সোমেশ্বর মুস্তফির পৃথিবী

সেই ছোটবেলাকার কথা মনে পড়ে- হেমন্তের বিকেলবেলায়
খড়ের মাঠের ‘পরে কুয়াশায় হাঁটিতাম- আমরা দু’জনে
আমি আর সেই খিড়কির জীব বলিত সকলে যারে
তবুও আমার কাছে ধীর পক্ক ব’লে মনে হত সব-চেয়ে;-
যেমন প্রাণের টানে মাছরাঙাপাখি
উষ্ণ হিরেকষজ্বালা রৌদ্রের- অহঙ্কার- পরিহার ক’রে চ’লে যায়
পুকুরের শৈবাল-দরিদ্র স্থির আরশিতে
আপনার রঙিন ডানার ধূসর বিম্ব-ই তারে শান্তি দেয়
যেমন গভীর রাতে পেঁচা তৃপ্তি পায়
বিবর্ণ খড়ের চালের ‘পরে নেমে
কোনও এক আধবুড়ো অন্ধ কৃষকের
আমিও তেমন ঘড়িব্যবসায়ী, বিকল ঘড়ির মিস্ত্রি
সোমেশ্বর মুস্তফি’র বিকেলবেলার ছুটি আহরণ করিতাম
রাইসর্ষের মাঠে দু’-চারটা শালিখ উড়িয়ে
নদীর নিকটে হোগলা-খেতের পাশে গিয়ে বাবুইয়ের ভিড়
হালকা হাওয়ার মুঠে এক-রাশ মশা’র মতন
হঠাৎ উজায়ে দিয়ে,- মায়াবীর জালে টেনে
তাহাদের গুটায়ে আনিত তবু অন্ধকার
নক্ষত্রেরা শান্তি দিত; পাহাড়ের মতো বড়ো সাদা মেঘ
অরণ্যের শিঙের কিনার থেকে যেন এক আমাদেরও
আধােপরিচিত অভিভাবকের মতো
পাথরের মতো স্থির চোখ নিয়ে
আলোচনা ক’রে যেত সব- সন্দিহান;
আমাদের পীত ধৃষ্টতাকে তরাসে ছেলের মতো
তুলে নিয়ে- প্রসারিত হাতের তেলোর ‘পরে
রেখে দিত নির্জন দানব সেই
তবু ভয় নয়- নিরন্ন অক্ষর নিয়ে মানবেরা
যেই সব গল্প লেখে- কথা বলে- কাজ করে
তাহাদের সকলের মাঝখানে মেধাবী নির্দেশ এক
আপনারে অনুভব করেছে যেন হেমন্তের অন্ধকারে।
এই অনুভব দিনের রৌদ্রের ভিড়ে- পুরোনো শীতের জামা,
আচারের শিশিগুলো, উঠানের বিস্তৃতিতে মেলে দিয়ে
খইখেত থেকে ধান এনে- বই প’ড়ে- কুকুরের গায়ে ঢিল মেরে অকারণ
সহসা বিস্ময় এক অনুভব করিতাম
যেন এক দোলনার বস্ত্রহীন শিশুর মতন
নতুন জন্মের এক কানাকড়ি নিয়ে আমি
পৃথিবীতে আসিয়াছি- কর দিতে হবে ঢের
প্রেতভৃত্যের মতো বেতাল-সিদ্ধের মন্ত্রে ঘুরিতেছি
নিরম্বু নির্জন আত্মা-কেন্দ্রটিকে ঘিরে
তবু যেন আশ্বাসের চক্রাকার ময়ূখ রয়েছে
জীবনের সে-সব ধাত্রীরা রয়ে গেছে প্রতিভার মতো মেঘে
অস্তসূর্যে- ঝড়ের দুপুরবেলা শেষ হয়ে গেলে
দাঁড়কাকগুলো নীল শূন্যে উড়ে যেই কলরব করে
সেই সব ভয়ঙ্কর হলুদ ধ্বনির মাঝে।

