কালের কৌতুক

ওগো আধুনিকযুগবতী, আমি তোমার কালের
বছর পনেরো পিছনে থেকেও টাটকা হালের
খানিক খবর আভাসে বাতাসে পাই;
না-জেনে আমার নয়নে করেছে ঋণী
পন্থচারিণী যত বালিগঞ্জিনী,
তারা, আমি জানি, তারই অবতারণাই
রোদ্দুরে লাগে কত-না রঙের ছোপ,
ম্যাজেণ্টা, নীল, হলদে, হেলিওট্রোপ,
দৃপ্ত স্ববশ নিঃশঙ্কিত চলা;
পাঁচটি যুবক দাড়ায় আচম্বিতে,
ট্রামে উঠে তুমি ব’সে পড়ো নিশ্চিতে:
দেখি, আজও আছে যে-অবলা সে-অবলা।
রক্ত-রঙের টুকটুকে দুটি ঠোঁটে
বিনাচিন্তায় বুকনির খই ফোটে,
যুক্তি জোগায় চোখের লেখার কালো;
সে-লাল, সে-কালো যদিও প্রসাদ যাচে
গন্ধবণিক রাসায়নিকের কাছে,
তবু ভালো লাগে- কবুল করাই ভালো।
যেটুকু মুখ্য, যত্নে নিয়েছো এঁকে,
অবশিষ্টেরে রত্নে দিয়েছো ঢেকে;
নেই কোনো ত্রুটি, কিছু নয় এলোমেলো:
রেখেছে লুকায়ে লম্বা চুলের লজ্জা
অতিকুঞ্চিত চতুর কবরীসজ্জা;-
দেখে-দেখে চোখে সবই যেন স’য়ে এলো।
শুধু কটাক্ষ রাখখানি অস্ত্রাগারে;-
ভতৃঘাতক হ’লেও-বা হ’তে পারে
(কণ্টকময় কঙ্কণ কোনোদিন,
কণ্ঠে কনকরজ্জু রয়েছে রাখা,
কর্ণে তোমার যুগল রথের চাকা;-
ধন্য! তবু-যে মুখশ্রী মসৃণ!
ভেবো না তোমার করতে বসেছি নিন্দে;
তোমারে দেখেই তারে আমি পারি চিনতে,
যখনই যে-রূপে যেমনই দাও-না দেখা:
ইতিহাস যত বদলাক, অন্তত
আমার মনেই আছে-তো মনের মতো;
হঠাৎ চোখেও তারই যেন পাই দেখা।

একদা, যখন তরুণ ছিলাম, কত
কালো-কালো চোখে করেছি ইতস্তত:
বলেছি, ‘তোমারে লেগেছে আমার ভালো।’
বলা বাহুল্য, বলেছি তা মনে-মনে,
অথবা কবিতা বানায়ে আপন মনে,
মায়াবী টেবিলে জেলে স্বপ্নের আলো।
ওগো আধুনিকযুগবতী, তারা তোমার চালের
কিছুই শেখেনি, তবু সে-যুগের নতুন কালের
আহ্লাদি ডালে তারা ছিলো মঞ্জরী;
যেখানে আমার যৌবন গেছে ঝ’রে,
সে-বন তাদের, তারা ছিলো আলো করে:
প্রত্যেকে ফুল, প্রতি ফুল অপ্সরী।
তাদের ভঙ্গি, তাদের লাজুক চলা,
নিশ্বাস নিয়ে অল্প একটু বলা,
আজ আর নেই, আছে শুধু মনে পড়া;
লাজুক রুলির আওয়াজ যে-হাতে আরো
লাজুক লাগতো, মনে নেই আজ তারও:
আমার বুকেরে তবু সে জপয় ছড়া।
সেই ঝিরিঝিরি হাওয়া-শাড়ি, হায়, কোথায়,
কোথায় ব্যস্ত আঙুল মস্ত খোঁপায়;
কোথা সিন্দূর, কোথা আশ্রয়-শাখা!
যদি সে-পাখিরা আর না-তাকায় ফিরে,
তবু থাকবেই আমার মনের নীড়ে,
থাকবে আমার মনে-পড়া রঙে আঁকা।
তাই বলি, ওগো আধুনিকযুগবতী,
প্রতিমা ক্ষণিকা, দেবী সে-তো শাশ্বতী;
লক্ষ ফসল, কিন্তু সে একই খেত:
যে-আঁচল ঐ মিলালো পিছের মোড়ে,
আবার তোমার সামনেই, দেখি, ওড়ে
কম্পিত তারই বঙ্কিত সংকেত।

তারপরে- যদি তত ভালো না-ই লাগে
তোমার মুখের অঙ্কিত সংরাগে,
আত্মচেতন অভিমান-অভিনয়,
জেনো, তার দায় তোমার-তো নয় কিছু;
তোমারে ছাড়ায়ে আমি-যে তাকাই পিছু,
আমারই সে-দোষ, আমারই সে-অবিনয়।
আমাদের নিয়ে কালের এ-কৌতুক চলবেই,
ভালো লাগুক বা না-লাগুক;
মেনে নিতে হবে চুপ ক’রে অন্তত:
বৃথা জিজ্ঞাসা দ্বিধাখণ্ডিত পথে
বর্তমানেরে, অতীতে, ভবিষ্যতে;-
সে আছে মনেই, সেই-যে মনের মতো।