শেষপর্ব

যেথা দূর যৌবনের প্রান্তসীমা
সেথা হতে শেষ অরুণিমা
শীর্ণপ্রায়
আজি দেখা যায়।

সেথা হতে ভেসে আসে
চৈত্রদিবসে দীর্ঘশ্বাসে
অস্ফুট মর্মর
কোকিলের ক্লান্ত স্বর,
ক্ষীণস্রোত তটিনীর অলস কল্লোল-
রক্তে লাগে মৃদুমন্দ দোল।

এ আবেশ মুক্ত হোক;
ঘোর-ভাঙা চোখ
শুভ্র সুস্পষ্টের মাঝে জাগিয়া উঠুক।
রঙ-করা দুঃখ সুখ
সন্ধ্যার মেঘের মতো যাক সরে
আপনারে পরিহাস করে।

মুছে যাক সেই ছবি- চেয়ে থাকা পথপানে,
কথা কানে কানে,
মৌনমুখে হাতে হাত ধরা,
রজনীগন্ধায় সাজি ভরা,
চোখে চোখে চাওয়া,
দুরুদুরু বক্ষ নিয়ে আসা আর যাওয়া।

যে খেলা আপনা-সাথে সকালে বিকালে
ছায়া-অন্তরালে,
সে খেলার ঘর হতে
হল আসিবার বেলা বাহির-আলোতে।
ভাঙিব মনের বেড়া কুসুমিত-কাঁটালতা ঘেরা
যেথা স্বপনেরা
মধুগন্ধে মরে ঘুরে ঘুরে
গুণ্ গুণ্ সুরে।
নেব আমি বিপুল বৃহৎ
আদিম প্রাণের দেশ- তেপান্তর মাঠের সে পথ
সাত সমুদ্রের তটে তটে
যেখানে ঘটনা ঘটে,
নাই তার দায়,
যেতে যেতে দেখা যায়, শোনা যায়,
দিনরাত্রি যায় চলে
নানা ছন্দে নানা কলরোলে।

থাক্ মোর তরে
আপক্ক ধানের খেত অঘ্রানের দীপ্ত দ্বিপ্রহরে;
সোনার তরঙ্গদোলে
মুগ্ধ দৃষ্টি যার ‘পরে ভেসে যায় চলে
কথাহীন ব্যথাহীন চিন্তাহীন সৃষ্টির সাগরে,
যেথায় অদৃশ্য সাথি লীলাভরে
সারাদিন ভাষায় প্রহর যত
খেলার নৌকার মতো।

দূরে চেয়ে রব আমি স্থির
ধরণীর
বিস্তীর্ণ বক্ষের কাছে
যেথা শাল গাছে
সহস্র বর্ষের প্রাণ সমাহিত রয়েছে নীরবে
নিস্তব্ধ গৌরবে।
কেটে যাক আপনা-ভোলানো মোহ,
কেটে যাক আপনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ,
প্রতি বৎসরের আয়ুকর্তব্যের আবর্জনাভার
না করুক স্তূপাকার-
নির্ভাবনা তর্কহীন শাস্ত্রহীন পথ বেয়ে বেয়ে
যাই চলে অর্থহীন গান গেয়ে।

প্রাণে আর চেতনায় এক হয়ে ক্রমে
অনায়াসে মিলে যাব মৃত্যুমহাসাগরসংগমে,
আলো অঁধধারের দ্বন্দ্ব হয়ে ক্ষীণ
গোধূলি নিঃশব্দ রাত্রে যেমন অতলে হয় লীন।

জোড়াসাঁকো
৫ এপ্রিল ১৯৩৪

[চার-সংখ্যক কবিতা তুলনীয়]