গঙ্গাহৃদি-বঙ্গভূমি

ধ্যানে তোমার রূপ দেখি গো স্বপ্নে তোমার চরণ চুমি,
মূর্তিমন্ত মায়ের স্নেহ! গঙ্গাহৃদি-বঙ্গভূমি!
তুমি জগৎ-ধাত্রী-রূপা পালন কর পীযুষ দানে,
মমতা তোর মেদুল হ’ল মধুর হ’ল নবীন ধানে।
পদ্ম তোমার পায়ের অঙ্ক ছড়িয়ে আছে জলে স্থলে,
কেয়াফুলের স্নিগ্ধ।গন্ধ- নিশাস সে তোর,- হৃদয় বলে।
সাগরে তোর শঙ্খ বাজে- শুনতে যে পাই রাত্রি দিবা,
হিমাচলের তুষার চিরে চক্ৰ তোমার চল্ছে কিবা!
দেখ্ছি গো রাজরাজেশ্বরী মূৰ্ত্তি তোমার প্রাণের মাঝে,
বিদ্যুতে তোর খঙ্গ জ্বলে বজে তোমার ডঙ্কা বাজে।

অন্নদা তুই অন্ন দিতে পিছ্-পা নহিস্ বৈরীকে,
গৌরী তুমি- তৈরী তুমি গিরিরাজের গৈরিকে!
লক্ষ্মী তুমি জন্ম নিলে বঙ্গসাগর-মন্থনে,
পারিজাতের ফুল তুমি গো ফুট্লে ভারত-নন্দনে;
চন্দনে তোর অঙ্গ-পরশ, হরষ নদী-কল্লোলে,
শ্রাবণ-মেঘে পবন-বেগে তোমার কালো কেশ দোলে।
শিবানী তুই তুই করালী আলেয়া তোর খর্পরে!
শত্রু-ভীতি জ্বলছে চিতা, তুলছে ফণা সর্প রে!
বাঘিনী তুই বাঘ-বাহিনী গলায় নাগের পৈতা তোর,
চক্ষু জ্বলে- বাড়ব-কুণ্ড- বহ্নি প্রলয়-স্বপ্ন-ভোর;
অভয়া তুই ভয়ঙ্করী, কালো গো তুই আলোর নীড়,
ভূগর্ভে তোর গর্জে কামান টনক নড়ে নাগপতির,
ভৈরবী তুই সুন্দরী তুই কান্তিমতী রাজরাণী,
তুই গো ভীমা, তুই গো শ্যামা অন্তরে তোর রাজধানী!

* * * *

ভাঁটফুলে তোর আগুন ঝটায়, জল-ছড়া দেয় বকুল তায়,
ভাট-শালিকে বন্দনা গায়, নকীব হেঁকে চাতক ধায়,
নাগ-কেশরে চামর করে, কোয়েল তোষে সঙ্গীতে,
অভিষেকের বারি ঝরে নিত্য চের-পুঞ্জিতে।
তোমার চেলী বুনবে ব’লে প্রজাপতি হয় তাঁতী,
বিনি-পশুর পশম তোমায় জোগায় কাপাস দিন রাতি,
পর-গাছা ওই মল্লি-আলী বিনি-সূতার হার গাঁথে,
অশথ-বট আর ছাতিম-পাতার ছায়ায় ছাতা তোর মাথে।
তুই যে মহালক্ষ্মীরূপা, তুই যে মণি-কুণ্ডলা,
ইভ-রদে কবরী তোর ছন্ন কানন-কুন্তলা!
ভাণ্ডারে তোর নাইক চাবী, বাইরে সোনা তোর যত,-
মাটিতে তোর সোনা ফলে, কে আছে বল্ তোর মত?
তোর সোনা সুবর্ণরেখার রেখায় রেখায় থিতিয়ে রয়,
ছুটবে কে পারস্য সাগর? মুক্তা সে তোর ঝিলেই হয়;
ঝিলে তোমার মুক্তা ফলে, জলায় ফুলের জল্সা রোজ,
তোমার বিলে মাছরাঙা আর মাণিক-জোড়ের নিত্য ভোজ।
তুঁষের ভিতর পীযুষ তোমার জম্ছে দানা বাঁধছে গো,
গাছের আগায় জল-রুটি তোর পথিকজনে সাধছে গো!
ধুপ-ছায়া তোর চেলীর আঁচল বুকে পিঠে দিছিস্ বেড়,
গগন-নীলে ভিড়ায় ডানা সান্ত্রী তোমার গগন-ভেড়।
গলায় তোমার সাতনরী হার মুক্তাঝুরির শতেক ভোর;
ব্ৰহ্মপুত্র বুকের নাড়ী, প্রাণের নাড়ী গঙ্গা তোর।
কিরীট তোমার বিরাট হীরা হিমালয়ের জিম্মাতে,-
তোর কোহিনুর কাড়বে কে বল? মাগাল না পায় কেউ হাতে।
তিস্তা তোমার ঝাপ্টা সীঁথি- যে দেখেছে সেই জানে,
ডান কানে তোর বাঁকার ঝিলিক্ কর্ণফুলী বাম কানে।
বিশ্ব-বাণীর মৌচাকে তোর চুয়ায় যশের মাক্ষি’ গো,-
দূর অতীতের কবির গীতি তোর সুদিনের সাক্ষী গো।
নানান্ ভাষা পূর্ণ আজো, বঙ্গ! তোমার গৌরবে,
ভার্জ্জিল্ এবং শ্রীকালিদাস যোগ দিয়েছেন জয়-রবে।
কহ্লনে তোর শৌর্য-বাখান্, বীৰ্য মহাবংশময়,
দেশ বিদেশের কাব্যে জাগে মূর্ত্তি তোমার মৃত্যুজয়।
যুঝলে তুমি বনের হাতী নদীর গতি বশ ক’রে,
জিৎলে চতুরঙ্গ খেলায় নৌকাগজে জোর ধ’রে।
শত্রুজয়ের খেল্লে গো শত্ৰুঞ্জ’ খেলা উল্লাসে,
কল্লোলে রাজতরঙ্গিনী গৌড়-সেনার জয় ভাষে।

