বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা

যে-দেশে রাজনীতি ও রাষ্ট্রযন্ত্র রুগ্ন, তার বিশ্বদ্যালয় সুস্থ হবে, এমন আশা করা সম্ভবত এক ধরনের অসুস্থতা, যদিও তাকে বলতে পারি মহান অসুস্থতা। বারো কোটি মানুষের দেশে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় আছে মাত্র চারিটি; তার মাঝে দুটিকে শুরু থেকেই অসুখে ফেলে রাখা হয়েছে, যে-অসুখ সারতে একশো বছর লাগবে। রাষ্ট্রযন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশেষ দরকারিও মনে করে না; মনে করে নিজেদের জন্য ক্ষতিকর, তাই দেশে বিশ্ববিদ্যালয় বাড়ে না; বেড়ে চলে সৈন্যাবাস, যা তাদের জন্যে খুবই উপকারী। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় জর্জরিত অজস্র সমস্যায়;- সমস্ত সমস্যার মূলে একটিই সমসা, অর্থ, যার অভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভুগছে পঙ্গুত্বে। গরিব রাষ্ট্রেও কোনো কোনো এলাকায় টাকার অভাব ঘটে না, কিন্তু শিক্ষার নামে এই সমুদ্র শুকিয়ে যায়। পাকিস্তানেও নাকি গত দু-দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়ে তিরিশে দাড়িয়েছে, যদিও লোক সংখ্যা কম; কিন্তু আমরা বিশ্ববিদ্যালয় বাড়াই নি, এমন একটা ভয়ে যেনো বিশ্ববিদ্যালয় বাড়ালে বড়ো একটা ক্ষতি হয়ে যাবে। বিশ্ববিদ্যালয় বাড়লে ক্ষতি হবে তাদের, যারা দখল ক’রে আছে রাষ্ট্র, তাই বাঙলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় বাড়ে না। যে-কটা আছে, সেগুলো বেঁচে আছে ধুঁকেধুঁক। হঠাৎ সেগুলোতে দেখা দেয় অনির্দিষ্টকাল, মাসের পর মাস বন্ধ থাকে পড়াশুনো; পরীক্ষা ঠিক সময়ে হয় না, হওয়ার পর আর ফল বেরোয়না; জট পাকিয়ে থাকে বিভিন্ন শিক্ষাবর্ষ; ছাত্ররা মাঝে মাঝে মেতে ওঠে আত্মহননে, শিক্ষকের দায়িত্ত্ব পালন করে না ঠিকমতো। শিক্ষকদের প্রতিও বিশ্ববিদ্যালয় পালন করে না দায়িত্ব। ধনী ও ক্ষমতাসম্পন্নদের সন্তানেরা এখন আর দেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে না; তাদের কালো টাকা রয়েছে, তাই তাদের সন্তানেরা শ্বেতশুভ্র দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিদ্যার্জন করে। ওই সন্ত্রানেরা গরিব দেশে ফিরবে না, ফিরলে শাসক হয়ে ফিরবে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন আসে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণীর সন্তানেরা, যাদের বিশ্ববিদ্যালয় আসা ছাড়া কোনো উপায় নেই। আমেরিকার স্বপ্ন তাদের জীবনে পরিহাস, এমনকি ভারতের স্বপ্নও মস্ত কৌতুক। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে;- তাদের মধ্যে মেধাবীরা চলে যায় প্রকৌশলে বা চিকিৎসায়, প্রচুর অর্থের লোভ নিয়ে; যারা আসে বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের জীবনে দুর্দশার শেষ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে দেখে এখানে আরো বড়ো দুর্দশা অপেক্ষা ক’রে আছে। বিশ্ববিদ্যালয় তাদের বিদ্যাও বেশি দিতে পারে না, স্বপ্ন বা আশা তো দিতেই পারে না। বিশ্ববিদ্যালয় তাদের নিরাশায় পরিপূর্ণ করে তোলে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে মনে হয় বিশাল হাসপাতালের মতো, যে-হাসপাতাল নিজেই শোচনীয়ভাবে রুগ্ন; অন্যের চিকিৎসা কী করবে, তার নিজেরই দরকার গভীর চিকিৎসা। অসংখ্য তার রোগ, অনেক রোগ স্পষ্ট অনেক রোগ প্রচ্ছন্ন; অনেক রোগ তার শরীরে নিয়মিত সংক্রমিত হয় বাইরে থেকে; আর অনেক রোগ সৃষ্টি করে চ’লে সে নিজেই। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আমাদের গৌরব। এখানেই চলে জাতির সৃষ্টিশীলতা ও মননশীলতার চর্চা, এখানেই বিকশিত হয়েছে জাতির স্বাধীনতার স্বপ্ন; এখনো এখানেই লালনপালন করা হয় প্রগতিশীল চেতনা। কিন্তু আমরা কি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে প্রকৃতই বিশ্ববিদ্যালয় করে তুলতে পেরেছি, চেষ্টা করেছি ক’রে তোলার, যেমন পেরেছে পশ্চিমের বহু দেশ? বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আমাদের সমাজের সৃষ্টিপ্রেরণী থেকে জন্ম নেয় নি, আমরা এগুলোকে এনেছি পশ্চিম থেকে; পশ্চিমের শ্রেষ্ঠ উপহার বিশ্ববিদ্যালয়, কিন্তু আজো আমরা বিশ্ববিদ্যালয়কে ক’রে তুলতে পারি নি বিশ্ববিদ্যালয়। আমরা পশ্চিমের সুস্থ বিশ্ববিদ্যালয়কে ক’রে তুলেছি অসুস্থ, নানা রোগে পীড়িত করেছি তাকে; করে তুলেছি নির্জীব, নিষ্ক্রিয়।

জাতির মনন-ও সৃষ্টি-শীলতা বিকাশের কেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়। কোনো জাতি যখন তার ওই প্রতিভার বিকশ ঘটাতে চায়, তখন গড়ে তোলে বিশ্ববিদ্যালয়; তাকে দেয় সমস্ত সুযোগ ও স্বাধীনতা, যাতে সেখানে অবাধে চলতে পারে বিশ্বজ্ঞানের চর্চা। সেখানে চলে বিজ্ঞান আহরণ ও বিতরণ, সেখানে চলে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বাধীনতা দিই নি, সুযোগও দিই নি; বরং আমরা তার স্বাধীনতা ও সুযোগ হরণ করার নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকি দিনরাত। তাই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় কিছু সৃষ্টি করতে পারে নি;- বিশ্ববিদ্যালয় জন্ম দিতে পারে নি বিশ্বমাপের বিজ্ঞানী বা দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ বা সমাজতাত্ত্বিক বা সাহিত্রাতাত্ত্বিক। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একরাশ আমলা সৃষ্টি করেছে, কিছু বিপথগামী রাজনীতি ব্যবসায়ী সৃষ্টি করেছে। শিক্ষার্থীদের আমরা কোনো মহৎ আদর্শেও দীক্ষিত করতে পারি নি। এটা বোঝা যায় আমলাদের মুখের দিকে তাকালে; ওই মুখে কোনো আদর্শ নেই, নীতি নেই, আছে শুধু স্বার্থপরায়ণতা। রাজনীতি বিশ্ববিদ্যালয়ের জলবায়ুর মতো;-এখানেই জন্ম হয় রাজনীতি ব্যবসায়ীদের। এখন যারা ব্যবসা করে চলছে, তারা প্রায় সবাই এক সময় আদর্শের শ্লোগান মুখর ক’রে রাখতো বিশ্ববিদ্যালয়ের দশদিগন্তু। তাদের মুখে এখন কোনো আদর্শ নেই, রয়েছে চরিত্রহীনতার বেড়ো দাগ।

