কথোপকথন ৭

শুভঙ্কর-
এত বছরের পরও পুরনো হল না ভালোবাসা।
তোমার চোখের ফ্রেমে আজো দেখি কবেকার নিকোনো উঠোনে
সূর্যমুখী নারীদের আলপনার প্রতীকী পিপাসা।
তোমার কি ঘুম নেই? নিরস্তর উম্মেষ কেবলই?
তুমিই কি জয়দেব চণ্ডীদাসের পদাবলী?

তোমাকে যখনই দেখি আলোকস্তম্ভের মতো লাগে।
কত সব অশ্বমেধ, কত সব অভ্যুত্থান পৃথিবীর ধুলোয় মাটিতে
স্বর্গের ঝিলিক দিয়ে হঠাৎ হারাল। তুমি আজো পুরোভাগে

স্পর্শ কি সোনার কাঠি? তাই চিরজীবিতের মতো
ভুলে যেতে পারি গায়ে চিরে-বসা সময়ের ক্ষত?

আরেক পৃথিবী যেন তার নীল সামিয়ানাসহ
আমাকে রয়েছে ঘিরে; এই বোধ, এ তোমারই অনুগ্রহে রচিত আবহ।

নন্দিনী-
ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে মিছে বানিও না দামী।
রাজেন্দ্ৰনন্দিনী নই, নই কোন অসামান্য আমি।
তবু কোন রত্নকণা কোনখানে যদি লেগে থাকে
সে আমার নয়, তুমি দিয়েছ আমাকে।

তোমারই ছিটানো জলে কুঁড়ি পেল পূর্ণাঙ্গ বিকাশ
ঘুমন্ত আমার জাগা ব্যাপ্ত করে দিয়েছ এমন
একমাত্র আকাশেরই সঙ্গে মেলে হিসাব-নিকাশ।
ভীরুতার শিকলের ঝন ঝন শব্দে হাঁটাহাঁটি
তুমি যদি না ঘোচাতে, ভবিষ্যৎ ষোলআনা মাটি।
আজ যে ডানায় উড়ি, সে স্বাধীনতার
প্রত্যেক পালক জানে কারুকাজ কার।

শুভঙ্কর-
অতীতের সেই সব দিন
তাহলে এখনো অমলিন?
স্মৃতিতে সোনালি হয়ে জ্বলে?
নৌকা ডুবে যায়নি অতলে?

মনে পড়ে? সব মনে পড়ে?
প্রথম আলাপ কোন ঝড়ে?
প্রথম চিঠির দ্বিধা ভয়,
প্রথম চুম্বনে বিশ্বজয়।
মনে পড়ে? সব মনে পড়ে?
আগুন ছড়াল শুকনো খড়ে।

নন্দিনী-
আমার বৈশাখে তোমার ঝড়
তোমার শ্রাবণেই ভিজল চুল।
ছোট্ট রেস্তোঁরা, অন্ধকার,
জোৎস্না বুনে যায় ক্ষ্যাপা আঙুল।

তোমার চিঠি পেলে রুদ্ধশ্বাস,
আঁচল হয়ে যায় পুজোর মেঘ।
দেখিনি পারিজাত, তবুও তার
গন্ধে ভুরভুর চাপা আবেগ।

সকাল গুনগুন ভৈরবীর
লুকনো সুরে সুরে। আর বিকেল,
সে যেন মালকোষ। ছুঁয়েছে যেই
দুঃসাহসই সোনা, বাকি নিকেল।

তখনি যমুনার বাঁশির ডাক
ময়লা শাড়ি ছেড়ে নতুন সাজ।
বৃন্দাবন সেই রেস্তোঁরা।
পৌছবই যত পড় ক বাজ।

শুভঙ্কর-
তখন সর্বাঙ্গময় ক্ষুধা
তুমি যেন অন্নের বসুধা।
ঐশ্বর্য সাজনে থরে থরে।
বহু অপহরণেরও পরে
যায় না জলের মতো ক্ষয়ে।
ভরা যাকে স্বর্ণখনি হয়ে।

গিনেসেয় ছাপানোর মতো
কৃপণতা যদিও বিখ্যাত।

নন্দিনী-
তুমি তো ক্ষুধায় গরুড়কে হার মানাতে।
হাজার খেয়েও শত অনাহার বানাতে।
আমরা, নারীরা, তোমাদের হ্যাঁ-এ হ্যাঁ দিলে
পৃথিবী কখন ডুবে যেত মহাসলিলে।

মশাই, একটু খিদে বাকি রেখে খাওয়া
সেটাই নিয়ম, খানিকটা ফাঁকা হাওয়া
দুটি ওষ্ঠের মাঝখানে যদি না থাকে
ভালোবাসা শুধু জানবে যান্ত্রিকতাকে।

শুভঙ্কর-
বাগানের মালি শুধু জানে
গাছ চায় কতখানি জল।
প্রত্যহ? না হপ্তায় হপ্তায়?
যৎসামান্য? নাকি অনর্গল?

শাল-পিয়ালের কেউ নই,
অশ্বত্থও নই, কিংবা বট।
গুল্ম আমি, তাই সারাক্ষণ
চেয়েছি উপুড় জল-ঘট।

দীঘি কি কখনো ফুরিয়েছে?
ফুরোয় তো গেলাসের জল।
অঙ্গে অঙ্গে সোনার কলস
তবুও তৃষ্ণার্ত রাখা ছল।

নন্দিনী-
সাত সাতটা বছরে একটু বদলাওনি তুমি। সত্যি

তোমাকে মনে পড়ে হুবহু সেই
নদীর মতো যার মোহানা নেই।
কেবলই জলরাশি, ঢেউয়ের নাচ
মাতাল ধ্বনি ভাঙে পাথুরে ছাঁচ।

অবাক লাগে তুমি কত না দিন
হুবহু রয়ে গেলে শ্যাওলাহীন।
যখনই কথা বললা, আগুনে তাপ।
জেগেছে তলোয়ার, বেঙেছে খাপ।

তোমার আশ্বিন এমনই নীল
নিমেষে একাকার সারা নিখিল।

শুভঙ্কর-
সিমেন্টের গুঁড়ো, সুরকি বালি,
এরা শুধু উপাদান। এদের ছুঁয়েছ তুমি যেই
মহিম ভাস্কর্য হয়ে উঠেছে তারাই।
এই হিসেবেরই মধ্যে রয়ে গেছে ব্যক্তি বিশেষের
একাধিক পাপড়ি খুলে একাধিকবার
জাগবার ইতিহাস। ক্রমউপাখ্যান উন্মেষের।