পিপাসার গান

কোনো এক অন্ধকারে আমি
যখন যাইব চ’লে- আরবার আসিব কি নামি
অনেক পিপাসা ল’য়ে এ-মাটির তীরে
তোমাদের ভিড়ে!
কে আমারে ব্যথা দেছে,- কে বা ভালোবাসে,-
সব ভুলে- শুধু মোর দেহের তালাশে
শুধু মোর স্নায়ু শিরা রক্তের তরে
এ-মাটির ‘পরে
আসিব কি নেমে!
পথে-পথে,- থেমে- থেমে- থেমে
খুঁজিব কি তারে,-
এখানের আলোয়-আঁধারে
যেইজন বেঁধেছিল বাসা!-
মাটির শরীরে তার ছিল যে-পিপাসা,
আর যেই ব্যথা ছিল,- যেই ঠোঁট, চুল,
যেই চোখ,- যেই হাত,- আর যে-আঙুল
রক্ত আর মাংসের স্পর্শসুখভরা,-
যেই দেহ এক দিন পৃথিবীর ঘ্রাণের পসরা
পেয়েছিল,- আর তার ধানীসুরা করেছিল পান,
এক দিন শুনেছে যে জল আর ফসলের গান,
দেখেছে যে ওই নীল আকাশের ছবি
মানুষ-নারীর মুখ,- পুরুষ- স্ত্রীর দেহ সবি
যার হাত ছুঁয়ে আজও উষ্ণ হয়ে আছে,-
ফিরিয়া আসিবে সে কি তাহাদের কাছে!
প্রণয়ীর মতো ভালোবেসে
খুঁজিবে কি এসে
একখানা দেহ শুধু!-
হারায়ে গিয়েছে কবে কঙ্কালে কাঁকরে
এ-মাটির ‘পরে!

অন্ধকারে সাগরের জল
ছেনেছে আমার দেহ,- হয়েছে শীতল
চোখ- ঠোঁট- নাসিকা- আঙুল
তাহার ছোঁয়াচে;- ভিজে গেছে চুল
সাদা-সাদা ফেনাফুলে;
কত বার দূর উপকূলে
তারাভরা আকাশের তলে
বালকের মতো এক- সমুদ্রের জলে
দেহ ধুয়ে নিয়া
জেনেছি দেহের স্বাদ;- গেছে বুকে- মুখ পরশিয়া
রাঙা রোদ,- নারীর মতন
এ-দেহ পেয়েছে যেন তাহার চুম্বন
ফসলের খেতে!
প্রথম প্রণয়ী সে যে, কার্তিকের ভোরবেলা দূরে যেতে-যেতে
থেমে গেছে সে আমার তরে!
চোখ দু’টো ফের ঘুমে ভরে
যেন তার চুমো খেয়ে!
এ-দেহ,- অলস মেয়ে
পুরুষের সোহাগে অবশ!-
চুমে লয় রৌদ্রের রস
হেমন্ত বৈকালে
উড়ো পাখ্-পাখালির পালে
উঠানের;- পেতে থাকে কান,-
শোনো ঝরা-শিশিরের গান
অঘ্রানের মাঝরাতে;
হিম হাওয়া যেন সাদা কঙ্কালের হাতে
এ-দেহেরে এসে ধরে,-
ব্যথা দেয়! নারীর অধরে-
চুলে- চোখে- জুঁয়ের নিঃশ্বাসে
ঝুমকো-লতার মতো তার দেহ-ফাঁসে
ভরা ফসলের মতো পড়ে ছিঁড়ে
এই দেহ,- ব্যথা পায় ফিরে!….
তবু এই শস্যখেতে পিপাসার ভাষা
ফুরাবে না;- কে বা সেই চাষা;-
কাস্তে হাতে,- কঠিন,- কামুক,-
আমাদের সবটুকু ব্যথাভরা সুখ
উচ্ছেদ করিবে এসে একা!
কে বা সেই!- জানি না তো,- হয় নাই দেখা
আজও তার সনে;
আজ শুধু দেহ- আর দেহের পীড়নে
সাধ মোর; চোখে ঠোঁটে চুলে
শুধু পীড়া,- শুধু পীড়া!- মুকুলে-মুকুলে
শুধু কীট,- আঘাত,- দংশন,-
চায় আজ মন!

নক্ষত্রের পানে যেতে-যেতে
পথ ভুলে বার-বার পৃথিবীর খেতে
জন্মিতেছি আমি এক সবুজ ফসল!-
অন্ধকারে শিশিরের জল
কানে-কানে গাহিয়াছে গান;-
ঢালিয়াছে শীতল আঘ্রাণ;
মোর দেহ ছেনে গেছে অলস- আঢুল
কুমারী আঙুল
কুয়াশার; ঘ্রাণ আর পরশের সাধ
জাগায়েছে;- কাস্তের মতো বাঁকা চাঁদ
ঢালিয়াছে আলো-
প্রণয়ীর ঠোঁটের ধারালো
চুম্বনের মতো!
রেখে গেছে ক্ষত
সব্জির সবুজ রুধিরে!
শস্যের মতো মোর এ-শরীর ছিঁড়ে
বার-বার হয়েছে আহত
আগুনের মতো
দুপুরের রাঙা রোদ!
আমি তবু ব্যথা দেই,-
ব্যথা পাই ফিরে! –
তবু চাই সবুজ শরীরে
এ-ব্যথার সুখ!
লাল আলো,- রৌদ্রের চুমুক,
অন্ধকার,- কুয়াশার ছুরি
মোরে যেন কেটে লয়,- যেন গুঁড়ি-গুঁড়ি
ধুলো মোরে ধীরে লয় শুষে!-
মাঠে-মাঠে- আড়ষ্ট পউষে
ফসলের গন্ধ বুকে ক’রে
বার-বার পড়ি যেন ঝ’রে!

আবার পাব কি আমি ফিরে
এই দেহ!- এ-মাটির নিঃসাড় শিশিরে
রক্তের তাপ ঢেলে আমি
আসিব কি নামি!
হেমন্তের রৌদ্রের মতন
ফসলের স্তন
আঙুলে নিঙাড়ি
এক খেত ছাড়ি
অন্য খেতে- চলবো কি ভেসে
এ-সবুজ দেশে
আর এক বার! শুনিব কি গান
ঢেউদের!- জলের আঘ্রাণ
লব বুকে তুলে
আমি পথ ভুলে
আসিব কি এ-পথে আবার!
ধুলো-বিছানার
কীটেদের মতো
হব কি আহত
ঘাসের আঘাতে!
বেদনার সাথে
সুখ পাব!
লতার মতন মোর চুল,
আমার আঙুল
পাপড়ির মতো,-
হবে কি বিক্ষত
তোমার আঙুলে- চুলে!
লাগিবে কি ফুলে
ফুলের আঘাত! আরবার
আমার এ-পিপাসার ধার
তোমাদের জাগাবে পিপাসা!
ক্ষুধিতের ভাষা
বুকে ক’রে-ক’রে
ফলিব কি!- পড়িব কি ঝ’রে
পৃথিবীর শস্যের খেতে
আর এক বার আমি-
নক্ষত্রের পানে যেতে-যেতে।