কথোপকথন ৮

শুভঙ্কর-
ঈস, ঘেমে গেছ
একটু হাওয়ায় বোসো, ঘাম মুছে নাও।

শুধু কি মানুষ?
যে সশস্ত্র, তার দম্ভে
ঋতুও বদলে যাচ্ছে ক্রমস্ফীত তাপমাত্রায়।
প্রকৃতির হাত থেকে খসে যাচ্ছে আত্মনিয়ন্ত্রণ।

তুমি কি এখন গ্রীষ্ম ছুঁয়েছ কখনো?
যেন জতুগৃহে,
যেন আগুনের হলকায় ঘেরাও।

নন্দিনী-
সত্যি, সত্যি, এ অসহ্য!
চামড়া তো পুড়ছেই
শরীরের ভিতরেও অগ্নিচুল্লি, ব্লাস্ট ফারনেস,
হাড়-মাস নিংড়িয়ে শুধু ঘাম ঝরিয়ে চলেছে
জীবনীশক্তিকে জীর্ণ করে।

শুভঙ্কর-
রণক্ষেত্র বদলে গেছে
জীবনীশক্তিই আজ রাজকীয় মৃগয়ার শেষতম হরিণশাবক।
জীবনের খাপ থেকে জীবনীশক্তিকে
তার মানে চিন্তার শক্তিকে
বলবার, লিখবার, গড়বার স্বাধীন প্রয়াস
ছিন্ন করে নিতে পারলে।
প্রতিষ্ঠান বুঝে যাবে- নিরাপত্তা লোহার বাসর।
যাতে ছিন্ন করা যায়
তারই জন্যে যন্ত্র, মন্ত্র, রঙীন কাগজ
স্যাটেলাইটের থেকে মানুষের ঘরে ঘরে
ঘুমের বড়ির বিতরণ।

নন্দিনী-
খুব বাজে রোগ।
যে কোন কথাকে টেনে
সভ্যতার সংকটে মেলানো।

পৃথিবীর কথা ভুলে
আমরা দুদণ্ড যদি নিজেদের কথা নিয়ে আবীর ওড়াই
কোন তলোয়ার এসে থামবে তা শুনি?
আগে তুমি এমন ছিলে না।
রাশি রাশি গদ্য লিখে
আজকাল তাত্ত্বিক হয়েছ।

শুভঙ্কর-
পোড়া চুরুটের মতো সূর্য রোজ কালো হয়ে যায়।

যুক্তিও যথেষ্ট নয়
ভাঙচুর দুর্বোধ্য এমন।
সাইক্লোনের, টাইফুনের, ভলক্যানিক ইরাপশনের
ব্যাখ্যা আছে, কৈফিয়ৎ আছে।
কিন্তু এ কী ক্ষয়!

যে দুর্গ অপরাজেয় চিরকাল জেনেছি বিশ্বাসে
তারই ছারখার চিহ্নে
বাতাস বিবর্ণ হয়ে গেল।

যেন নাভীমূল থেকে কোন এক গোঁয়ার আক্রোশ
উপড়ে ছিড়ে নিতে চায় শেষ কৌটোটিও
যার মধ্যে মানচিত্র মহাজীবনের।

কেন এ রকম হল ভাববো না কেউ?
অনুষ্টুপের শেষ সংখ্যাটা পড়েছ?
পড়ে ভয় করে নি তোমার?
কনজুমারিজম! তার হাঁ-খানা কি বিরাট দেখেছ?

নন্দিনী-
ইউরোপেই তো ছিলাম, যখন ভাঙল
তাসের দেশ, সোনার চালচিত্র।
সূর্য থেকে ঘুরিয়ে দিল চাউনি
উল্কা হল দুঃখরাতের মিত্র।

যেদিকে যাবে ভাঙন আর ভাসান
বিসর্জনই বাজছে অহোরাত্র
শুনতে শুনতে নিজেকে মনে হয়
অলীক কোন ধ্বংস-ছায়া মাত্র।

তোমার কাছে আসি তো ঐসব
পেরিয়ে পেতে ভিন্ন বৈভব।

শুভঙ্কর-
বেশ
সভ্যতাকে দিলাম জলাঞ্জলি
অন্য কথা হউক বলাবলি।

রাঁধুনি আছে? রান্না করে কে?
আজ কি মাছের কোর্মা হয়েছে?
মায়ের হাতের শুক্তো যদি খেতে
বুঝতে জিভ ছুঁয়েছে অমৃতে।

নন্দিনী-
ভীষণ পাজি, বড্ড ফাজিল ছেলে
সেই ইয়ার্কি যেই না ছুতো পেলে!
গভীর কিছু বলার নেই বুঝি?
তোমার চোখে বল তো কাকে খুঁজি?

