বাঙালির ভবিষ্যৎ

প্রতিটি পতঙ্গেরই সম্ভবত ভবিষ্যৎ রয়েছে, তবে, মনে ভয়ঙ্কর প্রশ্ন জাগে বাঙালির কি রয়েছে ভবিষ্যৎ? মাত্র এগারোটি বছর পর একটি নতুন শতক হাজির হবে পৃথিবী জুড়ে; অনেক জাতি সমারোহে সগৌরবে পা রাখবে নতুন শতকে, কিন্তু বাঙালি কি কোনো গৌরব বোধ করবে এই শতকে পা রাখতে? অনেক জাতি ওই শতকে হাজির হবে চমৎকার সমাজ ও রাজনীতি নিয়ে; তাদের থাকবে উন্নত বিজ্ঞান, আকর্ষণীয় সাহিত্য, শিল্পকলা, দর্শন। ওই সময়ে বাঙালির কী থাকবে? একটি সুন্দর সমাজ ও রাজনীতি নিয়ে ওই শতকে উপনীত হ’তে পারবে বাঙালি, থাকবে তার কোনো সাহিত্যিক, বৈজ্ঞানিক, শৈল্পিক গৌরব? তখন হয়তো বাঙালির সংখ্যা দ্বিগুণ হবে: বাঙালির মাথা বাঙালি খাবে। তাদের অধিকাংশেরই থাকবে না খাদ্য ও বাসস্থান। রাজনীতি কি রূপ নেবে তখন? একটি গণতান্ত্রিক রাস্ট্র নিয়ে আমরা হাজির হ’তে পারবো একুশ শতকে, নাকি তখনো কাঁধে চেপে থাকবে স্বৈর দৈত্য? সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে ন্যায়, নীতি, শৃঙ্খলা, নাকি বর্তমানের মাৎস্যন্যায় বাড়বে আরো দশগুণ? বিজ্ঞান দেখা দেবে তখন বাঙলাদেশে, নাকি তখণো বাঙলা বিজ্ঞানীরা আদিম বিজ্ঞান শিখতে ব্যস্ত থাকবে? বিকাশ ঘটবে সাহিত্য ও শিল্পকলার? আশির দশকে সাহিত্য ও শিল্পকলা লোপ পেতে বসেছে, এর কি ঘটবে নবজাগরণ? দর্শন নেই, তাই এক দশকে কোনো দর্শনের উদ্ভব ঘটবে ব’লে মনে হয় না। বাঙালি পৃথিবীর সবচেয়ে আশাবাদী জাতি, আশা এখানে খুবই প্রশংসিত সামগ্রী। আমাদের সৃষ্টিশীলতায় সমস্ত শাখায় ছুটে চলে আশায় অসংখ্য স্রোত; সমাজনেতারা আশার পুরোহিত, আর রাষ্ট্র যাদের অধিকারে, আশাই তাদের স্রোত; প্রধান পণ্য- বিনামূলো তারা আশা বিক্রি ক’রে থাকে। তাই সবাই সম্মিলিত আশা পোষণ করতে পারে যে বাঙালির ভবিষ্যৎ খুবই উজ্জ্বল; তারা সুড়ঙ্গের অপরপ্রান্তে আলোর বন্যা দেখতে পারে, তবে আমার অন্ধ চোখে কোনো শিখা ঢুকছে না। একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন ভবিষ্যৎ আমি দেখতে পাই, যাকে সরল বাঙলায় প্রকাশ করলে দাঁড়ায় যে বাঙালির কোনো ভবিষ্যৎ নেই।

