বিদেশী ফুলের গুচ্ছ

(SHELLEY)


মধুর সূর্যের আলো, আকাশ বিমল,
সঘনে উঠিছে নাচি তরঙ্গ উজ্জ্বল।
মধ্যাহ্নের স্বচ্ছ করে
সাজিয়াছে থরে থরে
ক্ষুদ্র নীল দ্বীপগুলি, শুভ্র-শৈল-শির;
কাননে কুঁড়িরে ঘিরি,
পড়িতেছে ধীরি ধীরি
পৃথিবীর অতি মৃদু নিশ্বাস সমীর।
একই আনন্দে যেন গায় শত প্রাণ;
বাতাসের গান আর পাখীদের গান,
সাগরের জলরব
পাখীদের কলরব
এসেছে কোমল হয়ে স্তব্ধতার সংগীত-সমান।


আমি দেখিতেছি চেয়ে সমুদ্রের জলে
শৈবাল বিচিত্রবর্ণ ভাসে দলে দলে।
আমি দেখিতেছি চেয়ে
উপকূল-পানে ধেয়ে
মুঠি মুঠি তারাবৃষ্টি করে ঢেউগুলি!
বিরলে বালুকাতীরে
একা বসে রয়েছি রে,
চারি দিকে চমকিছে জলের বিজুলি!
তালে তালে ঢেউগুলি করিছে উত্থান,
তাই হতে উঠিতেছে কী একটি তান!
মধুর ভাবের ভরে
হৃদয় কেমন করে,
আমার সে ভাব আজি বুঝিবে কি আর কোনো প্রাণ।


হায় মোর নাই আশা, নাইকো আরাম,
ভিতরে নাইকো শান্তি, বাহিরে বিরাম।
নাই সে সন্তোষ ধন-
জ্ঞানী ঋষি যোগীগণ,
ধ্যানসাধনায় যাহা পায় করতলে;
আনন্দ মগন মন
করে তারা বিচরণ
বিমল মহিমালোক অন্তরেতে জ্বলে।
নাই যশ, নাই প্রেম, নাই অবসর;
পূর্ণ করে আছে এরা সকলেরি ঘর,
সুখে তারা হাসে খেলে,
সুখের জীবন বলে-
আমার কপালে বিধি লিখিয়াছে আরেক অক্ষর।


কিন্তু নিরাশাও শান্ত হয়েছে এমন,
যেমন বাতাস এই, সলিল যেমন।
মনে হয় মাথা থুয়ে
এইখানে থাকি শুয়ে
অতিশয় শ্রান্তকায় শিশুটির মতো,
কাঁদিয়া দুঃখের প্রাণ
করে দিই অবসান,
যে দুঃখ বহিতে হবে, বহিয়াছি কত!
আসিবে ঘুমের মতো মরণের কোল,
ধীরে ধীরে হিম হয়ে আসিবে কপোল।
মুমূর্ষু শ্রবণতলে
মিশাইবে পলে পলে
সাগরের অবিরাম একতান অন্তিম কল্লোল!
______________

(MRS. BROWNING.)

সারাদিন গিয়েছিনু বনে
ফুলগুলি তুলেছি যতনে।
প্রাতে মধুপানে রত
মুগ্ধ মধুপের মতো
গান গাহিয়াছি আনমনে!

এখন চাহিয়া দেখি, হায়,
ফুলগুলি শুকায় শুকায়!
যত চাপিলাম মুঠি
পাপড়িগুলি গেল টুটি,
কান্না ওঠে, গান থেমে যায়।

কী বলিছ সখা হে আমার,
ফুল নিতে যাব কি আবার!
থাক্‌ বঁধু, থাক্‌ থাক্‌,
আর কেহ যায় যাক,
আমি তো যাব না কভু আর!

শ্রান্ত এ হৃদয় অতি দীন,
পরান হয়েছে বলহীন।
ফুলগুলি মুঠা ভরি
মুঠায় রহিবে মরি,
আমি না মরিব যত দিন!
______________

(ERNEST MYERS.)