ঘড়ির মিস্ত্রিকে আমি মাঝে-মাঝে
এই সব কথা বলিতাম;- আমার চোখের দিকে চেয়ে
হঠাৎ খেতের মাঝখানে থমকায়ে দাঁড়াত সে বহু ক্ষণ
সেই জীর্ণ দীর্ঘ দেহ- যেন এক ভূতুড়ে পাড়ার
হিজলগাছের সব-শেষ কাণ্ডখানা কেটে নিয়ে
বানায়েছে কোনও এক বিদূষক-কারিগর
সমস্ত স্বর্গীয় ব্যাস তার ছেঁচে-ছেঁচে
খোঁচা দিয়ে- শাবলের বাড়ি মেরে- কালি ঢেলে
তবু তার খিরগিজ-ডাকাতের মতো দেহের সীমানা ঘিরে
কোনও এক নাক্ষত্রিক আভা রেখে গেছে
তার উঁচু নাক যেন মধ্যবাতাসের থেকে এক বেকার কাকের মতো
বালকের হাতে এক খণ্ড রুটি দেখে সহসা আসিত নেমে
আধোপ্রীত- ঢের সমাকুল- শঠ- অন্তরঙ্গ-
খানিকটা সন্দিহান- কাঁচাপাকা ভুসির রাশির মতো গোঁফ-জোড়া
বাতাসে ধুলোর মতো ঝেড়ে ফেলে এক-আধ বার
কোমরে দু’হাত রেখে এক বার প্রান্তরের দিকে
এক বার নদী অরণ্যের পানে- নক্ষত্রের মুখে চেয়ে
কাস্তে’র মতো চাঁদটাকে প্লুত প্লাবনের রাতে
মজ্জমান রুগ্ন বাঘিনি’র মতো ধরিত সে
সহসা উত্তীর্ণ এক সেগুনের শাখা মনে ক’রে।

তবু সে অনেক বই পড়েছিল- অনেক ধূসর বই
পৃথিবীর পুরোনো প্রাণের কাঁপুনির পরে
সে যেন বৃহৎ এক লোকালয়-ভীরু বনতিতিরের মতো
আপনার হৃদয়-স্পন্দন ঘনায়ে থাকিত ব’সে
অরণ্যের বিবর্ণ খয়েরি ঝোপে শরীরকে নিষ্ক্রমিত হতে দিয়ে
একটি আত্মার মতো স্তব্ধ হয়ে থেকে
ঘড়ি’র ব্যাবসা তার- বেচা-কেনা-
সহিষ্ণু মিস্ত্রির মতো মেরামত করিবার কাজ
অনেক সময় তার গিলে খেত- তুচ্ছ অর্থ এনে দিত
প্রতারিত হতে হত- মাঝে-মাঝে বহু দিন
বেকারের সাদা স্বর্গে- প্লুত চোখ নিয়ে ব’সে থেকে
রৌদ্র আর নীলিমার অবিরাম দিনগুলো উপবাসে কেটে যেত তার
পৃথিবীর গুদামের থেকে উত্থাপিত পাণ্ডু আর ক্ষয়ের বাতাস
তাকে ঢের পরীক্ষিত অনুচর জেনে
সূতির চাদর দিয়ে ঢেকে বসায়ে রাখিয়া যেত ড্রেস ক’রে
শমনের খাবার-থালায় শূন্য মাংস হয়ে চড়িবার আগে
তবু তার মানবাত্মা ভেদ ক’রে কোনও অম্ল গ্যাস
উৎপ্রেক্ষার ঝড়ে আকাশকে ঢেকে ফেলে
ঈশান কোণের দিকে উড়িতে দেখি নি আমি কোনও দিন
বরং সে আইবুড়ো জীবনের জাঞ্জিবর-তরমুজ খুলে
ভড়ঙের পাথরে শানানো ছুরি দিয়ে কেটে
ঝরাত অনেক ধূসর গোলাপি রস- ঘন- শ্লথ-
খানিকটা মিছরির দানা দিয়ে মিঠে ক’রে নিয়ে
বোম্বাই-মরিচ আর লেবু টিপে- অবসর-মতো-
অন্যতর ঝাঁঝ এনে- কেরোসিন-কাঠের টেবিলে
একটি কাঁচের গ্লাস- জল-ভরা- রেখে দিত
আমাকে পড়াত ঢের- ব্যাকরণ, ইংরেজি
গুহ্য সূত্র- কৌটিল্যর অর্থশাস্ত্র- স্যাকারিন-দানা ঢেলে;
কাহাদের যেন মিঠে পরিকথাগুলো কাসুন্দির উষ্ণতায়
কটু ক’রে নিয়ে- অনেক ফরাসি গল্প- ভারতীয় দর্শনের
টপ্পা ছুঁড়ে- যেমন নিগুঢ় যুবা বঁড়শিতে এঁটে
বোলতাকে ছুঁড়ে মারে- পীবর জলের তৃপ্তি বিদ্ধ ক’রে
বেলুনের পোটকার মতো স্ফীত কোনও এক
আধােনিদ্র মৎস্যের ঘুণাক্ষরহীন
ঔৎসুক্যের দিকে- আনন্দের পানে
মাছকে ডাঙায় তুলে আবার সে করুণায় ঠেলে দেয়
উনুনের কড়াইয়ের থেকে যেন
শৈবালসবুজ- শীত- জলজননীর দিকে