যে-বিশ্ববিদ্যালয় কিছু সৃষ্টি করতে পারে নি, তার জ্ঞানার্থীদের মনে সঞ্চার করতে পারে নি কোনো আদর্শ, তার ব্যর্থতা শোচনীয়। এমনও মনে হয় অনেক সময় যে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো না থাকলে হয়তো অন্য রকম উপকার হতো সমাজের বিকাশ ঘটতো না এতো আদর্শহীন অসৎ মানুষের। আমাদের নিরক্ষররাও এতো চরিত্রহীন নয়, যতোটা চরিত্রহীন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উপাধি নিয়ে বেরিয়ে-যাওয়া শক্তিমানেরা। তাহলে কি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মানুষ সৃষ্টি করে না, সৃষ্টি করে একরাশ দক্ষ অমানুষ? তারা চেনে শুধু ক্ষমতা ও অর্থ; মানবিক সমস্ত ভূভাগ অচেনা তাদের কাছে। তারা এ-রোগ কি আয়ত্ত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে থেকেই; নাকি তারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরোয় রোগপ্রতিরোধের কোনো শক্তি না নিয়ে, এবং সমাজে প্রবেশের সাথে সাথে আক্রান্ত হয় সামাজিক সমস্তু অসুখে? কিছুদিন আগে একটা শোচনীয় ঘটনা ঘটেছে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়, একেবারে বিজ্ঞানের কেন্দ্রস্থলে: দুটি ছাত্র রাস্তা থেকে হরণ করে এনে ধর্ষণ করেছে একটি বালিকাকে, আরেকটি পালিয়ে গিয়ে বেঁচেছে তাদের পাশবিকতা থেকে, এবং পুলিশের সাহায্যে উদ্ধার করেছে অসহায় ধর্ষিতাকে। ঘটনার নারকীয়তায় নির্বাক হয়ে গেছে যেনো সবাই, নিন্দা করার ভাষাও হারিয়ে ফেলেছে। ওই ছাত্র দুটিকে কি ধরে নেবো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের উদাহরণ হিশেবে, না ব্যতিক্রম হিশেবে। তারা একই সঙ্গে উদাহরণ ও ব্যতিক্রম। তাদের একজন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির ছাত্র। ওই বিকারগ্রস্তকে কেউ সুস্থ রাখতে পারলো না, না বিশ্ববিদ্যালয় না ইসলাম না সংস্কৃতি। তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ঋদ্ধ করলো কোন সম্পদে? অসহায় সমাজ যেখানে তাকিয়ে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র যেখানে ত্রাতারূপে দেখা দেবে, সেখানে সে হয়ে উঠছে পাশবিক পীড়নকারী। এতে বুঝতে পারছি বিশ্ববিদ্যালয়ের রোগ অত্যন্ত গভীর, তার এখন গভীর গভীরতর অসুখ; তার সুনিপুণ চিকিৎসা দরকার অবিলম্বে। পাকিস্তানপর্ব থেকে আজ পর্যন্ত আমরা বিশ্ববিদ্যালয়কে অসুস্থ থেকে অসুস্থ করেছি, আমরা জ্ঞানকে পরিহার করেছি, বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে এনএসএফ ছেড়ে দিয়েছি, ত্রাস ছড়িয়েছি, শিক্ষকদের অনেককে নেমে যেতে দেখেছি, নীতি থেকে নীতিহীনতায়। পড়াশুনোকে আমরা সংকীর্ণ থেকে সংকীর্ণতর করেছি, প্রশাসনকে অযোগ্য ও দুর্নীতিপরায়ণ করেছি, গ্রন্থাগারাকে ধুলোমলিন ক’রে তুলেছি। বিশ্ববিদ্যালয়কে যদি বলি দেশের মস্তিষ্ক, তবে মস্তিষ্ক এখন রোগাক্রান্ত; এর সুচিকিৎসা দরকার। যে-জাতির মগজ ব্যাধিগ্রস্ত, তার শরীর সুস্থ হতে পারে না; তার একটিই ভবিষ্যৎ: বিনাশ।

(দুই) কোর্সপদ্ধতি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কয়েক বছর হলো লেখাপড়ার কোর্সপদ্ধতি চালু করেছে। এর পেছনে দর্শনটি কী, জানি না; তবে শুরু থেকেই এটা পছন্দ হয় নি অনেকের, এবং কয়েক বছরেই এর ব্যর্থতা স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়েছে। কোর্সপদ্ধতির বাইরের রূপটি বেশ ঝকঝকে; তবে একটা নতুন মোড়কে পুরোনো জিনিশ। আগে বিভিন্ন ‘পত্র’- এ ভাগ করা হতো বিদ্যাকে, কোর্সপদ্ধতিতে ওই পত্রগুলোকে টুকরো টুকরো করা হয়েছে নানা ‘কোর্স’-এ। টুকরো করার সময় বিদ্যার অনেক অংশ বাদ পড়েছে; বেশ ছাটকটি করে পড়ানো হচ্ছে নানা বিষয়। আগে অনার্সে আটটি লিখিত পত্র ছিলো; সেগুলো কেটে, ছাঁটকাট করে করা হয়েছে ষোলটি কোর্স; এবং সাথে তৈরি করা হয়েছে কিছু নতুন কোর্স। ছাত্রদের দেয়া হয়েছে বিকল্প কোর্স নেয়ার সুযোগ। আগে প্রতিটি পত্র ছিলো একশো নম্বরের এখন প্রতিটি কোর্স হয়েছে পঞ্চাশ নম্বরের। ওই পঞ্চাশ নম্বরকে আবার দু-ভাগ করা হয়েছে। একভাগে রয়েছে কাৱো ভাষায় ‘অনুশীলনী’, কারো ভাষায় ‘ইনকোর্স’, যার জন্য বরাদ্দ পনেরো নম্বর; আরেক ভাগে রয়েছে লিখিত বার্ষিক পরীক্ষা, যার জন্যে বরাদ্দ পঁয়ত্রিশ। এখন বছরে বছরে পরীক্ষা হয়, বছরে বছরে নম্বর জমে; আর শেষ বছরের পরীক্ষার পর নম্বর যোগ ক’রে ফলাফল ঘোষণা করা হয়। কোর্স পদ্ধতির প্রথম শিকার বিদ্যা: টুকরো টুকরো কোর্স বিষয়ক টুকরো টুকরো করা হয়েছে, আগের পাঠ্য বিষয় থেকে বাদ দেয়া হয়েছে অনেক কিছু, তাই প্রতিটি কোর্স হয়ে উঠেছে ছিমছাম। বেশি পড়তে হয় না; বেশি বুঝতে হয় না, বেশি উপলব্ধি