বিদায়

আজিকে আকাশে মেঘ-মেঘ যেন, বাতাস বহিছে ধীরে,
এসগো সজনী মোরা দুইজনে বসিগে নদীর তীরে।
ছোট পেঁয়ো নদী, দুইধারে লিখি নতুন ধানের লেখা,
কল-ঢেউ সনে পড়িয়া চলেছে বুকে আঁকি তারি রেখা।
চখা আর চখী গলাগলি ধরি ফিরিছে বালুর চরে,
বাতাস দুলিছে তারি সাথে সাথে ধূলার বসন ধরে।
দূর পশ্চিমে হেলিয়া পড়েছে অলস দিনের বেলা,
মেঘে আর রঙে, রঙে আর মেঘে করে মেঘ-রঙ্-খেলা।
কুন্দ ফুলের মালাগাছি আজ উড়ায়ে গগন-গায়,
চরের পাখীরা ফিরিয়া চলেছে সুদূর নীড়ের ছায়।
দিগন্ত-জোড়া দূর বালুচর, নিজ্ঝুম নিরালায়,
তাহার উপরে অলস দিনের আলো-ধারা মুরছায়।
থাকিয়া থাকিয়া চরের বিহগ উঠিতেছে ডাকি ডাকি,
এ মূক চরের বেদনারে সে যে ভাষায় বাঁধিছে নাকি?
দূরে আলো-জ্বালা কলাবনছায়ে কৃষাণের ঘরগুলি,
রহিয়া রহিয়া, উঠিতেছে যেন মৃদু কোলাহলে দুলি।
এসগো সজনী এইখানে বসি মুখখামুখি দুই জনা,
এ উহার পানে শুধু চেয়ে রব, কোন কথা বলিব না।
তোমার অধরে পড়িবে ঢলিয়া অলস দিনের আলো।
আমার মুখেতে কুহেলী রাতের আঁধিয়ার কালো কালো।
আমি চেয়ে রব তব মুখ পানে, তুমি মোর মুখ পানে,
মাঝে অনন্ত কথার সাগর কথা কবে কানে কানে।-
আমি চেয়ে রব তব মুখ পানে- রাঙা তব মুখখানি
মুঠি মুঠি ধরি সন্ধ্যার আলো তাহাতে ছড়াব আনি।
আকাশ হইতে তারা ফুল ছিড়ে বাঁধিব তোমার কেশে
সাঁঝ-মাখা ওই আধা গাঙ্-খানি জড়াইব তব বেশে।

আজিকে সজনী কেহ নাই হেথা, শুধু আমি আর তুমি
উপরে আকাশ নীচেতে সবুজ তৃণ ঘেরা বালুভূমি।
এইখানে আজি বসিয়া সজনী তব মুখপানে চেয়ে,
দেখিতেছি যেন কত মেঘ নাচে অতীত গগন ছেয়ে।
আজি মনে পড়ে সেই কোনদিনে কিশোরী বালিকা বেশে,
এসেছিলে তুমি এই বালুচরে রাঙা মুখে মৃদু হেসে।
কুন্তলে তুমি জড়াইয়াছিলে নবীন ধানের ছড়া,
হাতে বেঁধেছিলে জন্তীর ফুল কাখেতে মাটির ঘড়া!
তৃণ পথে যেতে দুপায়ের খাড় খুলে যায় বারে বারে,
কঁখের ঘড়াটি মাটিতে নামায়ে পরিতে আবার তারে;
আপনি কুপিয়া খাড়ুরে শাসাতে, পথেরে পাড়িবে গালি।
আমি ভাবিতাম, ভুরু-ধনু বুঝি ভেঙে যায় খালি খালি।
সেদিন আমার কিশোর বয়স, দেখিয়া সে মায়া-ছবি,
আমি সাজিলাম পথের বাউল তোমার গাঁয়ের কবি।