শুভঙ্কর-
চোখ আর খোঁজা বললে মনে পড়ে যায় এলুয়ার।
তুমি তো পড়েছ মূল ফরাসীতে, তাই না? আমার
খানিকটা ইংরেজিতে, বাকি বিষ্ণু দে-র অনুবাদে।
এলুয়ার বললেই বুক ভরে যার সুস্বাসে।
সেই সদ্য-যৌবনের আগুনে-শিখার মতো দিনে
যে নারী নক্ষত্রে আছে, তাকেই কল্পনা দিয়ে চিনে
স্বপ্নের রণ-পায়ে হাঁটা আকাক্ষার সর্বোচ্চ শিখরে।
বিশ্বাস অগাধ, তাকে প্রশ্ন কুরে খাবে বা কি করে?

নন্দিনী-
নক্ষত্রের নারী শেষে নেমে
এল চরিতার্থতার চৌকো কোন ফ্রেমে?

শুভঙ্কর-
শুধু এল?
নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ হয়ে কাছে এল।

সেদিন সে এক নারীর স্বর
সেখানে পশিল প্রাণের পর
যেমনে পশিল কামনার দ্বীপে কামানের কলরোল
জানি না কি করে গা-পোড়ানো জ্বরে রক্তে নাচের দোল।

নন্দিনী-
সত্যি! পারে বটে!
দুর্বুদ্ধি গিজগিজ করছে ঘটে।
এবার থামো তো।

শুভঙ্কর-
তোমারই তো স্তবগাথা, শ্ৰীমতী।
একটু শুনলে আর কী ক্ষতি?
থর থর করি কাঁপিছে ভুবন
যেন সাইক্লোন ক্ষেপেছে খুব।
নদী উথলিয়ে হয়েছে সাগর
ভাঙা জনপদ দিতেছে ডুব।

হেথায় হোথায় পাগলের মতো
দেখিয়ে বেড়াই ক্ষত-বিক্ষত
হৃদয়ের যত ব্যথা-ব্রিত উদাত হাহাকার।

কেন রে বিধাতা, কিসে তোর কোপ।
চারিদিকে এত কেন ঘেরাটোপ
ভাঙরে হৃদয় ভাঙরে শিকল
পোড়া সমাজকে করে দে বিকল
স্টেনগানসম আওয়াজ তুলিয়া
আঘাতের পর আঘাতের হান।
মাতাল যখন হয়েছে চিত্ত
তখনও থাকবি মধ্যবিত্ত?
বাসনা যখন বাসুকীল ফণা
বিশ্বকে তোর বাহুতে টান!

নন্দিনী-
এতটাই যখন হয়ে গেল বলা
তাহলে আমিও মেলাই গলা।

আমি ঢালিব ঝর্ণা জল।

শুভঙ্কর-
আমি বাজাব মেঘে মাদল

নন্দিনী-
আমি বিশ্বজনকে জানিয়ে বেড়াব কে করেছে শতদল।

শুভঙ্কর-
পতাকা উড়িয়ে পাথর গুঁড়িয়ে

নন্দিনী-
জীর্ণ আবর্জনাকে পুড়িয়ে

শুভঙ্কর-
জঙ্গল থেকে জড়তা কুড়িয়ে অগ্নিযজ্ঞে ঢালি।

নন্দিনী-
হয়তো ছিঁড়বে নৌকার পাল, বর্ষার শেষে বসন্তকাল,

শুভঙ্কর-
বিশ্বে বাজবে দুটি হৃদয়ের অফুরান করতালি।