করতে হয় না। কোর্সে শিক্ষকই হয়ে উঠেছেন পাঠ্যবিষয়। কোনো কোর্সে যা-ই থাক-না-কেনো, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়; মূল্যবান হচ্ছেন শিক্ষক- তিনি যা বা যতোটুকু পড়াবেন, তাই কোর্স। শিক্ষক যদি ক্লাসে আসেন, তবে তাই কোর্স; যদি না আসেন, তবে তাই কোর্স। কোনো শিক্ষক কোর্সের অর্ধেক পড়াতে পারেন, প্রশ্ন করতে পারেন সেখান থেকেই, ছাত্ররাও উত্তর দেয় সেটুকু থেকেই। কোনো বিষয়ে সম্পূর্ণ জ্ঞান দেয়ার দায় নেই শিক্ষকের; তিনি যতোটুকু দিতে ইচ্ছে করেন, সেটুকুই যথেষ্ট। অনেক শিক্ষক তাই করেন। ছাত্রছাত্রীরা কোনো বিষয় পুরোপুরি জানার আগ্রহ বোধ করে না, শিক্ষক যতোটুকু পড়ান সেটুকুই প্রতিলিপি ক’রে নেয় তারা, মুখস্থ ক’রে ফেলে, পরীক্ষা দেয় ও সম্পূর্ণ ভুলে যায়। স্মরণশক্তি বা মনে রাখা কোর্স পদ্ধতির বিরোধী; কোর্স পদ্ধতির দর্শন হচ্ছে সামান্য শেখো, পরীক্ষা দাও ও ভুলে যাও। প্রথম বর্ষে তারা যা পড়ে, দ্বিতীয় বর্ষে তা মনে থাকে না তাদের, তৃতীয় বর্ষে ওই বিষয়টি এতো পরিচ্ছন্নভাবে বিস্মৃত হয় তারা যে বিষয়টিকে পুরোপুরি নতুন মনে হয় তাদের। বিষয় সম্পর্কে কোনো উপলব্ধি জন্ম দেয়াও কোর্সপদ্ধতির বিরোধী। সাহিত্যের কথাই ধরা যাক। প্রথম বর্ষ অনার্স শ্রেণীতে যখন কোনো ছাত্র ভর্তি হয়, তখন তার সাহিত্যবোধ প্রায় থাকেই না; দ্বিতীয়-তৃতীয় বর্ষে গিয়ে ওই বোধ জন্ম নেয়, সে নিজে বোধ করতে পারে সাহিত্য, মূল্যায়নও করতে পারে কিছুটা প্রথম বর্ষে ও ততীয় বর্ষে রবীন্দ্রনাথ বা শেক্সপিয়র এক রকম থাকে না, ভিন্নরূপে দেখা দেয়। কিন্তু কোর্স পদ্ধতিতে প্রথম বর্ষে যদি রবীন্দ্রনাথ পড়ানো হয়, তাহলে শিক্ষার্থী রবীন্দ্রনাথের কিছুই বোঝে না, যেমন বোঝে না চর্যাপদ বা শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বা বৈষ্ণব পদাবলি। তাই কোর্সপদ্ধতির পড়াশুনো হচ্ছে নির্বোধ পড়াশুনো;- খণ্ডিত, মুখস্থ ও বিস্মৃত। সব বিষয়েই এমন ঘটেছে এখন, কেউ লাভ করছে না তার বিষয় সম্পর্কে মোটামুটি সম্পূর্ণ ধারণা। কোর্সপদ্ধতিতে শিক্ষক দেখা দিয়েছেন একনায়করূপে, ছাত্র অসহায় বন্দী। কোর্সপদ্ধতিতে শিক্ষক ছাত্রকে খামখেয়ালি শিরোপা দিতে পারেন, আবার তাকে নিক্ষেপ করতে পারেন আবর্জনাস্তূপে। তাই ছাত্রেরা শিক্ষকদের কাছে থাকছে দাসরূপে; কেননা তারা জানে শিক্ষকের কৃপায় তাদের ভাগ্যে জুটতে পারে সুন্দর সোনালি নম্বর, তার রোষে মিলতে পারে একটা কদর্য সংখ্যা। অনেক শিক্ষক ঠিকমতো ক্লাস নেন না, আসেন অর্ধেক সময় পেরিয়ে; কিন্তু বেশ আগেই কোর্স শেষ করে ফেলেন। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্সপদ্ধতি আমাদের দুর্গতজ্ঞানের জগতে সৃষ্টি করেছে আরো দুৰ্গতি। কোর্সপদ্ধতির প্রশ্নপত্র দেখলেও গা ঘিনঘিন করে বিশ্রী হস্তাক্ষরে লেখা প্রশ্নপত্র দেয়া হয় ছাত্রদের, উত্তর লেখার আগে একবার বমি আসে।

কোর্সপদ্ধতির কুফলের উল্টো পিঠ তার সুফল: এ-পদ্ধতিতে খারাপ ছাত্রদের পক্ষেও প্রথম শ্রেণী পাওয়া সম্ভব; এবং এখন পাচ্ছে। তাই এখনকার প্রথম শ্রেণীপ্রাপ্তরা আবার মর্যাদাও পায় প্রথম শ্রেণীর। অনার্সে ষোলটি কোর্সের প্রতিটি কোর্সে রয়েছে পনেরো নম্বরের অনুশীলনী; অর্থাৎ এখন অনুশীলনীর জন্যেই রয়েছে দু-শো চল্লিশ নম্বর, আগে যেখানে ছিলো মাত্র পঁচাত্তর। কোর্সপদ্ধতিতে অনেক অনুশীলনী ক্লাস হওয়ার কথা, কিন্তু হয় না; কোনো কোর্সশিক্ষকের পক্ষেই অতো অনুশীলনী ক্লাস নেয়া সম্ভব নয়; তবে অনুশীলনীতে অনেক ছাত্রই প্রচুর নম্বর পায়। পাওয়ার পেছনে কারণ রয়েছে অনেক, তার অনেকটাই বিদ্যার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। অনুশীলনীগুলো এখন প্রথম শ্রেণী পাওয়ার চাবি। বার্ষিক লিখিত পরীক্ষায়ও এখন অনেক নম্বর ওঠে। কোনো বিষয়ে বিষয়টি যতো জটিল বা ব্যাপক হোক, প্রশ্ন করতে হয় পাঁচ ছটি; ছাত্ররা উত্তর দেয় তিনটি বা সাড়েতিনটি। পঁয়ত্রিশ নম্বরের প্রশ্ন করতে গিয়ে দেখা যায় জটিল দুরূহ প্রশ্ন করাই যায় না, করলে অধিকাংশই উত্তর দিতে পারবে না, তাই বেছে সোজা প্রশ্ন করা হয়, সে-সমস্ত প্রশ্ন ফিরে ফিরে আসে। ছাত্ররা আগে থেকেই টের পায় এবার কী কী প্রশ্ন আসতে পারে। তাই ছাত্রদের যেমন ব্যাপকভাবে পড়ানো হয় না, তেমনি তাদের মেধা যাচাই করা হয় না। পঁয়ত্রিশ নম্বরের উত্তরপত্র মূল্যায়ন করার সময়ও হাত্রদের কিছুটা বেশি নম্বর দেয়া হয়। প্রতিটি প্রশ্নের মান হয় ন-নম্বরের মতো। ন-তে তিন-চার দিতে খারাপ লাগে বলে অবলীলায় দেয়া হয় পাঁচ-ছয়; কিন্তু আগে বিশে বারো দিতে পরীক্ষকদের হাত কাঁপতো এখনো প্রথাগত পদ্ধতির ছাত্রদের নম্বর দিতে পরীক্ষকেরা কৃপণ, কোর্সপদ্ধতির ক্ষেত্রে অকৃপণ। ফলপ্রস্তুতির যে রীতি এখন চলছে, তাতে কোনো কোনো ছাত্র এগারো-বারো নম্বর বেশি পেতে পারে এমনিই, যে-নম্বর সে পায় নি। এখন প্রতিটি কোর্সে পরীক্ষার্থীর প্রাপ্ত নম্বরকে পূর্ণ সংখ্যায় পরিণত করতে হয়। মনে করা যাক কেউ পেয়েছে ২০.