পৃথিবী সূর্যকে ঘিরে

পৃথিবী সূর্যকে ঘিরে ঘুরে গেলে দিন
আলোকিত হ’য়ে ওঠে- রাত্রি অন্ধকার
হ’য়ে আসে; সর্বদাই, পৃথিবীর আহ্নিক গতির
একান্ত নিয়ম, এই সব;
কোথাও লঙ্ঘন নেই তিলের মতন আজও;
অথবা তা হ’তে হ’লে আমাদের জ্ঞাতকুলশীল
মানবীয় সময়কে রূপান্তরিত হ’য়ে যেতে হয় কোনও
দ্বিতীয় সময়ে; সে-সময় আমাদের জন্যে নয় আজ।
রাতের পরের দিন- দিনের পরের রাত নিয়ে সুশৃঙ্খল
পৃথিবীকে বলয়িত মরুভূমি ব’লে
মনে হ’তে পারে তবু; শহরে নদীতে মেঘে মানুষের মনে
মানবের ইতিহাসে সে অনেক সে অনেক কাল
শেষ ক’রে অনুভব করা যেতে পারে কোনও কাল
শেষ হয় নি ক’ তবু;- শিশুরা অনপনেয়ভাবে
কেবলই যুবক হ’ল,- যুবকেরা স্থবির হয়েছে,
সকলেরই মৃত্যু হবে,- মরণ হতেছে।

অগণন অংকে মানুষের নাম ভোরের বাতাসে
উচ্চারিত হয়েছিল শুনে নিয়ে সন্ধ্যার নদীর
জলের মুহূর্তে সেই সকল মানুষ লুপ্ত হ’য়ে গেছে জেনে
নিতে হয়; কলের নিয়মে কাজ সাঙ্গ হ’য়ে যায়;
কঠিন নিয়মে নিরঙ্কুশভাবে ভিড়ে মানবের কাজ
অসমাপ্ত হ’য়ে থাকে- কোথাও হৃদয় নেই তবু।
কোথাও হৃদয় নেই মনে হয়, হৃদয়যন্ত্রের
ভয়াবহভাবে সুস্থ সুন্দরের চেয়ে এক তিল
অবান্তর আনন্দের অশোভনতায়।
ইতিহাসে মাঝে-মাঝে এ-রকম শীত অসারতা
নেমে আসে;- চারি দিকে জীবনের শুভ্র অর্থ র’য়ে গেছে তবু,
রৌদ্রের ফলনে সোনা নারী শস্য মানুষের হৃদয়ের কাছে,
বন্ধ্যা ব’লে প্রমাণিত হ’য়ে তার লোকোত্তর মাথার নিকটে
স্বর্গের সিঁড়ির মতো;- হুন্ডি হাতে অগ্রসর হ’য়ে যেতে হয়।

আমাদের এ-শতাব্দী আজ এই পৃথিবীর সাথে
নক্ষত্রলোকের এই অবিরল সিঁড়ির পসরা
খুলে আত্মক্রীড় হ’ল;- মাঘসংক্রান্তির রাত্রি আজ
এমন নিষ্প্রভ হ’য়ে সময়ের বুনোনিতে অন্ধকার কাঁটার মতন
কাকে বোনে? কেন বোনে? কোন দিকে কোথায় চলেছে?
এক ফোঁটা বৃষ্টি পড়ে,- ঝাউ শিশু জারুলে হাওয়ার শব্দ থেমে
আরও থেমে-থেমে গেলে- আমাদের পৃথিবীর আহ্নিক গতির
অন্ধ কণ্ঠ শোনা যায়;- শোনো, এক নারীর মতন,
জীবন ঘুমায় গেছে; তবু তার আঁকাবাঁকা অস্পষ্ট শরীর
নিশির ডাকের শব্দ শুনে বেবিলনে পথে নেমে
উজ্জয়িনী গ্রীসে রেনেসাঁসে রুশে আধো জেগে, তবু,
হৃদয়ে বিকিয়ে গিয়ে ঘুমায়েছে আর একবার
নির্জন হ্রদের পারে জেনিভার পপলারের ভিড়ে
অন্ধ সুবাতাস পেয়ে;- গভীর গভীরতর রাত্রির বাতাসে
লোকার্নো হ্বের্সাই মিউনিখ অতলন্তের চার্টারে
ইউ-এন-ওয়ের ভিড়ে আশা দীপ্তি ক্লান্তি বাধা ব্যাসকূট বিষ-
আরও ঘুম র’য়ে গেছে হৃদয়ের- জীবনের;- নারী,
শরীরের জন্যে আরও আশ্চর্য বেদনা
বিমূঢ়তা লাঞ্ছনার অবতার র’য়ে গেছে; রাত
এখনও রাতের স্রোতে মিশে থেকে সময়ের হাতে দীর্ঘতম
রাত্রির মতন কেঁপে মাঝে-মাঝে বুদ্ধ সোক্রাতেস্‌
কনফুচ লেনিন গ্যেটে হ্যোল্ডেরলিন রবীন্দ্রের রোলে
আলোকিত হ’তে চায়;- বেলজেনের সবচেয়ে বেশি অন্ধকার
নীচে আরও নীচে নীচে টেনে নিয়ে যেতে চায় তাকে;
পৃথিবীর সমুদ্রের নীলিমায় দীপ্ত হ’য়ে ওঠে
তবু ফেনার ঝর্ণা,- রৌদ্র প্রদীপ্ত হয়,- মানুষের মন
সহসা আকাশপথে বনহংসী,- পাখির বর্ণালি
কি রকম সাহসিকা চেয়ে দেখে,- সূর্যের কিরণে
নিমেষেই বিকীরিত হ’য়ে ওঠে;- অমর ব্যথায়
অসীম নিরুৎসাহে অন্তহীন অবক্ষয়ে সংগ্রামে আশায় মানবের
ইতিহাস-পটভূমি অনিকেত না কি? তবু, অগণন অর্ধসত্যের
উপরে সত্যের মতো প্রতিভাত হ’য়ে নব নবীন ব্যাপ্তির
সর্গে সঞ্চারিত হ’য়ে মানুষ সবার জন্যে শুভ্রতার দিকে
অগ্রসর হ’তে চায়- অগ্রসর হ’য়ে যেতে পারে।

মাসিক বসুমতী। শারদীয় ১৩৫৩