আমার বাঁশীর সুরে
সেদিনের সেই কৃষাণ কুমারী ফিরিল গগন জুড়ে;
দূর মেঘ-পথে যেখানেতে সাজে চাঁদের কনক-রথ
আমি বাঁশী সুরে সেদেশেতে তার গড়েছি সোনার পথ।
সেই পথ বেয়ে চলিত সে মেয়ে, চাঁদ-মাখা গায়ে তার
রাতের নীহার পরাইয়া যেতো মণি মাণিকের হার।
দুখানি চরণ জড়ায়ে পড়িত রেশমের মত মেঘে;
সে মেঘ আবার গুড়ো হয়ে যেতো বিজলীর আলো লেগে
চলিত সে মেয়ে, চলিত সে তার রেখা-লেখা পথ ছাড়ি
যেখানে অথই নীল পারাবার গগন-গাঙের পাড়ি,
সেখানে সে এসে ঘুমায়ে পড়িত আলু-থালু কেশ-পাশ
বাতাস তাহার অধরে মাখত মন্দার-ফুল-বাস।
সমুখে তাহার ভিড়িত আসিয়া বরণে বরণে সাঁঝ,
বরণে বরণে আসিত ঊষসী মাখিয়া সিঁদুর সাজ।
নাচিত সেখানে শত মধুমাস কোকিলের সুরে সুরে,
গোলাপ তাহারে শুনাইত গান বুলবুলি ঠোঁটে পুরে।

এমনি করিয়া কত দিন তারে দেখেছি কত না মতে
নিয়ে গেছি তারে কত নব দেশে কত নব দেশ হ’তে!
আমি ভাবিতেছি সোণার বন্ধু, তব মুখ পানে চেয়ে
তুমি কি আজিও সেদিনের সেই কৃষাণের ছোট মেয়ে?
আজি মনে পড়ে সেই কবে তুমি হারায়ে নাকের নথ,
এই বালুচরে কাঁদিয়া কাঁদিয়া ভিজাইতেছিলে পথ।
সেই নথ আমি খুঁজিয়া দিলাম,- জানাতে কৃতজ্ঞতা।
মোর পানে চেয়ে আঁখি নোয়াইলে, মুখে ফুটিল না কথা।
তারপর সেই কত ছল করি কত ভাবে দেখা হ’ল;
সেই সব কথা স্মরিয়া এখন আঁখি করে ছল ছল।
কোন দিন আমি লুকাইয়া থাকি গহন কাশের বনে
বাঁশের বাঁশীটি হাতেতে লইয়া বাজাতেম নিজ মনে।
সখীর সহিত জল নিয়ে যেতে, শুনি পরিচিত সুর
কাঁধের ঘড়াটি ভারি হয়ে যেতো, সখিরা বলিত,- “দূর!
পোড়ার মুখীর সবখানে দেরী,- থাক ও পথের মাঝে।”
তারা চ’লে যেত তব রাঙা মুখ আরো রাঙা হ’ত লাজে!
পিছন হইতে সহসা যাইয়া ধরিতাম চোখ দুটি
চিনেও আমারে ছল করে ইহা বলিতে না মুখ ফুটি।
তারপর সেই দুজনে বসিয়া এমনি নদীর ধারে,
সোনার স্বপন কুড়ায়ে কুড়ায়ে গাঁথিতাম মোরা হারে।

আমি বলিতাম ওই বালুচরে বাঁধিব একটি ঘর
কদমের শাখা দোলাইবে ছায়া তাহার মাথার ‘পর,
উঠানে তাহার বেঁধে দেব আনি বাঁশের জাঙ্লাখানি,
তুমি তারি তলে ঢাকাই সীমের বীজ লাগাইও আনি।
জাঙ্লা ভরিয়া হেলিবে দুলিবে ঢাকাই সীমের লতা
মোরা তারি পরে পড়িব মোদের গোপন প্রেমের কথা
তুমি বলিয়াছ, নবাণ্ণ দিনে আটী আটী ধান শিরে
আসিও গাঁয়ের কৃষাণ আমার গেঁয়ো পথ দিয়ে ধীরে,
বরণ-কুলায় প্রদীপ সাজায়ে ধান দুৰ্ব্বার সাথে
তোমারে বরণ করিয়া লইব আমি আপনার হাতে।