০১; কিন্তু তাকে দিতে হবে ২১। এভাবে ষোলটি কোর্সে কেউ প্রায় ষোল নম্বর বেশি পেতে পারে, দশ-এগারো অনেকেই পায়। এ-নীতিতে নম্বর বাড়ে, ফল ভালো হয়, প্রথম শ্রেণী পায়; কিন্তু পড়াশুনোটি প্রথম শ্রেণীর মানের নয়। কোর্সপদ্ধতিতে যারা প্রথম শ্রেণী পায়, প্রথাগত পদ্ধতিতে তারা অনেকেই শতকরা বায়ান্নোতিপ্পান্নোর বেশি নম্বর পেতো না। কোর্সপদ্ধতির ফলে উপকার হয়েছে এ-একটিই; কিন্তু এতে বিদ্যার অবমূল্যায়ন ঘটেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোর্স পদ্ধতি শুরু হয়েছিলো বিদ্যার উন্নতির লক্ষ্যে; কিন্তু তা উন্নতি সাধন না ক’রে ক্ষতিসাধন করেছে। কোর্সপদ্ধতির সাথে শিক্ষাবর্ষ-জটের ব্যাপারটিও জড়িত। এখন প্রথম বর্ষ পরীক্ষার ফল না বেরোনো পর্যন্ত দ্বিতীয় বর্ষের ক্লাশ শুরু হয় না, দ্বিতীয় বর্ষের ফল না বেরোলে শুরু হয় না তৃতীয় বর্ষ, আর তৃতীয় বর্ষের ফল না বেরোলে শুরু হয় না দ্বিতীয় পর্ব। ফল প্রকাশ প্রক্রিয়ায় কেটে যায় দু-বছর; ছাত্ররা প্রবীণ হয়ে ওঠে। কোর্স পদ্ধতির ব্যর্থতা এখন এর প্রবক্তারাও বুঝতে পারছেন। কোর্স পদ্ধতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বড়ো রোগ, অভিনব রোগ; এর আশু চিকিৎসা দরকার। আমাদের আবার ফিরে যেতে হবে প্রথাগত পদ্ধতিতে তার ব্যাপকতা, বোধি, উপলব্ধিতে। অবিকল আগের পত্রগুলোকেই পুনর্বাসিত করতে হবে, এমন নয়, পাঠ্যসূচি তৈরি করতে হবে সুচিন্তিতভাবে, কিন্তু জ্ঞান বিতরণ ও অর্জনে প্রয়োগ করতে হবে আগের দর্শন। কোর্সপদ্ধতি আমাদের উপযোগী নয়, এ-পদ্ধতি আমাদের জ্ঞানকে রুগ্ন থেকে রুগ্নতর ক’রে তুলছে। এ-রোগের আশুচিকিৎসা ছাড়া আমাদের বিদ্যার ভবিষ্যৎ খুবই খারাপ।

[তিন] প্রশাসন
পুবে কলাভবন, পশ্চিমে রেজিস্ট্রারের কার্যালয়; মাঝখানে একটা ছোটো উদ্যান। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও প্রশাসনের মধ্যে একটি বাগানের ব্যবধান বা দূরত্ব; কিন্তু পুবের ভবন থেকে পশ্চিমের ভবনে একটি পত্র পাঠিয়ে কেউ যদি উত্তরের প্রতীক্ষায় থাকেন, তবে তার পুরো জীবন অতিবাহিত হয়ে যেতে পারে উত্তর আসার আগেই। জীবনকে সংক্ষিপ্ত জেনে তিনি যদি খোঁজ নিতে যান তাঁর নিরুদ্দেশ পত্রটির, তাহলে কেউ খোঁজ দিতে পারবে না। ওই পত্র হয়তো সমস্ত বাস্তব ঠিকানা পেরিয়ে প্রবেশ করেছে মহাকালের বাক্সে। দু-বছর আগে আমি একটি পত্র লিখেছিলাম, প্রতিদিনই ওই পত্রটিকে মনে পড়ে আমার, কিন্তু জেনে গেছি ওই পত্রের উত্তর কোনোদিন পাবো না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন মহাজাগতিক কৃষ্ণগহ্বরের মতো, যা অবলীলায় গ্রাস করে আমার পত্রটির মতো অসংখ্য পত্র, আবেদন, লিখিত বস্তু। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ম হচ্ছে আবেদনকারী তার আবেদনপত্র নিয়ে ঘুরবেন টেবিলে টেবিলে, কাজ করিয়ে নেবেন হাতে হাতে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন লিখিত বস্তুকে গুরুত্বপূর্ণই মনে করে না বা মনে করে লিখিত বস্তুমাত্রই অপাঠ্য; তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ব্যক্তিটি। তাঁর শারীরিক উপস্থিতি ছাড়া কোনো দাম নেই তার লিখিত বস্তুর। লিখিত বস্তুকে যেনো পুরোপুরি অবিশ্বাস করে প্রশাসন, বিশ্বাস করে ব্যক্তির উপস্থিতিকে। এটা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়েরই বিশ্বাস নয়, পুরো বাঙলাদেশের প্রশাসনের বিশ্বাসই এই। বাঙলাদেশের প্রসাশনযন্ত্রসম্পূর্ণরূপে নিরক্ষর; তা লেখায় বিশ্বাস করে না, পড়তে পারে না কোনো লিখিত বস্তু; তাই কোনো লিখিত বস্তু দেখলে সেটিকে কাগজচাপা দিয়ে লেখকটির প্রত্যাশায় থাকে এদিক দিয়ে আমাদের আমলাতন্ত্র এখনো নিরক্ষর চাষীসম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি আবেদনপত্র লিখে ঘুরতে হবে টেবিলে টেবিলে। তবে একটি সাধারণ ও সরল সমস্যা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনভবনের টেবিলগুলো প্রায়ই শূন্য থাকে, কাউকে পাওয়া যায় না টেবিলের আশেপাশে। কেউ হয়তো অন্য কক্ষে গেছে, অর্থাৎ আসবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনভবনটিকে কখনো কখনো এটি অতিকায় কাছিমের মতো মনে হয়, ধীরতায় এটি অদ্বিতীয়। প্রশাসনভবনের কয়েকটি তলা একবার ঘুরে এলে বোঝা যায় প্রশাসকের কোনো অভাব নেই, বিচিত্র মানের প্রশাসকের ভিড়ে ওই ভবনটি নিঃশ্বাস নেয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। ঘরে ঘরে টেবিলের পর টেবিল, টেবিলের ওপর ফাইলের ওপর ফাইল; তবে কিছুই সচল নয়, কারো নিজস্ব সক্রিয়তা নেই, তাকে পেছন থেকে ঠেললে একটুও নড়ে না। একটি অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায় যে ওই ভবনে কাজের থেকে কর্মচারী ও কর্মকর্তা অনেক বেশি। আমি কোনো হিশেব নেই নি, তবে এ-অভিযোগটিকে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় যখন দেখি কোনো কাজ হচ্ছে না। বেশি কর্মচারী ও কর্মকর্তা মানেই হচ্ছে কম কাজ; যে-কাজ একজনে চমৎকারভাবে করতে পারেন, তা হয়তো চারজনে মিলে করছেন, পাকিয়ে তুলছে জট; যে-সিদ্ধান্ত নেয়া যেতো দ্রুত, তা ধীরস্থির সিদ্ধান্তের জালে আটকা পড়েছে। অধ্যাপকেরা মাঝে মাঝেই অভিযোগ করেন যে প্রশাসনভবনের কর্মচারী ও কর্মকর্তারা তাঁদের সুযোগ পেলেই অপমান করেন। এ অভিযোগও মিথ্যে নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরা দেশের অন্য যে কোনো কার্যালয়ে গেলে যে-মর্যাদা পান, তা পান না তাঁদের নিজেদের কার্যালয়ে। শিক্ষক ও প্রশাসকদের মধ্যে একটি গোপন দ্বন্দ্ব অনেক দিন ধ’রেই চলছে। শিক্ষকরা মনে করেন কোনো কাজ নিয়ে প্রশাসনভবনে গেলে তাঁরা যোগ্য সম্মান পাবেন, কিন্তু