হৃদয়ের গীতিধ্বনি

ওকি স্বরে গান গাস্ হৃদয় আমার?
শীত নাই, গ্রীষ্ম নাই, বসন্ত, শরত নাই,
দিন নাই, রাত্রি নাই-
অবিরাম, অনিবার-
ওকি সুরে গান গাস্ হৃদয় আমার?
বিরলে বিজন বনে- বসিয়া আপন মনে
ভূমি পানে চেয়ে চেয়ে, এক্-ই গান গেয়ে গেয়ে-
এক্-ই গান গেয়ে গেয়ে
দিন যায়, রাত যায়,
শীত যায়, গ্রীষ্ম যায়,
তবু গান ফুরায় না আর!
মাথায় পড়িছে পাতা, পড়িছে শুকান’ ফুল।
পড়িছে শিশির কণা, পড়িছে রবির কর-
পড়িছে বরষা জল, ঝরঝর ঝরঝর-
কেবলি মাথার পরে, করিতেছে সমস্বরে
বাতাসে শুকান’ পাতা, মরমর মরমর;
বসিয়া বসিয়া সেথা, বিশীর্ণ মলিন প্রাণ
গাহিতেছে এক্-ই গান, এক্-ই গান, এক্-ই গান।

পারিনে শুনিতে আর, এক্-ই গান, এক্-ই গান।
কখন থামিবি তুই, বল্ মোরে -বল্ প্রাণ!
একেলা ঘুমায়ে আছি-
সহসা স্বপন টুটি,
সহসা জাগিয়া উঠি,
সহসা শুনিতে পাই-
হৃদয়ের এক ধারে –
সেই স্বর ফুটিতেছে –
সেই গান উঠিতেছে-
কেহ শুনিছেনা যবে
চারিদিকে স্তব্ধ সবে
সেই স্বর, সেই গান- অবিরাম অবিশ্রাম
অচেতন আঁধারের শিরে শিরে চেতনা সঞ্চারে।

দিবসে মগন কাজে, চারিদিকে দলবল।
চারিদিকে কোলাহল।
সহসা পাতিলে কান, শুনিতে পাই সে গান;
নানা শব্দ ময় সেই জন-কোলাহল
তাহারি প্রাণের মাঝে, এক মাত্র শব্দ বাজে,
এক সুর, এক ধ্বনি, অবিরল- অবিরল-
যেন সে কোলাহলের হৃদয়-স্পন্দন-ধ্বনি-
সমস্ত ভূলিয়া যাই, ব’সে ব’সে তাই গণি!

ঘুমাই বা জেগে থাকি, মনের দ্বারের কাছে
কে যেন বিষণ্ন প্রাণী দিনরাত বসে আছে-
চির দিন করিতেছে বাস,
তারি শুনিতেছি যেন নিশ্বাস প্রশ্বাস।
এ প্রাণের ভাঙ্গা-ভিতে স্তব্ধ দ্বিপ্রহরে,
ঘুঘু এক বসে বসে গায় এক স্বরে,
কে জানে কেন সে গান গায়!
গলি সে কাতর স্বরে
স্তব্ধতা কাঁদিয়া মরে,
প্রতিধ্বনি করে হায় হায়।

পারিনে শুনিতে আর, এক্-ই গান, এক্-ই গান
কখন্ থামিবি তুই- বল্ মোরে- বল্ প্রাণ।
হরষের গান আমি গাহিবারে চাহি যত,
তোর এ বিষন্ন সুর শ্রবণেতে পশে তত-
যে সুরে আরম্ভ করি শেষ নাহি হয় তায়
তোমারি সুরের সাথে অলক্ষ্যে মিলিয়া যায়!

হৃদয়রে! আর কিছু শিখিলিনে তুই,
শুধু ওই গান!
প্রকৃতির শত শত রাগিণীর মাঝে
শুধু ওই তান!

কি গাহিবে আর!
এক আশা, এক সুখ- এক ছিল যার
সেই এক হারায়েছে তার-
কি গাহিবে আর!
এক গান গেয়ে শুধু সমস্ত জগতে ফেরে
“যে এক গিয়েছে মোর তাই ফিরাইয়া দেরে!
আর কিছু চাহিনেরে!”
ভ্রমিতেছে শুধাইয়া সারা জগতের কাছে-
“যে এক আছিল মোর- সে মোর কোথায় আছে।”
বিধাতার কাছে শুধু এক ভিক্ষা মাগিতেছে-
দিন নাই, রাত্রি নাই, এক ভিক্ষা মাগিতেছে-
“দাও গো ফিরায়ে মোরে, যে এক হারায়ে গেছে!”
তাই এক গান গাহে একেলা বসিয়া
অবিরাম- অনিবার-
কি গাহিবে আর!

তোর গান শুনিবে না কেহ!
নাই বা শুনিল!
তোর গানে কাঁদিবেনা কেহ!
নাই বা কাঁদিল!

তবে থাম্-থাম্ ওরে প্রাণ,
পারিনে শুনিতে আর-এক্-ই গান-এক্-ই গান