বাঙালির কাধের দৈত্যটির কথাই ধরা যাক। কাঁধ থেকে এটি সহজে নেমে যাবে, এমন ভাবার কোনো কারণ নেই, বরং এটি নিশ্চয় এখন স্বপ্ন দেখছে কমপক্ষে আরো এগারো বছর স্কন্ধ আরোহণ সুখ উপভোগের। দেশকল্যাণের যে-কামনা নিয়ে শাসকসম্প্রদায় এসেছে, সে-কামনা আট বছরে তাদের মেটে নি; তারা হয়তো ভাবছে অন্তুত বিশ শতকটি তাদের দরকার, তাহলে দেশটিকে তারা চমৎকারভাবে উত্তীর্ণ ক’রে দিতে পারবে একুশ শতকে। কিছু ব্যবস্থা তাদের নিতে হবে এগারো বছর টিকে থাকার জন্যে; এর জন্যে কিছুটা পীড়ন করবে, অনেক আদর করবে, আরো অনেক দালাল বানাবে; বিরোধী দলগুলো থেকে কুমড়োর ফালির মতো কোনো অংশ কেটে নিয়ে দেশকে গণতান্ত্রিক ক’রে তুলবে। অনেক বিরোধী বীর হয়ে উঠবে একনায়কের বিশ্বস্ত বান্দা। তাই মনে করতে পারি বাঙালি একুশ শতকে হাজির হবে স্বৈর দৈত্যকে কাঁধে নিয়েই, তখন তার মেরুদণ্ড পুরোপুরি বেঁকে যাবে, গণতন্ত্রের কোনো স্বপ্ন থাকবে না। জয়, জয়, মহানায়ক ধ্বনি তুলে মহাদাস বাঙালি প্রবেশ করবে একুশ শতকে। সমাজের অবস্থা কেমন হবে? বাঙালির সংখ্যা যদি দ্বিগুণ হয়, তখন ওই সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে কেউ থাকবে না। বাঙালির খাদ্য খাকবে না, বাসস্থান থাকবে না, বিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয় তখন থাকবে কিনা সন্দেহ। সেদিন পুলিশ বাহিনী পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে, বা এখন তারা যাদের দমনের জন্যে নিয়োজিত, যোগ দেবে তাদেরই দলে। দিকে দিকে খুনখারাবি চলতে থাকবে, ধর্ষণ হয়তো হয়ে উঠবে চিত্তবিনোদনের প্রধান পদ্ধতি। কারো ঘরে থাকবে না কোনো ধনসম্পদ। পাড়ার নিয়ন্ত্রকেরা এসে চাইলেই আনন্দের সাথে তাদের হাতে তুলে দিতে হবে টেলিভিশনটি, যদি কন্যাটিকেও চায় তাহলেও উত্তেজিত হওয়া সম্ভব হবে না। রাস্তায় গাড়ি চলার জায়গা থাকবে না হয়তো, কারণ সমস্ত রাস্তাই ব্যবহৃত হবে উদ্বাস্তুদের আবাসিক এলাকারূপে। ওই সমাজে থাকবে কোনো হাসপাতাল? সরকার একুশ শতকের মধ্যে সবার জন্যে স্বাস্থ্য ব’লে যে-শ্লোগানটি দিয়ে তৃপ্তি পায়,, সেটি সংশোধিত হয়ে যাবে; সবার জন্যে অসুস্থতাই হবে তখন সরকারি সংস্থানীতি। স্বাস্থ্যের বদলে অসুস্থতাই হবে বাঙালির জন্যে স্বাভাবিক; সুস্থ মানুষ দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠবে, হয়তো তাদের পাওয়া যাবে দেশের কোনো কোনো সুরক্ষিত এলাকায়। বিদ্যালয়ে তখন কে পড়বে, কে পড়াবে, কারা পড়বে ও পড়াবে বিশ্ববিদ্যালয়ে? পড়াশুনোর কোনে মূল্যই থাকবে কিনা সন্দেহ। মন্ত্রী হওয়ার জন্যে নিরক্ষরতা হয়তো তখন সরকারিনীতি হিসেবে