হয়তো গিয়ে দেখেন নিম্নতম কর্মচারীটিও তাঁকে মূল্য দিচ্ছেন না। কর্মচারীরা মূল্যবান মনে করেন শক্তিমানদের, যাঁর কোনো শক্তি নেই তার কোনো মূল্য নেই। কর্মচারী ও কর্মকর্তারা জানেন কোন শিক্ষকের শক্তিমান; তাঁদের তাঁরা খুবই সম্মান করেন। সিন্ডিকেট সদসা হ’লে খুব সম্মান পাওয়া যায়। শক্তি ও সম্মানের একটি সাম্প্রতিক গল্প এমন; একজন সহযোগী অধ্যাপকের বাসার একটি সিংক ভেঙে গেছে, তাই তিনি সেখানে আরেকটি সিংক বসানোর জন্যে চিঠি লিখেছেন, যোগাযোগ করেছেন প্রকৌশল বিভাগের সাথে তাঁকে জানানো হয়েছে সিংক একবারের জনোই দেয়া হয়, ভাঙা সিংকের জায়গায় নতুন সিংক বলানোর কোনো নিয়ম নেই বিশ্ববিদ্যালয়ে। এর মাস খানের পরে ওই সহযোগী অধ্যাপক দেখেন তাঁর বাসায় একটি সিংক এসে হাজির হয়েছে। চেয়েও পাওয়া যায় নি, তা এখন নিয়ম ভেঙে উপস্থিত হয়েছে। কী কারণ? কারণ তিনি দু-একদিন আগে সিন্ডিকেটে নির্বাচিত হয়েছেন। এই হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিপুণ আমলাতন্ত্র।

বিশ্ববিদ্যালয়-প্রশাসনের উচ্চতম তিনজন আজকাল: উপাচার্য, সহউপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ নিযুক্ত হন শিক্ষকদের মাঝ থেকেই। তাঁরা ওই পদে যাওয়ার পর পরিণত হন প্রশাসকে, অনেকেই আর ফিরে আসেন না শিক্ষকতায়। অনেকে ফিরে আসার পথ রাখেন না, অনেকেই ফিরে আসাটাকে গৌরবজনক মনে করেন না, অনেকে শিক্ষকতায় থেকে প্রশাসনে গিয়ে নিজেকে ধন্য মনে করেন। যাঁরা ফেরেন না শিক্ষকতায়, তাঁরা সারা জীবন প্রতারণা করেছেন বিদ্যার সাথে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন হয়তো ভালো ছিলো শ্বেতকায়দের কালে, স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিলো পাকিস্তানপর্বে; আর অনিয়মিত হয়ে উঠেছে গত দু-শকে। শক্তিমানেরা খেয়ালখুশি মতো নিক্জেদের লোক ঢুকিয়েছেন এখানে সেখানে, ঢোকানোর জন্যে প্রয়োজনীয় পদের পর পদ সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু ওই পদগুলোর জন্যে কোনো কাজের ব্যবস্থা করেন নি। প্রশাসনভবনটির ক্রিয়াকলাপ দেখলে মনে হয় এর ওপর সম্ভবত কারো কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই; নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে খুব বিপদ বেধে যাবে, এমন একটা ভয়ে উচ্চতম প্রশাসকেরা যেনো শংকিত। ওখানে অনেক পদ জন্ম নিয়েছে বলে বিভিন্ন পদের মূল্যও কমে গেছে; এবং যে-পদটির মূলা সবচেয়ে বেশি কমেছে, সেটি রেজিস্ট্রারের পদ। রেজিস্ট্রারের একটি পদ যে বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে, এটাই এখন মনে পড়ে না। খুবই বাহুল্য বলে মনে হয় পদটিকে। ওই পদে নিযুক্ত ব্যক্তি নিশ্চয়ই নানা কাগজে স্বাক্ষর করেন, কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ পান না। তারই অধীনে থাকার কথা প্রশাসনভবনটি; তবে তিনিই এখন প্রশাসনভবনের অধীনে। একজন অসহায় রেজিস্ট্রারের অধীনে যাঁরা আছেন, তাঁরা যে খুবই স্বাধীন হবেন, কারো কাছে কোনো জবাবদিহি করবেন না, এটা বোঝা যায়, এবং এর ফলে যে-প্রশাসনিক শিথিলতা ও অরাজকতা দেখা দেবে, তা নিশ্চিত। তাই দেখা যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে; সম্ভবত সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়েই। রেজিস্ট্রারের অনেক দায়িত্বই সম্ভবত এখন উপাচার্য বা সহউপাচার্য পালন ক’রে থাকেন। এর ফলে বিশেষ ক’রে উপাচার্যের দায়িত্ব অনেক বেড়ে গিয়েছে। অনেক বছর ধ’রেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদটি হয়ে দাঁড়িয়েছে সংকটনিরসক বা ব্যবস্থাপকের পদ। চাঁদে চাঁদে নানা সংকট ঘনীভূত হয়ে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের আকাশে- মিছিলে হামলা চলে, কেউ ছাত্রাবাসের অফিস কক্ষে তালা ঝুলিয়ে দেয়, কোথাও ছাত্র আত্মহত্যা ক’রে সকলকে দুর্যোগে ফেলে যায়, কোথাও প্রাধ্যক্ষকে কাজে যোগ দিতে দেয় না ছাত্ররা;- উপাচার্য দিনরাত ব্যস্ত থাকেন এসব সংকট নিয়ে। এগুলোর সুন্দর সমাধান করতে পারলে তিনি স্বস্তি বোধ করেন, এ যাত্রা টিকে গেলেন ব’লে ধ’রে নেন; কিন্তু ভয়াবহ সংকটে একসময় অসহায় হয়ে পড়েন তিনি, বা সংকটসমাধানে আর সুখ পান না। এতো সংকটের মধ্যে প্রশাসনের দিকে তাকানো অসম্ভব হয়ে পড়ে তার পক্ষে। তাঁর মাথার ওপর প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলার এক বিশাল পর্বত। অনেক বছর এই রোগের কোনো চিকিৎসা হয় নি, রোগ বেড়েই চলছে; বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সুষ্ঠু চিকিৎসা- প্রশাসনভবনটির কক্ষে কক্ষে রোগ; এর নিরাময় দরকার।

[চার] গ্রন্থাগার
কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যার চর্চা কতোটা হচ্ছে, তা মাপা যায় তার গ্রন্থাগার দেখে। কী পরিমাণ বইপত্র আছে গ্রন্থাগারে, তার কতোটা আধুনিক কতোটা প্রাচীন, কী পরিমাণ জ্ঞানার্থী নিয়মিত আসে সেখানে, তারা সহযোগিতা পায় কতোটা, তা দেখে বোঝা যায় ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞান অর্জন ও বিতরণের প্রক্রিয়াটি; এমনকি পরিমাপ করতে পারি তার বিদ্যা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের রয়েছে দুটি ভবন;- একটি সাধারণ গ্রন্থভবন, এটিই পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার হিশেবে; অন্যটি বিজ্ঞান গ্রন্থাগার। এক সময়ের পাবলিক লাইব্রেরির সাথে আরেকটি তেতলা দালান যোগ করে গড়ে উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের মূল ভবনটি। চমৎকার স্থানে অবস্থিত এটি একটু পশ্চিমে কলাভবন, পুবে আকর্ষণীয় উদ্যান, দক্ষিণে আকর্ষণীয়তর রোকেয়া ছাত্রীনিবাস ও ছাত্রশিক্ষক কেন্দ্র। দুটি অট্টালিকার সমষ্টি এটি, পুবেরটিতে চলে প্রশাসন, পশ্চিমেরটিতে পড়াশুনো। ভবনটির চারপাশ সব সময়ই জীবনমুখর; এর ভেতর পাঠকের অভাব ঘটে প্রতিদিনই, তবে চারপাশে প্রেমিক ও প্রমোদাৰ্থীর অভাব কখনোই ঘটে না। ভবনটির দোতলা-তেতলায় রয়েছে বইপত্র, ছাত্রদের পড়াশুনোর ব্যবস্থা; একতলায় রয়েছে পড়াশুনোর কিছুটা আয়োজন; দক্ষিণে ও উত্তরে রয়েছে পুরোনো ও নতুন পত্র পত্রিকা পড়ার ব্যবস্থা। ঠিক কী পরিমাণ বইপত্র রয়েছে, তা হয়তো জানে না কেউ, যদিও কেউ কেউ বইপত্রে মনগড়া পরিসংখ্যান দিয়ে থাকেন। ভবনটিতে ঢুকলে জ্ঞানার্থী বেশি চোখে পড়ে না, দুপুরের পর তাদের সংখ্যা খুবই কমে যায়, যদিও ভবনের বাইরে প্রেমার্থীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। কিছু ছাত্রকে পড়তে দেখা যায়। দোতলা-তেতলার উত্তর দিকে, পড়ার ভঙ্গি দেখে বোঝা যায় বইয়ের পাতায় মন নেই, অন্য কোথাও পড়ে আছে হৃৎপিণ্ডটি, শুধু বাহ্যিক দেহখানি ঢুকেছে গ্রন্থাগারে। একতলার আকরগ্রন্থের কক্ষটিতে কিছু ছাত্রছাত্রী দেখা যায়; তারা বইয়ের পাতায় নিবন্ধ থাকার চেয়ে সরবে পরস্পরের দিকে নিবন্ধ থাকতেই ভালবাসে। ওই ভবনটিতে অধ্যাপকদের সাক্ষাৎ পাওয়া ভাগ্যের কথা। মাঝে মাঝে প্রভাষকদের মুখ চোখে পড়ে, সহকারী অধ্যাপকদের কারো কারো মুখও দেখা যায়; তাৰে বিখ্যাত অধ্যাপকদের এই ভবনে দেখা যায় না। গত দশ বছরে আমি তাদের মতো দু-তিনজনকে গ্রন্থাগারে দেখেছি। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ছাত্রদের কাছে গ্রন্থাগারটি প্রিয় ভবন নয়, এখানে আসার জন্য তারা আবেগ বোধ করেন না, প্রয়োজন বোধ করেন না। শিক্ষকদের শতকরা পঁচভাগ হয়তো নিয়মিত আসেন গ্রন্থাগারে, হয়তো ছাত্রদের দশভাগ আসে নিয়মিত। এ থেকেই অনুমান করতে পারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যার অবস্থাটি বিশেষ ভালো নয়; এখানে জ্ঞান হয়তো মোটেই সৃষ্টি হচ্ছে না, আর অর্জনও বেশি হচ্ছে না। বিজ্ঞান গ্রন্থাগাটিরতেও জ্ঞানীদের যাতায়াত কম। ওটা সব সময় নিঝুম হয়ে পড়ে থাকে, ভেতরে মানুষের ছায়া মাঝে মাঝে দেখা যায়। মূল ভবনটির দোতলা-তেতলায় কয়েক হাজার বই আছে; বিশ্ববিদ্যালয়ে যতো বিদ্যা দান করা হয় প্রায় সমস্ত বিদ্যার বই এ-দু-তলায়। তাই কোনো বিদ্যারই পর্যাপ্ত বই নেই। কোনো পুরোনো বই খুঁজলে পাওয়া যায় না, নতুন বই খুঁজলে পাওয়া যায় না; তবে যে-বই খুঁজছি না তা পাওয়া যায়। অনেক বাজে বই প’ড়ে আছে থরে থরে, কিন্তু কাজের বই নেই। প্রয়োজনীয় বই পাওয়ার জন্য গ্রন্থাগারটি নয়, গ্রন্থাগারটি একটি এলোমেলো বইয়ের সংগ্রহাগার। ক্যাটেলগে নাম আছে বইয়ের, কেউ সে-বই ঋণ করে নি, কিন্তু সে-বই কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই ভবনটিতে ঢোকার সাথে সাথে বিরক্তি জন্মে।

ভবনটির দোতলা-তোতলায় শিক্ষকেরা ও গবেষকেরা ঢুকতে পারেন, বই খুঁজে নিতে পারেন নিজেরা। তবে ওখানে যাওয়াই একটা শাস্তি। কোনো পাখা ঘোরে না ওখানে, তাই এখানে যাওয়ার সাথে সাথে দোজখের গরম পাঠককে পোড়ায়। আলো এমনভাবে জ্বলে যেনো মহাজগতের এ-প্রান্তে সে-প্রান্তে জ্বলছে দু-তিনটি তারা। তারপর রয়েছে বইয়ের মলাটে ধূলোর প্রাগৈতিহাসিক আস্তরণ। তাক থেকে বই টানার সঙ্গে সঙ্গে একরাশ আণবিক ধুলো ছুটে আসে পাঠকের দিকে, আক্রমণ করে তার চোখ ও নাসিকামণ্ডলকে; তার হাতের তালুয় এমন কালি জমে যে মনে হয় যেনো তিনি এইমাত্র চুলা পরিষ্কার করে এলেন। কয়েক মাস নিয়মিত ওই ভবনে বই খুঁজলে ধুলোবিরাগবোগে আক্রান্ত না হয়ে থাকা অসম্ভব।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অনেকেই এ-রোগে ভোগেন, সর্দিগ্রস্ত হন, এর মূলে রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার। দোতলা-তেতলায় পড়াশুনোর একটু ব্যবস্থা রয়েছে, গবেষকদের জন্যে ছোটো কক্ষ রয়েছে। ওখানে পড়াশুনা করা অসম্ভব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এতো বছরেও জ্ঞানার্থীদের জন্যে একটি আরামদায়ক গ্রন্থাগার সৃষ্টি করতে পারে নি। চারদিকে অনেক কিছুই শীততাপনিয়ন্ত্রিত হয়ে যাচ্ছে, চণ্ডালেরাও শীততাপনিয়ন্ত্রিত না হয়ে কর্ম সম্পন্ন করতে পারছেন না; কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে পাখাগুলোও ঘুরে না, সেখানে ঠিকমতো আলোও জ্বলে না। গ্রন্থাগারটিকে কি মুক্ত করা যায় না আদিম ধূলোকণা থেকে? এখানে কি জ্বালা যায় না স্নিগ্ধ আলো? শীতাতপনিয়ন্ত্রিত? এটা কালোবাজারিদের জন্যে; জ্ঞান চর্চার মতো একটা বাজে ব্যাপারে টাকা ব্যয় করাটা বাড়াবাড়ি মনে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের সম্ভবত বই খাওয়ার অভ্যাসও রয়েছে; বিশ বছর আগে যে-বই ছিলো, তা তো পরিপাক হয়ে গেছেই; এমনকি কয়েক সপ্তাহ আগে যে-বই পড়েছি, কীভাবে যেনো তাও নিরুদ্দেশ হয়ে যায় এখান থেকে। দোতলা-তেতলায় কিছু কর্মচারী রয়েছে, যারা পাঠকদের বই