* * * *

গঙ্গাহৃদি-বঙ্গভূমি! ছিলে তুমি সুদুর্জ্জয়,
অঞ্জনেরি গিরি তোমার সৈন্যে সবাই করত ভয়;
গঙ্গাহৃদি-বঙ্গ-মুখো ফৌজ আলেক্জান্দারী
ঘর-মুখো যে কেন হঠাৎ কে না জানে মূল তারি।
তখন যে কেউ ভোলেনি সিংহবাহুর বাহুর বল,
তখনো যে কীর্ত্তি খ্যাতি জাগ্ছে তোমার আসিংহল,
তখন্ যে তুই সবল স্ববশ স্বাধীন তখন স্ব-তন্ত্র
সাম্রাজ্যেরি স্বর্গ-সিঁড়ি গড়ছ তখন অতন্দ্র।
ধ্যানে তোমার সে রূপ দেখি’ গঙ্গাহৃদি-বঙ্গদেশ
তিতি আনন্দাশ্রু জলে, ক্ষণেক ভুলি সকল ক্লেশ।

* * * *

কলিযুগের তুই অযোধ্যা, দ্বিতীয় রাম তোর বিজয়,-
সাত খানি যে ডিঙা নিয়ে রক্ষোপুরী করলে জয়;
রাম যা’ স্বয়ং পারেন্ নি গো, তাও যে দেখি করলে সে-
লঙ্কাপুরীর নাম ভুলিয়ে ছত্র দণ্ড ধরলে সে।
দীঘি, জাঙাল, দেউল, দালান গড়লে দ্বীপের রক্ষী গো,
বঙ্গ! মহালক্ষ্মীরূপা! জননী! রাজলক্ষ্মী গো!
‘ইচ্ছামতী’ ইচ্ছা তোমার, ‘অজয়’ তোমার জয় ঘোষে,
‘পদ্মা’ হৃদয়-পদ্ম-মৃণাল সঞ্চারে বল হৃদ্কোষে;
‘ডাকাতে’ আর ‘মেঘনা’ তোমায় ডাক্ছে মেঘের মন্দ্রে গো,
‘ভৈরবে’ আর ‘দামোদরে’ জপছে “মাভৈঃ” মন্ত্রে গো;
রাঢ়ের ময়ুরাক্ষী তুমি, বঙ্গে কপোতাক্ষী তুই,
সাপের ভীতি রমার প্রতি দুই চোখে তুই সাধিস দুই।

* * * *

উৎসাহকর, চঁদ সদাগর উৎসাহী তোর পুত্র সব,
ঘুচিয়ে দেছে চরিতগুণে বেনে নামের অগৌরব;
সকল গুণে শ্রেষ্ঠ হ’য়ে শ্রেষ্ঠী নামটি কিন্লে গো,
সাধু হ’ল উপাধি- যাই সাধুত্বে মন জিন্লে গো;
সিন্ধুসাগর, বিন্দুসাগর, লক্ষপতি, শ্ৰীমন্ত
বঙ্গে আজো জাগিয়ে রাখে লক্ষ্মী-প্রদীপ নিবন্ত।
কামরূপা তুই, কামাখ্যা তুই, দাক্ষায়ণী, দক্ষিণা,
বিশ্বরূপা! শক্তিরূপা! নও তুমি নও দীনহীনা!

