জুড়ে।
তুমি যদি সত্যি সত্যি বারুদের ভ্রুণকণা নিয়ে
গঁগার মতন কোন স্বরচিত সৌরলোক গড়ে তুলতে পারো
আমি ঠিক ভিকটোরিয়া ওকাম্পোর মতো
দরজার বাইরেই পাপোষে নির্ঘুম রাত নিঃশব্দে কাটাব।

শুভঙ্কর-
প্রাচীন পদ্মের পাপড়ি এখনো অনবচ্ছিন্ন জানে
উম্মীলনশীলতার মানে?
সাত-সাতটা বছরেও এখনো সে কবেকার বোনা
কাশ্মিরী শালের কলকা সিন্দুকের ভিতরে অক্ষয়,
এই সৌভাগ্যের জন্যে নন্দিনী, কৃতজ্ঞ অভিশয়।