আমায় রেখ না ধ’রে আর,
আর হেথা ফুল নাহি ফুটে।
হেমন্তের পড়িছে নীহার,
আমায় রেখো না ধ’রে আর।
যাই হেথা হতে যাই উঠে,
আমার স্বপন গেছে টুটে!
কঠিন পাষাণপথে
যেতে হবে কোনোমতে
পা দিয়েছি যবে!
এক্‌টি বসন্তরাতে
ছিলে তুমি মোর সাথে,
পোহালো ত, চলে যাও তবে!
______________

(ERNEST MYERS.)

প্রভাতে একটি দীর্ঘশ্বাস;
একটি বিরল অশ্রুবারি
ধীরে ওঠে, ধীরে ঝ’রে যায়,
শুনিলে তোমার নাম আজ।
কেবল এক্‌টুখানি লাজ-
এই শুধু বাকি আছে হায়!
আর সব পেয়েছে বিনাশ!
এক কালে ছিল যে আমারি
গেছে আজ করি পরিহাস!
______________

(AUGUSTA WEBSTER.)

-গোলাপ হাসিয়া বলে, “আগে বৃষ্টি যাক্‌ চ’লে,
দিক্‌ দেখা তরুণ তপন-
তখন ফুটাব এ যৌবন।”
গেল মেঘ, এল উষা, আকাশের আঁখি হতে
মুছে দিল বৃষ্টিবারিকণা-
সেত রহিল না!

কোকিল ভাবিছে মনে, “শীত যাবে কতক্ষণে,
গাছপালা ছাইবে মুকুলে,
তখন গাহিব মন খুলে!”
কুয়াশা কাটিয়া যায়- বসন্ত হাসিয়া চায়,
কানন কুসুমে ভ’রে গেল।
সে যে ম’রে গেল!
______________

(IBID.)

এত শীঘ্র ফুটিলি কেনরে!
ফুটিলে পড়িতে হয় ঝ’রে;
মুকুলের দিন আছে তবু,
ফোটা ফুল ফোটে না তো আর!
বড়ো শীঘ্র গেলি মধুমাস,
দুদিনেই ফুরালো নিশ্বাস!
বসন্ত আবার আসে বটে,
গেল যে সে ফেরে না আবার!
______________

(P. B. MARSTON.)

হাসির সময় বড়ো নেই,
দুদণ্ডের তরে গান গাওয়া;
নিমেষের মাঝে চুম খেয়ে
মুহূর্তে ফুরাবে চুমো খাওয়া!
বেলা নাই শেষ করিবারে
অসম্পূর্ণ প্রেমের মন্ত্রণা;
সুখস্বপ্ন পলকে ফুরায়,
তার পরে জাগ্রত যন্ত্রণা!
কিছুক্ষণ কথা ক’য়ে লও,
তাড়াতাড়ি দেখে লও মুখ;
দুদণ্ডের খোঁজ দেখাশুনা,
ফুরাইবে খুঁজিবার সুখ।
বেলা নাই কথা কহিবারে
যে কথা কহিতে ফাটে প্রাণ।
দেবতারে দুটো কথা বলে
পূজার সময় অবসান।
কাঁদিতে রয়েছে দীর্ঘদিন,
জীবন করিতে মরুময়,
ভাবিতে রয়েছে চিরকাল,
ঘুমাইতে অনন্ত সময়!
______________

(VICTOR HUGO.)