এমনি করিয়া দিনেরে আমরা কথার মালিকা গাঁথি
সাজায়ে সাজায়ে করেছি তাহারে বিগত দিনের সাথী।-
তারা চলে গেছে, মোদের হাতের কল্পনা-ফুল লয়ে,
হিসাব করিতে ভুলে গেছে তারা কতবার গেল বয়ে।
কখনো তোমারে ডাকিয়া বলেছি- কালকে আসিও সই,
সন্ধ্যা আমার কাটিবে না কাল একেলা তোমারে বই।
তুমি আস নাই, দূর দিগন্তে ঢলিয়া প’ড়েছে বেলা,
আমি রাগ করে মিছেই তাহারে ছুড়িয়া মেরেছি চেলা।
সোনার কলস ভাঙিব তাহার সে যদি ডুবিতে চায়,
পিছে চেয়ে দেখি মৃদু মৃদু হেসে তুমি আসিতেছ হায়;
তাড়াতাড়ি তুমি যেতে চাহিয়াছ, কাশের পাতার সনে
তোমার শাড়ীর আঁচল বাঁধিয়া হাসিয়াছি মনে মনে।
কুন্দ-কুসুম দন্ত দিয়া যে বাঁধন কেটেছ তার;-
সেই সব কথা এখন সজনী মনে হয় বার বার।
কতদিন আমি তোমারে বলেছি শোনগো সোনার সই,
তুমি যদি হও সন্ধ্যার তারা, আমি যদি সাঁঝ হই;
প্রতিদিন মোরা এমনি আকাশে এ উহার পানে চেয়ে,
মরণের দেশে ঘুমায়ে পড়িব মরণের গান গেয়ে।

আজিকে সজনী ফুরাল মোদের এ বালুচরের খেলা,
আমাদের ঘাটে ভিড়িয়াছে আসি পরদেশ হতে ভেলা।
আমি চলে যাব এক দেশে সখি তুমি যাবে আর দেশে
সেথায় মোদের এই বালুচর সাথে নাহি যাবে ভেসে।
মোরা যে স্বপন গড়েছিনু তাহে দেবতা হইল বাদী,
যা হবার তাই হইল, এখন কি হইবে মিছে কাঁদি।
তুমি চলে যাবে আমিও যাইব, এস তবে শেষ বার
এই বালুচরে লিখে রেখে যাই যত কথা আছে যার।
আমিও তোমারে ভুলিব সজনী, তুমি ভুলে যাবে মোরে,
বালুর আঙিনা বাঁধিলে কি হবে? থাকে না জনম ভ’রে।
তোমারে আমারে ভুলাতে সজনী অনন্ত গ্রহতারা
অনন্ত সাঁঝ অনন্ত আলো হইবে আত্মহারা!
মহাকাল তার চক্রের ঘায়ে ছিঁড়িবে স্মৃতির ফুল
দিবস-রজনী দুটি ভাই বোন মালায় গাঁথিবে ভুল।
তুমি ভুলে যাবে, আমিও ভুলিব, অনাগত ভাই বোন
সহসা আসিয়া জুড়িয়া বসিবে মোদের হৃদয়-কোণ।
অনাগত ব্যথা অনাগত সুখ পাতিয়া কুহকজাল
ঢাকিয়া ফেলিবে মনের গহিনে আজিকার এই কাল।
সেই দূর দেশে হয়ত কখনো অজানা গ্রহের মত
মাঝে মাঝে এসে উকি মেরে যাবে এ কালের দিন যত।
সেই নদী তটে দাঁড়ায়ে কখনো হেরিব সুদূর পারে
ক্ষীণ-বালু-লেখা কল-ঢেউ সনে দুলিছে রূপালী হারে।
সেথা হ’তে কভু দূরাগত কোন পেঁয়ো রাখালের বাঁশী
আধ বোঝা-যায় আধ না বোঝায় শ্রবণে পশিবে আসি।