কথোপকথন ৬

নন্দিনী-
এমন বিমর্ষ কেন
যেন মেঘে ঢাকা?
বাজেটের প্রতিক্রিয়া নাকি?
ভারতবর্ষের চাকা ঘুরে যাচ্ছে খাদের ঢালুতে
তারই জন্যে ভাঙা ভূরু,
কপালে লাঙল-চাষা ক্ষেত?
আই. এম. এফের লোন আসলে তো সাতপাকের ফাঁস
কোন কোন বিয়ের মতন,
পরিণতি নেই
তবু প্রত্যাখ্যানে পাতার কাঁপুনি।
এসব না অন্য কিছু
কি ভাবছ বলবে না?

শুভঙ্কর-
কেবলি পিছনে হাঁটা
কেবলি ভাটার টানে এগোনোকে অস্বীকার করা
কাছের স্টেশনগুলো কেবলি হারিয়ে যাবে দূরের দুর্গমে
এই যেন ললাটের লেখা।
তুমুল ফরাস পেতে যদি হবে ভালুকের নাচ
শত শত যৌবনকে কেন তবে বলা হয়েছিল
নচিকেতা হও।
ফরাসী বিপ্লব এত রক্ত মাখল কেন?
কেন সোবিয়েত?
‘কুইট ইন্ডিয়া’ হেঁকে কেন এত বিপ্লবের তুবড়ি ফাটানো?
বিপ্লব শব্দটা আজ অ্যাকোয়ারিয়মে পচা মাছ।
যাকে জাগানিয়া-মন্ত্র মনে হয়েছিল
সাপুড়ে বাঁশির চেয়ে আজ আর বেশি কিছু নয়।

তুমি তো ইউরোপে ছিলে
মুহুর্মুহু ভাঙন দেখেছ।
এখন আমার পালা
অনর্গল পচনের পতনের সাক্ষী হতে হবে।

আমরা বা আমাদের কাল
রেমব্রান্টের ছবির মতোই।
যত আলো তার চেয়ে আঁধার অগাধ।

রেমব্রান্ট তো তোমার বহু দেখা।

নন্দিনী-
বহু না হলেও বেশ কিছু।
কিন্তু জানো, রেমব্রান্টের ছবি অত নিরাশ্বাস নয়।
বুদ্ধদের ঠিকই লিখেছেন
আঁধারই অধিকতর আলো।
ঠিক যেন জর্মান উডকাট,
কালোও আলোর অঙ্গীভূত।

বিলাসী রেমব্রান্ট তাঁর জীবনের শেষ পরিচ্ছেদে
নিতান্তই দীন ছন্নছাড়া
ফুটপাতের করুণ ভিখারি,
জীবনের শেষ ক’বছর
মাদিগিলিয়ানী ঠিক যে রকম ভাবে বেঁচেছিল

শুভঙ্কর-
ভ্যান গগ্ তো আজীবনই তাই।
কিংবা দ্যমিয়ের।
অপমানিতের ধুলো সর্বাঙ্গে মাখানো।

নন্দিনী-
কিন্তু একটা মজা কি দেখেছ?
ব্যক্তি আর রাষ্ট্রে কি তফাত?
রাষ্ট্রে যেই সংকটে বা নিজের জাঁতায় নিজে কাবু
মানুষের দিকে তার গিলোটিন দ্রুত নেমে আসে।
আর শিল্পী; সর্বস্বান্ত, তবু
মানুষেরই জন্যে গড়ে যায়
বসন্তপূর্ণিমা।

জীবনে মেশায় প্রকৃতিকে
প্রতিকৃতি জীবনে রাঙায়।
প্রতিকৃতি প্রতীকতা পেয়ে
ব্যক্তি থেকে নৈর্ব্যক্তিকে যায়।

মাটির সমস্ত ভঙ্গুরতা
জুড়ে দিয়ে গড়ে গোলাকার
আদিম কলস, প্রাত্যহিকে
সর্বক্ষণই যার ব্যবহার।

ভাঙে ঠিকই, কিন্তু তা গড়ারই
আরেক বিশুদ্ধ উম্মাদনা,
আর এক সংহতির খোঁজে,
প্রয়োজন ঐ ছিন্নকণা।

রঁদার টরসো যে রকম
প্রতিনিধি পূর্ণাবয়বেরই।
শিল্পী ভাঙে সম্পূর্ণতা চেয়ে,
সংকটেও তিনি শুদ্ধচারী।

শুভঙ্কর-
তুমি ঠিকই বলেছ নন্দিনী
শিল্পকলা আছে বলে সভ্যতার ভুল ওজনের
দাঁড়িপাল্লা এক দিকে ঝোঁকে না কখনো।
শেষ যুদ্ধে মনস্বিতা মালা পেয়ে যায়।