বেঁচেছিল, হেসে হেসে
খেলা ক’রে বেড়াত সে,
হে প্রকৃতি, তারে নিয়ে কী হ’ল’ তোমার!
শত রঙ,,-করা পাখী
তোর কাছে ছিল নাকি!
কত তারা, বন, সিন্ধু, আকাশ অপার!
জননীর কোল হতে কেন তবে কেড়ে নিলি!
লুকায়ে ধরার কোলে ফুল দিয়ে ঢেকে দিলি!
শত-তারা-পুষ্পময়ি!
মহতী প্রকৃতি অয়ি,
না-হয় একটি শিশু নিলি চুরি ক’রে-
অসীম ঐশ্বর্য তব
তাহে কি বাড়িল নব!
নূতন আনন্দকণা মিলিল কি ওরে?
অথচ তোমারি মতো বিশাল মায়ের হিয়া,
সব শূন্য হয়ে গেল একটি সে শিশু গিয়া!
______________

(MOORE.)

নিদাঘের শেষ গোলাপ কুসুম
একা বন আলো করিয়া;
রূপসী তাহার সহচরীগণ
শুকায়ে পড়েছে ঝরিয়া।
একাকিনী আহা, চারি দিকে তার
কোনো ফুল নাহি বিকাশে,
হাসিতে তাহার মিশাইতে হাসি
নিশাস তাহার নিশাসে।

বোঁটার উপরে শুকাইতে তোরে
রাখিব না একা ফেলিয়া,
সবাই ঘুমায়, তুইও ঘুমা’গে’
তাহাদের সাথে মিলিয়া।
ছড়ায়ে দিলাম দলগুলি তোর
কুসুম-সমাধি-শয়নে,
যেথা তোর বন-সখীরা সবাই
ঘুমায় মুদিত নয়নে।
তেমনি আমার সখারা যখন
যেতেছেন মোরে ফেলিয়া
প্রেমহার হতে একটি একটি
রতন পড়িছে খুলিয়া,
প্রণয়ীহৃদয় গেল গো শুকায়ে
প্রিয়জন গেল চলিয়া-
তবে এ আঁধার আঁধার জগতে
রহিব বলো কী বলিয়া!
______________

(MRS. BROWNING.)

ওই আদরের নামে ডেকো সখা মোরে!
ছেলেবেলা ওই নামে আমায় ডাকিত,
তাড়াতাড়ি খেলাধূলা সব ত্যাগ করে
অমনি যেতেম ছুটে,
কোলে পড়িতাম লুটে,
রাশি-করা ফুলগুলি পড়িয়া থাকিত।
নীরব হইয়া গেছে যে স্নেহের স্বর,
কেবল স্তব্ধতা বাজে
আজি এ শ্মশান মাঝে,
কেবল ডাকি গো আমি ঈশ্বর- ঈশ্বর-।
মৃত কণ্ঠে আর যাহা শুনিতে না পাই,
সে নাম তোমারি মুখে শুনিবারে চাই।
হাঁ সখা, ডাকিয়ো তুমি সেই নাম ধোরে,
ডাকিলেই সাড়া পাবে,
কিছু না বিলম্ব হবে,
তখনি কাছেতে যাব সব ত্যাগ কোরে!
______________

(CHRISTINA ROSSETTI.)

কেমনে কী হল পারি নে বলিতে,
এইটুকু শুধু জানি-
নবীন কিরণে ভাসিছে সে দিন
প্রভাতের তনুখানি।
বসন্ত তখনো কিশোর কুমার,
কুঁড়ি উঠে নাই ফুটি,
শাখায় শাখায় বিহগ বিহগী
বসে আছে দুটি দুটি।

কী যে হয়ে গেল পারি নে বলিতে,
এইটুকু শুধু জানি-
বসন্তও গেল, তা’ও চলে গেল
একটি না কয়ে বাণী।
যা-কিছু মধুর সব ফুরাইল,
সেও হল অবসান-
আমারেই শুধু ফেলে রেখে গেল
সুখহীন ম্রিয়মাণ!
______________

(SWINBURNE.)