হয়তো কঞ্চি চাঁছিতে আছি টেবিলের পাশে
আমাকে সে হঠাৎ ডাকিত
সম্পূর্ণ মুখ তুলে… ‘অভিরাম,
নীতি কাকে বলে? চাণক্যর কিংবা চালু- হিলফিল্লের?
মেটেরিয়া মেডিকাটা খুলে ঢের নীতি শেখা যায়
নৈতিক শব্দের ঢের মানে দেওয়া আছে অভিধানে
আছে না কি, অভিরাম?- তবু ঢের বই- ঢের যুগ
তোমার আমার মতো অনেক মানুষ
দুর্নীতির সুখে সব অবিরল ভেসে গেল
মৃত পিঁপড়ের শ্লথ সনির্বন্ধ চাটনির মতো
তারা শুধু নব জীবাণুর আবিষ্কার চেয়েছিল- নব গতি সময়ের
পৃথিবীর মণিবন্ধ থেকে ধূসর- ধূসরতম ঘড়িটিকে খুলে নিয়ে
(চকবাজারের এক চক্ষুষ্মান প্রবাদের কাছে
অনাদি সত্তার আলো আমাদের তরে নয়)’

ব’লে সে আবার এক ভয়ঙ্কর লেনস্ নিয়ে
বনোয়ারি গোস্বামী’র আঠারো-শো আঠারো সালের
মৃত ঘড়িটার সব হিম- পীত যন্ত্রের দিকে
ভ্রূকুটিকরুণ মুখ সমীচীন নাক স্তব্ধ ক’রে
বহু ক্ষণ তাকায়ে থাকিত:
‘অভিরাম, পরিষ্কার কোনও ভিত্তি নাই
যেন এক মাঝসমুদ্রের জলে
মালয়ের নাবিকের নৌকার কাঠ দুলিতেছে
নাবিক- উর্বর- তবু তার তরণীর ভিজে কাঠ
সমুদ্রের বাঙ্ময় আশ্বাস- এরা বন্ধু নয়
এরা কোনও শেষ স্থির ভিত্তি নয়- অভিরাম
মানুষ যা প্রয়োজন ব’লে মনে করে
হয়তো-বা তাতে তার
চুনাপাথরের স্তম্ভ জেগে ওঠে
মানুষের কী জিনিস প্রয়োজন- আজও সে তেমন জানে
যেমন ধনেশপাখি সকলের সব কথা জেনে
জাফরান গোধূলিতে ঢের উঁচু সুন্দরী’র মগ ডালে
সমীচীন গম্ভীর স্থূল ঠোঁট নিয়ে ব’সে ভাবে
ওড়াউড়ি করে- খেদ খায়- প্রণয়ের তাপ বোধ করে
ম’রে যায় তার পর জীবনকে শতচ্ছিদ্র ক’রে- চালুনির মতো
জৈবিক ভ্রাতাভগ্নীর তরে খানিকটা তেল রেখে- পৃথিবীতে
এই সচেতন নিঃস্বার্থতা আমাদেরও
কোনও সমীচীন বুদ্ধি দিয়ে পরিমাপ ক’রে
তাহারে অনেক সংজ্ঞা দেই মোরা
তবু এই নিঃস্বার্থতা আরও সমীচীন- আরও শঠ- শক্ত
কারণ প্রদীপ-হাতে যেন এক অনাদি বয়স
তাহারে রেখেছে ধ’রে;- কেন- সেই জানে-‘

