হাসান এবং পক্ষিরাজ

এই পঙ্ক্তিমালা
তোমার উদ্দেশে লেখা, একটি যুগের সূর্যোদয়
সূর্যাস্তের গহন উদ্দেশে লেখা। এই শব্দাবলি
তোমার চোখের কাছে, সুস্মিত ঠোঁটের কাছ যদি
প্রজাপতি হয়ে উড়ে যায়, চায় হৃদয়ের বসন্ত-উচ্ছ্বাস,
তাহলে ফিরিয়ে তুমি নিও না তোমার
কালদগ্ধ ঋদ্ধ মুখ।

তোমাকে প্রথম দেখি,
মনে পড়ে, সেই কবে আমাদের প্রিয় উন্মাতাল
এই শহরের চৌরাস্তায়, বুড়িগঙ্গা নদীটির
খুব কাছে দ্বিপ্রহরে। কমলালেবুর দোকানের প্রান্ত ঘেঁষে
আমরা সেদিন রৌদ্রপায়ী যে সুনীল আকাশের নিচে
দাঁড়িয়ে বলেছি নানা কথা এলোমেলো, সে আকাশ
এখনো আকাশ একই।

অথচ আমরা দ্যাখো
কী দ্রুত বদলে গেছি, দশকে দশকে পাল্টে গেছি; চুলে
আমার ধরেছে পাক, তোমার মাথায় প্রতিশ্রুতিশীল টাক,
তেমন মসৃণ নেই আর ত্বক; তুমি, কী আশ্চর্য, বেলাবেলি
ছুঁয়েছো পঞ্চাশ সদ্য, আমি
খবরের কাগজ পড়ার ফাঁকে ফাঁকে সম্প্রতি হাঁটে শেখা
নাতির মোহন নাচ দেখি!

বন্ধু, মনে পড়ে
আমাদের দুজনের কবিতা ক্লাশের দুই প্রতিযোগী অথচ সুহৃদ
শিক্ষার্থীর মতো গলাগলি হেঁটে গেছে কতকাল।
মধুর ক্যান্টিন, আমতলা কতবেলা
দেখেছে তরুণ শত শত; সেই ভিড়ে তুমি ছিলে
উজ্জ্বল শ্যামল তলোয়ার,
মনীষা মৌলিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ সতত।

দ্বান্দ্বিক হেগেল, মার্কস আর
ফ্রয়েডের মেধার কিরণে উদ্ভাসিত, দাঙ্গার পাঁচটি গল্পে
নিমগ্ন বিষণ্ণ আর এলিয়টি পঙ্ক্তি-আওড়ানো
ধোঁয়াটে সন্ধ্যায় পথে তুমি আর আমি, কখনো জীবনানন্দে,
কখনো সুধীন্দ্র দত্তে, কখনো-বা বুদ্ধদের বসুতে আপ্লুত
ভাসিয়ে দিয়েছি ভেলা নিরুদ্দেশে দেখেছি বিজন মরুদ্বীপ,
নাবিকের করোটি, প্রবীণ প্রস্পেরোর গুহামুখ।

তোমার কি মনে পড়ে আজ
রাজনীতি নাম্নী এক চণ্ডীর দুন্দুভি? মনে পড়ে রাত জেগে
অজস্র ভূতলবাসী ইশতেহার পাঠ? মনে পড়ে বায়ান্নোর
ভয়ংকর সুন্দর সে রক্তপদ্মে অধীর চুম্বন? তুমি গ্যাছো
অন্ধকার প্রেসে একা জ্বালাতে নিষিদ্ধ দিপাবলী
এবং গলির মোড়ে জ্বলজ্বলে চোখে পক্ষিরাজ খুঁজে খুঁজে
কেটেছে আমার সন্ধ্যা, কত মধ্যরাত।

বসে আছে লোকটা একাকী;
অস্ত গোধূলির দিকে চোখ রেখে ভাবে, একদা সে
যেসব কপোত হেসে উড়িয়ে দিয়েছে আসমানে,
কখনো আসে নি ফিরে ওরা, ফলিয়েছে যে-ফসল, অবেলায়
তা-ও গ্যাছে নষ্ট হয়ে পঙ্গপালী তুমুল তাণ্ডবে। আজ তার
সত্তাময় হরিণের পদচ্ছাপ, হরিণ উধাও ধূলিঝড়ে।
একাকী লোকটা সিংহমূর্তির ছায়ায় বসে ভাবে।

একাকী লোকটা আমি, নাকি
তুমি! মৃত্যু-গোঁজা অন্ধকারে চলে খোঁজা অবিরাম;
আমার সম্মুখে চোরাবালি, তোমার অনুপস্থিতি;
তোমার সম্মুখে বালিয়াড়ি, আমিহীন
আমার দুঃখিত পদচ্ছাপ। জীবনকে মনে হয়
দীর্ঘশ্বাসময় ডাকঘর, শূন্য স্তব্ধ নিরালোকে;
ছিঁড়ি শুধু পত্রহীন হলুদ লেফাফা।

বিমুখ প্রান্তরে, হে সতীর্থ, হে সুহৃদ,
এখনো আমরা আছি; এখনো সম্বল শুধু আর্ত শব্দাবলি।
অক্ষরে উঠেছো গড়ে স্তরে স্তরে তুমি প্রতিষ্ঠান
এবং হাসান হাফিজুর রহমান যিনি, তাঁকে
এড়িয়ে এখনো আমি মাঝে-মধ্যে সেই কবেকার
হাসানকে খুঁজে ফিরি, যেমন একদা খুঁজতাম পক্ষিরাজ;
তখন নিজেকে, বন্ধু একা, বড় একা মনে হয়।