এনে দেয়। আমাদের ছাত্রাবস্থায় তাদের অনেকে এমন দক্ষ ছিলো যে বইয়ের নাম বললেই নিয়ে আসতো, কেউ কেউ আমাদের মুখ দেখলেই নিয়ে আসতো যে-বইটি পড়বো। এখন সেখানে অনেককে দেখি, যারা বানান ক’রে বইয়ের নাম পড়ে, যাদের কাছে রবীন্দ্রনাথও অচেনা। শুনেছি শক্তিমানদের বাড়ির গৃহপরিচারকেরা এখন এসব চাকুরি পাচেছ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের অসংখ্য রোগের মূল কারণটি সম্ভবত হচ্ছে কোনো গ্রন্থাগারিক নেই। কয়েক বছর আগেও দেখেছি কোনো কোনো অধ্যাপক পালন করেছেন গ্রন্থাগারের দায়িত্ব। ওই অধ্যাপকদের অনেকে দায়িত্ব পাওয়ার আগে ও পরে কখনো পড়াশুনোর জন্যে প্রন্থাগারে আসেন নি। তারা কিছু বাড়তি বেতন পেয়েছেন, কিছুটা সর্দারি করেছেন, কিছুটা ক্ষতি করেছেন গ্রন্থাগারের। কয়েক বছর আগে একজন গ্রন্থাগারিক নিযুক্ত হয়েছিলেন, যিনি এক বছরেই পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এই গ্রন্থাগারিকের নানা বাতিক ছিলো, কাজ টি করারও একটা নিজস্ব পদ্ধতি ছিলো। এখন তিনি নেই, আছেন ভারপ্রাপ্ত গ্রস্থাগারিক। শুনেছি গ্রন্থাগারের ভেতরে শক্তির লড়াই বেশ তীব্র; এতে কেউ হয়তো জিতবেন, কিন্তু গ্রন্থাগারটির বিজয়ের কোনো সম্ভাবনা নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে-কোর, তার শিক্ষকের যে-সংখ্যা, তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের এখনকার গ্রন্থাগারের থকে পাঁচগুণ বড়ো গ্রন্থাগার দরকার। পুরোনো মূল্যবান বইপত্র এখন সংগ্রহ করার উপায় নেই, কিন্তু সেগুলোর প্রতিলিপি বা মাইক্রোফিল্ম সংগ্রহ করা খুবই দরকার; এবং সংগ্রহ করা দরকার সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ নতুন বই। গ্রন্থাগারটি চরিত্রে ছাত্রদের গ্রন্থাগার; এটি গবেষকের গ্রন্থাগার নয়। এটিকে গবেষকের গ্রন্থাগার করে তোলা দরকার অবিলম্বে এমন একটি গ্রন্থাগার চাই যেখানে পাবো প্রয়োজনীয় সমস্ত পাঠ্যবস্তু, পাবো জ্ঞানার্জনের পরিবেশ, পাবে আবহাওয়া, ও দরকারি সাহায্য। এর সামান্যই পাওয়া যায় গ্রন্থাগারে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার এখনো একটা মহাবিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার: বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার নয়। তাহলে কি আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ববিদ্যার পোশাকে বিতরণ ক’রে চলছি মহাবিদ্যালয়ের বিদ্যা?

[পাঁচ] শিক্ষকদের দুরবস্থা
দারিদ্র্য আমাদের জাতীয় পতাকা, দারিদ্র্য আমাদের জাতীয় সঙ্গীত। দারিদ্র্যের অভাব নেই বাঙলায়; তবে দরিদ্ররা সাধারণত নিরক্ষর, শিক্ষিতরা সাধারণত গরিব নয়। এ সাধারণ সূত্রেরও ব্যতিক্রম রয়েছে। আমাদের সমাজে রয়েছে একটি শিক্ষিত দরিদ্র শ্রেণী; শ্ৰেণীটি বিখ্যাত ও ঐতিহাসিকভাবে দরিদ্র:- তারা শিক্ষক। শিক্ষিত ও দরিদ্র শাশ্বত সম্পর্কে জড়িত এখানে শিক্ষকমাত্রই বিবাহিত দরিদ্রের সঙ্গে, এ-বিবাহে কোনো বিচ্ছেদ নেই। শিক্ষিত দরিদ্রদের দেখতে হ’লে তাকাতে হবে আমাদের প্রাথমিক, উচ্চ ও মহাবিদ্যালয়ের দিকে; আর যদি মন ভ’রে দেখতে চাই দেশের উচ্চতম শিক্ষিত দরিদ্রদের, তবে তাকাতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে। উচ্চতম শিক্ষা কীভাবে দেখা দেয় অভিশাপরূপে, ও মানুষকে পরিণত করে উচ্চতম দরিদ্রে, তার রূপ দেখতে পাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মুখের দিকে তাকিয়ে। তাঁদের অধিকাংশই দেশের শ্রেষ্ঠ মেধাবী, প্রথম হয়েছেন শ্রেণীতে-শ্রেণীতে, বাক্স ভরে ফেলেছেন প্রথম বিভাগ ও শ্রেণীর অভিজ্ঞানপত্রে, ডক্টরেট করেছেন অনেকেই; এবং আখেরে পরিণত হয়েছেন প্রথম শ্রেণীর দরিদ্রে। প্রথম শ্রেণীর অভিজ্ঞানপত্রগুলোকে নর্দমায় ছুঁড়ে ফেলে তারা যদি দারোগা হতেন, তবে চমৎকার থাকতেন; যদি আমলা হতেন, জীবনটা তাদের উত্তম হতো; কালোবাজারে নামলে ঝকঝকে জীবন কাটাতেন; প্রভুপদনির্ভর রাজনীতি করলে শক্তি ও সম্পদে থাকতেন; এমনকি কাঁচাবাজারে মুদিদোকান দিলেও উচ্চতম শিক্ষিত দরিদ্রের কলঙ্ক বহন করতে হতো না তাঁদের। আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র শিক্ষকদের দরিদ্র দেখতে ও দরিদ্র রাখতে পছন্দ করে। এ সমাজ বিশ্বাস করে যে শিক্ষিত বস্তিতে থাকবে আর কালোবাজারি থাকবে বারিধারায়। এ-সমাজ একজন সচ্ছল শিক্ষক দেখলে মর্মাহত হয়, আর দরিদ্র শিক্ষক দেখলে আমাদের নৈতিকতা ও সামাজিক মূল্যবোধ অটল আছে জেনে স্বস্তি পায়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এ-সমাজ ভিখিরিদের শ্রেণীতেই ফেলে, তারা একদিন বিনাচিকিৎসায় মারা যাবে ভেবে এ-সমাজ নিশ্চিন্ত; উচ্চ ও মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দেখে করুণার চোখে; আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটু সমীহ করে, কিন্তু সমাজ জানে যে শিক্ষক হচ্ছে শিক্ষক। আমাদের প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের শ্রেণীগত কোনো পার্থক্য নেই, মাত্রার পার্থক্য রয়েছে কিছুটা যে-মেধাবী তরুণটি দারোগা বা শুল্কপরিদর্শক বা আমলা না হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকলো আজ, আগামী তিরিশ বছরে সে অনেক জ্ঞান অর্জন করবে, ডক্টরেট নেবে, অধ্যাপক হবে; কিন্তু কখনো স্বচ্ছল জীবন পাবে না। তার সারাটি