শেষ উপদেশ

(রফিক আজাদ প্রীতিভাজেনষু)

বলতো অমন ক’রে কেন তাকাচ্ছিস বারবার
আমার এখনকার দিকে? না, যা ভাবছিস
তা নয় মোটেই; সেই সোনালি তরল
আগুনের একটি ফোঁটাও
নামে নি আমার কণ্ঠনালি বেয়ে, না ওসব ঝুট
ঝামেলা এখন নেই। ভিন্ন এক মদ, ভয় বলা যায় তাকে,
প্রহরে প্রহরে
আমাকে মাতাল ক’রে রেখেছে সম্প্রতি।

মনে পড়ে, প্রথম যেদিন আমি সদ্য-কিনে-আনা
দোলনায় তোকে ফাইয়াজ
দুলিয়েছিলাম শরতের অপরাহ্নে ঘরের ভেতরকার
স্বর্ণাভায়, মনে হয়েছিল
দোলাচ্ছি ছড়ার ছন্দে আমার নিজের শৈশবকে। আর আজ
সমস্ত জীবনটাই দুলছে ভীষণ;
ইচ্ছে হয় সমুখে যা পাই তা-ই ধ’রে একটু সামলে নিই,
ইদানীং তোর দাদাজানের লাঠিটা, মজবুত নকশাদার,
বড় বেশি স্বপ্নে দেখি আর
অন্ধকারে তোর হাত খুঁজি কী ব্যাকুল।

এখন তুষার-ঢাকা জঙ্গলের মতো মাথা নিয়ে
বেঁচে আছি। বসন্তকালীন
শহুরে সুন্দরীদের আনাগোনা কমেছে, এখন
আমাকে এড়িয়ে চলে ওরা, ভাবে আমি যেন
সমাধি ফলক এক, যার গায়ে শুকনো পাতা ঝরে,
ঘাস চুমো খায়, হাওয়া।

বয়ে যায়। ফলত আশ্বস্ত তোর খুব ঈর্ষাকাতর জননী,
না কি এই ভাঁটার টানেও
গোপন বিদ্রোহী পূর্ণিমায় জোয়ারের আশঙ্কায়
পদ্মার ভাঙন জাগে তার জীবনের
নিদারুন মোহনায়।অমন ধারালো দৃষ্টি প্রত্যাহার কর।

তুই কি এখন দেখছিস খোকা আমি যা দেখছি?
শুনছিস অবিকল আমি যা শুনছি? কণ্ঠে তোর
মানুষের বোধ্য কোনে কথা
মঞ্জরিত হলে কি এখন? ওরে শোন,
আমাদের শহরকে করেছে রাহুর মতো গ্রাস
ভয়াবহু মহামারী এক; এ শহরে যত লোক
চোখে দ্যাখে, কানে শোনে আর কথা বলতে সক্ষম,
তাদের আঙ্গুলে গোনা যায়।

মদ্যপের বমির মতোই উপদেশ
উগরে দিয়েছি আমি তোর প্রতি অবেলায়। কিছু তার
কানে গেছে তোর, হয়তো মর্মমূলে বিঁধেছে কোনোটা,
সিংহভাগই পেয়েছে উপেক্ষা। কিন্তু খোকা
আমার মিনতি রাখ, আজকের এই উপদেশ
আমার ব্যর্থ না হয় যেন।

আমার শ্রবণশক্তি ত্যাগ করে গেছে
আমাকে দৃষ্টিও অস্তমিত, বলা যায়;
আমার বেবাক কথা কেবলি জড়িয়ে যাচ্ছে ওরে
পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষের মতো। এখনো সময় আছে,
এখনি তুই যা একমাত্র
হে পুত্র আমার, অভিশপ্ত এ শহর থেকে দূরে, বহুদূরে
পালিয়ে যা। নাকি তুই আজো
থাকবি কামড়ে মাটি এখানেই, যেমন উদ্ভান্ত
যুবা থাকে তার পূর্বপুরুষের কবরখানায়,
ঘোরে আশেপাশে, বিড় বিড় ক’রে কাহিনী শোনায়
বিস্মৃত প্রেতের মতো, কিছুই দ্যাখে না নিজে কিংবা ঠারে ঠোরে
কারুকে দেখাতে কিছু পারে না কখনো।