শীত-রাতে

ঘরের সকল বাতি নীরবে নিভায়ে ফেলে
একটি প্রদীপ শুধু রেখে
আমরা এ-ক’জন ব’সে আছি শীত-রাতে
ঘরের স্থবির পিতা ফোকরে চুরুট রেখে দিয়ে
শ্বেতাশ্বতর থেকে প’ড়ে যায়- তাহার দাড়ির ‘পরে আলোয়
চারি-দিকে- বাহিরের ঢের উঁচু গাছ
একটি শাল্মলী হয়ে অবশেষে স্তব্ধতার দিকে
উঠে গেছে- তাহার ডালের ‘পরে পাখি এসে বসে
নীড় গড়ে- ডিম পাড়ে- পাখিদের মৃত্যু হয়ে যায়
গাধার দুধের মতো ম্লান কুয়াশার ফাঁকে তারা
বিহঙ্গের স্তব্ধ স্বর্গে চ’লে যায়

আমার পায়ের কাছে পেয়ারা’র জ্বালানির-কাঠে
এখনও আগুন লেগে। হয়তো অগ্নির শুরু এইখানে
হয়তো অগ্নির বিম্ব কোনও এক মায়াবীর বৃত্তের ভিতরে
নীরবে যেতেছে ঘুরে মানুষের কণ্ঠ থেকে শব্দ উচ্চারণ
ক্রমেই স্তিমিত ক’রে- ক্রমেই নিমীল ক’রে মানুষের চোখ।

মানুষেরা কোন স্বর্গে চ’লে যায় তবে?
হাতল ঘুরায়ে কোন প্রবীর নরকে
এখন প্রবেশ করে? হে মনীষী,
হে বিরক্ত পৃথিবীর মনীষীর ভিড়!
ধূসর ছাইয়ের থেকে নীরব অগ্নির থেকে উঠে
তোমরা দাঁড়াও এসে আজানুলম্বিত শীর্ণ হাতে
হেমন্তের পিপুলের মতো দীর্ঘতায়
সে-গাছ যেমন নিজেকে ঝেড়ে ফেলে কুয়াশায়
প্রতিভায়;- আজ এই হলুদ পাতার পৃথিবীতে
তোমরাও তম্বুরার শব্দে গেয়ে ওঠো।

আমাদের দেহ আজ সব-চেয়ে উজ্জ্বল, রঙিন
কঙ্কালের এনামেল;- নব-নব এলাকায় আমাদের ঘোড়া
এমন ধবল দাঁত বার করে স্বর্গীয় আস্বাদে
এত তৃপ্তি, পরিতৃপ্তি, প্রসাদের জয়
আনকোরা নিশীথের মতো ব’লে অন্ধকারহীন মনে হয়।

ওখানে স্থবির একা বই পড়ে আলোর গোলকে;
ঐখানে বুড়ি শুয়ে, ঐখানে শিশুদের মৃত্যু আর ঘুম।
বাহিরের পৃথিবীর থেকে আমি বাহিরের পৃথিবীর দিকে যেতে-যেতে
এইখানে শীত-রাতে দু’-চার মিনিট
জ্বালানি-কাঠের গন্ধে- থেমে গেছি।

হে মনীষী, হে উদ্ৰিক্ত পৃথিবীর ভিড়,
তোমরা গানের স্কুল, আজ এই ঘণ্টায় মুখর পৃথিবীকে
প্রথমে স্তব্ধতা দাও- শীত-রাতে জ্বালানি-কাঠের কাছে রেখে।
স্থবিরের শান্তি নয়, শিশুদের স্বপ্ন, মৃত্যু নয়-
সর্বদাই নরকের অধীর দেয়ালে
অগ্নির আক্রোশ এসে ন’ড়ে যায় নর্তকীর মতো
অগ্নির আহ্বানে জেগে মাইল-মাইল কর্নিসের থেকে
সময়ের চীনে-বাসনের মতো কঙ্কালেরা সমুদ্রের যূথচারী মাছের মতন
প্রকাণ্ড সূর্যের রঙে জ্ব’লে ওঠে যেন এক অলীক সকালে।
তেমন বিম্বের মতো জেগে উঠে আমরাও
সময়কে ধূর্ত পিতৃব্যের মতো মনে ক’রে
তাহার গোপন বুকে অর্থের সন্ধান চাই চির-দিন।
যতই বিসর্পী বাঁকে ঘুরে যাই- সিংহদুয়ারের মতো জেগে
নরক মিশেছে স্বর্গে পৃথিবীর অবিকল ছায়া
রসাতলে নেমে গেছে;-
তবুও নর্তকী নাচে যেন এক পিঙ্গল মুদ্রার
গোল পরিধিকে ঘিরে হলুদ অগ্নির মতো চির-দিন।

কোথায় নৃত্যের শুরু, শেষ, শুরু, কোথায় নৃত্যের ভঙ্গি থেকে
নর্তকী পৃথক, হাতির দাঁতের মতো সাদা তার পায়ের ধুলোতে উড়ে
গোলাকার চোখ, বাক- পৃথিবী, স্বর্গ, রসাতল,-
সমাহৃত হতে চায় প্রবীণ আগুনশিল্পে গিয়ে
গাঢ় সঙ্গীতের স্কুলে যে যাহার কক্ষে দাঁড়িয়ে।