জীবন কাটবে দুর্দশায়। বিশ্ববিদ্যালয়, অর্থাৎ সমাজ ও রাষ্ট্র একজন অধ্যাপককে কী দেয়? কিছুই দেয় না। প্রভাষক বা সহকারী অধ্যাপকের কথা বলছি না, বলছি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পদ অধ্যাপকের কথা ও বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সামান্য বেতন দেয় আর কিছু দেয় না। বিশ্ববিদ্যালয় তাকে বসার জন্যে একটি ছোটো নোংরা ঘর দেয়, একটা সস্তা চেয়ার দেয়, একটা ময়লা টেবিলে দেয়। শিক্ষকদের সিগারেট খাওয়া সম্ভবত নিষেধ, তাই তাকে একটা ছাইদানিও দেয়া হয় না। টেলিফোন? না, অধ্যাপকের কোনো টেলিফোন দরকার নয়; টেলিফোন দরকার কেরানির। তার বাসায় টেলিফোন? এটা এক চরম অনৈতিক ভাবনা। অধ্যাপকের বাসায় কেনো টেলিফোন থাকবে? ওটা খাকবে প্রয়োজনীয় কর্মীদের বাসায়। অধ্যাপক অপ্রয়োজনীয়, তার বাসায় টেলিফোন অত্যন্ত অপ্রয়োজনীয়। প্রশ্ন হচ্ছে তাঁর বাসাই আছে কিনা? প্রভাষক তো সামান্য বস্তু, একজন অধ্যাপককে বাসা দেয়াও বিশ্ববিদ্যালয় ও সমাজের দায়িত্ব নয়। তিনি কোথায় থাকবেন? বস্তিতে থাকতে পারেন, তাতে সমাজের কোনো আপত্তি নেই। যানবাহন? অধ্যাপকদের আবার যানবাহন কিসের? তিন হাঁটবেন, কুলোলে রিকশায় চড়বেন; নইলে বাসে চাপবেন। যে-অধ্যাপক গাড়ির কথা ভাবেন, তিনি পাপিষ্ঠ, নৈতিক স্খলনগ্রস্ত। গাড়ি আমলাকামলাদের জন্যে, অধ্যাপকদের মরার জন্যে সরকারি হাসপাতালে গণকক্ষ রয়েছে। সমাজ একজন অধ্যাপককে কিছু টাকা দিয়ে বিদায় করে দেয়, পথ দেখতে বলে, ও দিয়ে যেভাবে পারো মরতে বলে। সমাজ অধ্যাপকদের আশ্রয়দাতা নয়, অথচ তার কাছে আশা করা হয় শ্রেষ্ঠ জ্ঞান। হ্যাঁ, বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকটি ধান্দাবাজ অধ্যাপক মিলবে, যারা অধ্যাপক নামটি ভেঙে খান; ছোটেন প্রজেক্ট থেকে প্রজেক্টে, দালালি থেকে দালালিতে। তাঁরা ভালো আছেন, কিছুটা ভালো আছেন; কিন্তু দারোগার মতো ভালো নেই।

অন্যান্য পেশার সাথে তুলনা করলে ভয়াবহভাবে ধরা পড়ে অধ্যাপনার শোচনীয়তা। তিনটি পেশার তিনব্যক্তির মধ্যে একটু তুলনা করা যাক, দেখা যাক এ তিনজনের জন্যে কী ব্যবস্থা করেছে আমাদের সমাজরাষ্ট্র? তাদের একজন সচিব, একজন বিচারপতি, একজন অধ্যাপক। সচিব ছাত্রজীবনে মেধাবী ছিলেন, যোগ দিয়েছিলেন আকর্ষণীয় সিভিল সার্ভিসে। শুরু থেকেই তিনি রয়েছেন নানা সুবিধাজনক পদে, সেবা করেছেন প্রতিটি সরকারের। বেতন তিনি অধ্যাপকের থেকে বেশি পান নি, কিন্তু আনুষঙ্গিক সুবিধা পেয়েছেন ও নিয়েছেন একশো গুণ। অবৈধ আয়ের তার সুযোগ ছিলো অশেষ, তিনি সম্ভবত তার সদ্ব্যবহার করেছেন। সচিব পদে পৌঁছাতে পৌঁছাতে তিনি অঢেল সম্পদশালী হয়েছেন যদিও মাসিক বেতন তার ছ-হাজার টাকা। তিনি তার বেতনের কথা ভাবেনই না, এতে তার চারদিনও চলে না। তিনি যে-সমস্ত সুযোগসুবিধা পান ও নেন, তার মূল্য লাখ টাকা। আরো আছে লাখ লাখ টাকা, নাকি কোটি টাকা? তিনি সারাজীবন কি দিয়েছেন সমাজরাষ্ট্রকে? কিছুই দেন নি তিনি, শুধু নিয়েছেন; অবসর পাওয়ার পরও নেবেন। বিচারপতি ছাত্রজীবনে হয়তো মেধাবী ছিলেন না, তাই গিয়েছিলেন আইনের দিকে। ওকালতি কারে তিনি অঢেল সম্পদ জমিয়েছেন, পরে বিশেষ বয়সে সম্মানের জন্যে বিচারপতি হয়েছেন। তার বেতন বেশ গোপন ব্যাপার, তবে তা বিশ হাজার টাকার মতো হবে। তাকে বাড়িভাড়া দেয়া হয় পনেরো হাজার টাকা; গাড়ি, ফোন, সহকারী, প্রহরীর সুযোগ পান তিনি বিনে পয়সায়; অবসরের পরও পাবেন। সব মিলে মাসিক আয় তাঁর লাখ টাকার মতো। সমাজরাষ্ট্রকে তিনি কী দিয়েছেন? এখনো কিছু দেন নি; তবে অবসর নেয়ার পর রাজনীতিতে যোগ দিয়ে দেশকে কিছু দেয়ার কথা হয়তো ভাবছেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হয়তো পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়েছেন, গবেষণা করেছেন, পিএইচডি করেছেন। কিছু বইপত্র লিখেছেন। তাঁর বেতন পাঁচ হাজার সাতশো থেকে ছ-হাজার হ’তে পারে। তিনি বাড়িভাড়া পান আড়াই হাজার টাকার মতো, আর সব মিলে পান তিন-চারশো টাকার মতো। তিনি সমাজরাষ্ট্রকে কী দিয়েছেন? তিনি জ্ঞান দিয়েছেন, যা ছাড়া এ-বিকল সমাজ আরো বিকল হতো। ফাইল লেখা বা রায় লেখা সম্ভবত জ্ঞান দেয়ার থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ; তাই সচিব ও বিচারপতিকে সুযোগসুবিধায় ভ’রে দেয় সমাজ, আর একজন অধ্যাপককে দেয় আট-ন হাজার টাকা। তারা তিনজন বাস করেন একই সমাজে, একই বাজার থেকে চাল কেনেন, একই সড়কে চলেন (না, অধ্যাপক তাদের সব সড়কে চলতে পারেন না), একই রোগে ভোগেন; কিন্তু যাপন করেন ভিন্ন জীবন। দুজন স্বর্গে থাকেন, অধ্যাপক থাকেন নরকে। অধ্যাপকের অপরাধ তিনি পেশা হিসেবে নিয়েছেন শিক্ষকতাকে। তিনি অন্য কোনো পেশায় গেলে সম্পদে থাকতে পারতেন, যেমন সস্পদে আছেন তার থেকে নিকৃষ্টরা। দুর্দশাগ্রস্ত একজন অধ্যাপকের কাছ থেকে কী প্রত্যাশা করতে পারি আমরা? শ্রেষ্ঠজ্ঞান, বিজ্ঞান, মহৎ জ্ঞান? এসব কিছুই আশা করতে পারি না। আমাদের শিক্ষার কর্কটরোগ আমাদের শিক্ষকদের দুরবস্থা। এ-রোগের চিকিৎসা না হলে এরপর প্রথম শ্রেণী পেয়ে তরুণরা দারোগা হবে, আর তৃতীয় শ্রেণী পেয়ে অধ্যাপক হবে। তখন আমরা পৌঁছোবা আমাদের গন্তব্যে, যখন আমাদের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় দরকার হবে না, বিশ্ববিদ্যালয় থাকবে না।