একটি কান্না

এমন তো মাঝে-মধ্যেই হঠাৎ হয়েই থাকে। রাত্রির খাবার
খেয়ে আর বেতারের নৈশ অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনে
শুতে যাই; কী-যে হয়, আমার ঘুমের বনে চকিতে আবার
জ্বলে ওঠে দাবানল- পালায় হরিণ, ভীত পাখি। মেষ গুনে
গুনে ক্লান্ত, কিছুতেই বোজে না চোখের পাতা, বিফল ঘুম-বড়ি।
অথচ সহজ ঘুমে অচেতন জায়া পুত্রকন্যা, আমি শুধু

করি পায়চারি ঘরে, বারান্দায়, ত্রস্ত কখনও দেয়াল পড়ি;
জানালায় ঝিল্লিস্বর স্বপ্ন রেখেও রাখে না, অবিরত ধু-ধু
করে স্মৃতি-এভেনিউ। পড়ে থাকে বই বিছানায় কি টেবিলে,
অতিশয় মৃত; ধৃতরাষ্ট্রের মতন চেয়ে থাকি, নিষ্পলক,
অন্ধকারে, চতুষ্পার্শ্বে দেখি না কিছুই কিংবা ছন্দও মিলে
বয় না বুকের রক্তে পুষ্পঝড়। ভাসমান লাল নীল স্বপ্নিল ফলক।

সহসা রাত্রির অন্ধ স্তব্ধতাকে খান খান করে আসে ভেসে
একটি কান্নার শব্দ, যেন শুনি রাতেরই ফোঁপানি অবিরাম
এ কান্না বয়স্ক নয়, কচিকণ্ঠ উৎস তার। বুঝি দেশে দেশে
এশিয়া কি আফ্রিকায়, লাতিন আমেরিকায় শহর ও গ্রাম
এমন কান্নায় থরো থরো বারবার। মধ্যরাতে কাঁদে শিশু
হয়তো-বা মাঝপথে, ক্ষুধায় কাতর সেকি? কী যে তার নাম
বলা মুশকিল, থাকে কার সঙ্গে? নাম তার কালু না কি বিশু
অথবা সালেহা, শীলা? জননী কি অন্ধকারে নিতেছে বিশ্রাম
দূরে? পিতা অপমৃত? কান্নারত এই শিশু পরিত্যক্ত, একা?
এ কান্নায় মিশে যায় আমার সে কবেকার হারানো বোনের
হু হু কান্না-স্রোত, বুকে ওঠে দুলে পলাতক সাল, পথরেখা।

এ-কান্নায় ছায়া আছে, আছে নিশি-পাওয়া আর হৃদয়-কোণের
ঝোড়ো হাওয়া। এ কান্নার কম্পনে চকিতে কী প্রবল নড়ে ওঠে
অস্তিত্বের খাঁচা, অন্তর্গত বুলবুল ভোলে গান। ‘কই শব?’
‘এক্ষুণি কবরে দেবো, এনে দে এনে দে’-বলে এ ক্রন্দন লোটে
ঘরে, পথে-ঘাটে, গোঠে-বুঝিবা কাঁদছে একা আমারই শৈশব।