রবির কিরণ হতে আড়াল করিয়া রেখে
মনটি আমার আমি গোলাপে রাখিনু ঢেকে;
সে বিছানা সুকোমল, বিমল নীহার চেয়ে,
তারি মাঝে মনখানি রাখিলাম লুকাইয়ে!
একটি ফুল না নড়ে, একটি পাতা না পড়ে,
তবু কেন ঘুমায় না, চমকি চমকি চায়?
ঘুম কেন পাখা নেড়ে উড়িয়ে পালিয়ে যায়?
আর কিছু নয়, শুধু গোপনে একটি পাখী
কোথা হতে মাঝে মাঝে উঠিতেছে ডাকি ডাকি!

ঘুমা তুই, ওই দেখ্‌ বাতাস মুদেছে পাখা,
রবির কিরণ হতে পাতায় আছিস্‌ ঢাকা;
ঘুমা তুই, ওই দেখ্‌, তো চেয়ে দুরন্ত বায়
ঘুমেতে সাগর- ‘পরে ঢুলে পড়ে পায় পায়;
দুখের কাঁটায় কিরে বিঁধিতেছে কলেবর?
বিষাদের বিষদাঁতে করিছে কি জরজর?
কেন তবে ঘুম তোর ছাড়িয়া গিয়াছে আঁখি?
কে জানে, গোপনে কোথা ডাকিছে একটি পাখী।

শ্যামল কানন এই মোহমন্ত্রজালে ঢাকা,
অমৃতমধুর ফল ভরিয়ে রয়েছে শাখা;
স্বপনের পাখীগুলি চঞ্চল ডানাটি তুলি
উড়িয়া চলিয়া যায় আঁধার প্রান্তর ‘পরে;
গাছের শিখর হতে ঘুমের সংগীত ঝরে।
নিভৃত কানন- ‘পর শুনি না ব্যাধের স্বর
তবে কেন এ হরিণী চমকায় থাকি থাকি!
কে জানে, গোপনে কোথা ডাকিছে একটি পাখী।
______________

(CHRISTINA ROSSETTI.)

দেখিনু যে এক আশার স্বপন
শুধু তা স্বপন, স্বপনময়,
স্বপন বই সে কিছুই নয়!
অবশ হৃদয় অবসাদময়
হারাইয়া সুখ শ্রান্ত অতিশয়-
আজিকে উঠিনু জাগি
কেবল একটি স্বপন লাগি!

বীণাটি আমার নীরব হইয়া
গেছে গীতগান ভূলি,
ছিঁড়িয়া টুটিয়া ফেলেছি তাহার
একে একে তারগুলি।
নীরব হইয়া রয়েছে পড়িয়া
সুদূর শ্মশান ‘পরে,
কেবল একটি স্বপন-তরে!

থাম্‌ থাম্‌ ওরে হৃদয় আমার,
থাম্‌ থাম্‌ একেবারে,
নিতান্তই যদি টুটিয়া পড়িবি
একেবারে ভেঙে যা’রে-
এই তোর কাছে মাগি!
আমার জগৎ, আমার হৃদয়
আগে যাহা ছিল এখন্‌ তা নয়
কেবল একটি স্বপন লাগি!
______________

(HOOD)

নহে নহে, এ মনে মরণ!
সহসা এ প্রাণপূর্ণ নিশ্বাস বাতাস
নীরবে করে যে পলায়ন,
আলোতে ফুটায় আলো এই আঁখিতারা
নিবে যায় একদা নিশীথে,
বহে না রুধির নদী,- সুকোমল তনু
ধূলায় মিলায় ধরণীতে,
ভাবনা মিলায় শূন্যে, মৃত্তিকার তলে
রুদ্ধ হয় অময় হৃদয়-
এই মৃত্যু? এ তো মৃত্যু নয়।
কিন্তু রে পবিত্র শোক যায় না যে দিন
পিরিতির স্মিরিতি মন্দিরে,
উপেক্ষিত অতীতের সমাধির ‘পরে
তৃণরাজি দোলে ধীরে ধীরে।
মরণ-অতীত চির-নূতন পরান
স্মরণে করে না বিচরণ,
সেই বটে সেই তো মরণ!
______________