* * * *

চৌরাশী তোর সিদ্ধ সাধক নেপাল ভুটান তিব্বতে,
চীন-জাপানে সিদ্ধি বিলায় লঙ্ঘি’ সাগর পর্ব্বতে;
হাতে তাদের জ্ঞানের মশাল মাথায় সিদ্ধি-বর্ত্তিকা,
সত্য ও সিদ্ধার্থ-দেবের বিলায় মৈত্রী-পত্রিকা।
শিষ্য সেবক ভক্ত এদের হয়নিক লোপ নিঃশেষে,
অনেক দেশের মুগ্ধ চক্ষু নিবন্ধ সে এই দেশে;
যেথাই আশা আশার ভাষা জাগছে আবার সেইখানে-
ফল্গুতে ফের পদ্মা জাগে জীবন-ধারার জয় গানে।
জাগছে সুক্ত জাগছে গুপ্ত জাগছে গো অক্ষয়-বটে
কবির গানে জ্ঞানীর জ্ঞানে ধ্যান-রসিকের ধ্যানপটে।
অশেষ মহাপীঠ গো তোমার আজকে ভুবন উজ্জ্বলে,
অংশ তোমার মার্কিনে আজ, অঙ্গ তোমার ব্ৰিষ্টলে;
বিশ্ব-বাংলা উঠছে গ’ড়ে জাগছে প্রাণের তীর্থ গো,
জাতির শক্তি-পীঠ জগতে গড়ছে মোদের চিত্ত গো।
তার পিছনে দাড়িয়ে তুমি মোদের স্বদেশ-মাতৃকা!
দিচ্ছ বুদ্ধি দিচ্ছ গো বল জ্বালিয়ে আঁখির স্থিরশিখা!

* * * *

মরণ-কাঠি জীয়ন্-কাঠি দেখছি গো তোর হাতেই দুই,-
ভাঙন দিয়ে ভাঙিস্ আবার পড়িয়ে পলি গড়িস্ তুই;
নদ নদী তোর প্রাণের আবেগ, আবেগ বানের জল রাঙা,
পলি দিয়ে পল্লী গড়ি ভাঙন-তিমির দাত ভাঙা;
‘গম্’ ধাতু তোর দেহের ধাতু গঙ্গাহৃদি নাম্টি গো,
গতির ভুখে চলিস্ রুখে, বাংলা! সোনার তুই মৃগ।
গঙ্গা শুধুই গমন-ধারা তাই সে হৃদে আঁক্ড়েছিস্,-
বুকের সকল শিকড় দিয়ে গতির ধারা পাক্ড়েছিস্।
সংহিতাতে তোমায় কভু করতে নারে সংযত,
বৌদ্ধ নহিস্ হিন্দু নহিস্ নবীন হওয়া তোর ব্রত;
চির-যুবন-মন্ত্র জানিস্ চির-যুগের রঙ্গিনী,
শিরীষ ফুলে পান্-বাটা তোর ফুল্ল কদম-অঙ্গিনী!
হেসে কেঁদে সাধিয়ে সেধে চলিস্, মনে রাখিস্ নে,
মনু তোরে মন্দ বলে,- তা’ তুই গায়ে মাখিস্ নে।
কীর্ত্তিনাশা ফুৰ্ত্তি তোমার, জানিস্ নে তুই দীর্ঘশোক,
অপ্রাজিতা কুঞ্জে নিতি হাসছে তোমার কাজল চোখ।
স্বাগত কে বলে রে নেই কিছু তোর? নেইক সাক্ষী গৌরবের?
কে বলে নেই হাওয়ায় নিশান পারিজাতের সৌরভের?
চোখ আছে যার দেখছে সে জন, অন্ধজনে দেখবে কি?
উষার আগে আলোর আভাস সকল চোখে ঠেক্বে কি?
যে জানে সে হিয়ায় জানে, জানে আপন চিত্তে গো,
জানে প্রাণের গভীর ধ্যানে নও যে তুমি মিথ্যে গো।
আছ তুমি, থাকবে তুমি, জগৎ জুড়ে জাগবে যশ,
উথলে ফিরে উঠবে গো তোর তাম্র-মধুর প্রাণের রস;
গরুড়ধ্বজে উষার নিশাস লাগছে ফিরে লাগছে গো,
বিনতা তোর নতির নীড়ে গরুড় বুঝি জাগছে গো!
জাগছে গানে গানের তানে প্রাণের প্রবল আনন্দে,
জাগছে জ্ঞানে আলোর পানে মেল্ছে পাখা সুমন্দে,
জাগছে ত্যাগে জাগছে ভোগে জাগছে দানের গৌরবে,
আশার সুসার জাগছে ঊষার স্বর্ণকেশের সৌরভে।
ধাত্রী! তোমায় দেখছি আমি- দেখছি জগৎ-ধাত্রী-বেশ,
জয়-গানে তোর প্রাণ ঢেলে মোর গঙ্গাহৃদি-বঙ্গদেশ!