গৃহীত হবে, লেখাপড়ার সাথে যাদের কোনো সম্পর্ক আছে তারা পুরোপুরি বিতাড়িত হবে রাজনীতি ও প্রশাসন থেকে। লেখাপড়া সমাজবিরোধী কাজ ব’লে গণ্য হতে পারে সে-সময়। গুণ্ডামির খুবই বিকাশ ঘটবে, কারণ ওই প্রতিভা ছাড়া কিছুই পাওয়া যাবে না। একুশ শতকে পা দেয়ার সময় হয়তো বাঙলার বিভিন্ন এলাকা থাকবে বিভিন্ন গুন্ডার অধীনে, তারা রাষ্ট্রের মধ্যে রাষ্ট্র শাসন ক’রে যাবে। ধর্মকর্মের খুবই বিকাশ ঘটবে সে-সময়। ভেতরে পাপ যখন বাড়ে, বাইরে তখন ধর্মের পতাকা খুবই ওড়াউড়ি ক’রে, এবং একুশ শতকে বাঙালি হয়তো ঢুকবে একটি ধর্মরাষ্ট্র মাথায় ক’রে। আশির দশকে দেশের কোণায় কোণায় গজিয়ে উঠছে পীরেরা, আগামী দশকে দেশ ভ’রে যাবে ভণ্ডপীরে দরগা ও খানকায় ছেয়ে যাবে দেশ, হয়তো পীরসভ্যতা নামে একটা নতুন সভ্যতার পত্তন হবে।

বিজ্ঞান কি থাকবে একুশ শতকে পা দেয়ার সময়? বাঙালির বিজ্ঞানচর্চা এখন অনেকটা হাসাকর, আগামী দশকের শেষ দিকে এটা বাতিল হয়ে যাবে। বাঙালির পক্ষে, বাঙলাদেশে থেকে, কোনো মৌলিক আবিষ্কারই সম্ভব নয়, এটা সবাই বোঝে, একুশ শতকে প্রবেশের সময় তা বিজ্ঞানীরাও বুঝে ফেলবে। বাঙালির বিজ্ঞানচর্চার আর দরকার পড়বে না। দর্শন? এটা এখানে ছিলো না, এখন নেই, ভবিষ্যতে একেবারেই থাকবে না। সাহিত্য থাকবে? আশির দশকে সাহিত্য ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, কবিতা হয়ে উঠেছে দালালি ও গালাগালি, আগামী দশকে দালালি ও গালাগালিই ছোটাবড়ো পঙ্‌ক্তিতে ছাপা হবে। তবে দালালির পরিমাণ বাড়বে, অনেক বিদ্রোহী কবি দালালির মহাকবিতা লিখবে। চিত্রকলা থাকবে? এটা থাকবে খুবই বেশি পরিমাণে, কারণ ছবি ছাড়া আজকাল কাজ চলে না। একুশ শতকে প্রবেশের সময় চিত্রকরেরা দিকে দিকে আকতে থাকবে দৈত্যের সুন্দর মুখ। কামরুল হাসান ইয়াহিয়ার যে-মুখটি বিকৃত ক’রে দিয়ে গেছেন, সেটিকে চিত্রকরেরা আবার সুন্দর ক’রে তুলবে, ওই মুখকে দেখাবে চাঁদের মতো। কামরুল হাসান তখন নিষিদ্ধ হয়ে যাবেন, তার অপরাধ তিনি দৈত্যকে দৈত্যরূপে এঁকেছিলেন।

আমি বাঙালির এমন ভবিষ্যৎ দেখতে পাই; একুশ শতকে বাঙালি প্রবেশ করবে এমনি রূপে। বিভিন্ন জাতি একুশ শতকে উপহার দেবে সভ্যতা, বাঙালি দেবে অসভ্যতা; তারা উপহার দেবে মনুষ্যত্ব, বাঙালি দেবে মনুষ্যত্বহীনতা। তারা বিকাশ ঘটাবে মানুষ ও সভ্যতার, আর বাঙালি দু-হাতে রুখবে মানুষ ও সভ্যতার বিকাশ।