‘শুনে তুমি ব্যবহৃত ব্যথা
অনুভব করিতেছ, অভিরাম- জানি আমি
গৈবী নিয়ম তবু আমাদের অন্তরের ঔরসের সিন্ধুফেনাময়
মেরুনাবিকের সাথে হাত ধ’রে বিঘোর আঁধারে
চলে নাই কোনও দিন; গোবি মরুভূর সেই উষ্ট্রসমুজ্জ্বল
উঁচু জ্যোতিঃপুঞ্জেও চলিবে না- এই প্রতিষিদ্ধ ব্যবহার দেখে
আমাদের প্রতিভার তর্ক যদি উড়ে যায় বৃহস্পতি নক্ষত্রের দিকে
সমারোহে- চিলের মতন- তা হলে ব্যাহত হয়ে
আবার ফিরিতে হবে- বিহঙ্গকে।’

‘মানুষের চক্ষুদৃশ্যমান উদ্দেশ্যের- অভীপ্সার
তত বেশি কোনও অর্থ নাই- কৃশাঙ্কুরে, ফাটলে, ধূলায়
এরা সব বিতাড়িত বীজ, আহা, রৌদ্রে অন্ধকারে
পিচ্ছিল আনন্দে কাক ঠোকরায়ে- ব্যথা দিয়ে- গিলে ফেলে
অন্ত্রের ভিতর থেকে অদ্ভুত উদ্গারে বার করে তার পর
ফেলে রাখে মৃত্তিকায়;- এই সব অন্ধকার স্পৃহা, আবর্তের থেকে
হয়তো-বা অঙ্কুরের জন্ম হয়- কিংবা মরণের
হয়তো-বা মহনীয় তরু জেগে ওঠে- হয়তো-বা অবিরাম লোল মৃত্তিকার
উদ্বর্তনে জ্যোতির্ময় অন্ধকারে মিশে যায় বীজ।
কেন জ্যোতির্ময়, হে ধূসর ঘড়ি, ঘড়ির হাতুড়ি?’
ব’লে সোমেশ্বর তার দুই পাটি দাঁতের পিছনে
সরীসৃপ জিভটাকে নিয়ে ডাইনোসর-পৃথিবীর মতো
ব্যায়াম চালাত একা বহু ক্ষণ অন্ধকার মুখের বিবরে
তার পর জিভটাকে একেবারে শীর্ণ গালে আটকায়ে
আলুর মতন এক ছোট আব ফুলাত সে
যক্ষারুগিনির মতো যেন সমুজ্জ্বল, তীক্ষ্ণ চোখে
আমার চোখের দিকে তাকায়ে রহিত একা
বায়বী, নির্জন।

এর পর বছর দশেক কেটে গেল- আমাদের দু’ জনার
বিদ্যুতের তারে প্রচলিত হয়ে কর্মণ্য জন্তুর মতো
অতিরিক্ত কুয়াশার পক্ষচ্ছেদ ক’রে
ঢের দিন পরে- এক দিন বৈশাখের রাতের দুপুরে
যখন নিস্তার কেউ পায় না ক’ তুলোর বালিশে
ধীরে-ধীরে দ্বার খুলে বার হয়ে পড়িলাম
নিদ্রার গলাটাকে যেন এক ক্ষীণ পাতিহাঁসের মতন
সাপটায়ে ধ’রে এই অন্ধকার- এই রাত্রি-
চেৎলার হাটবারে ভাঙা দরদালানের গর্ভে এক
প্রান্তরের পারে- দূরে- পোড়ো ইঁদারার পাশে
কা’কে আর দেখা যাবে একটি ধূসর ভূত ছাড়া
তবু আমি বিস্ফারিত চোখে চেয়ে দেখি
জীর্ণ খদ্দরের এক ধােসা গায়ে দিয়ে
ইঁদারার শুষ্ক গহ্বরের দিকে চেয়ে আছে সোমেশ্বর
‘অভিরাম,- এত রাতে তুমিও এখানে
বহু দিন থেকে যেন জুজুবুড়ি হয়ে আছে প্রাণ
লোকালয় থেকে ঢের দূরে স’রে-‘

পুরোনো ঘড়ির নাড়ি টিপে- ছানি কেটে- চশমা পরায়ে
আমি যেন আজও মধ্যযুগে প’ড়ে আছি মনে হল
হৃদয়ের উদূখলে ঢের রেণু-
নিরন্তর বিপরীত জীবাণুর রাশি
হাপর চালাতে আছে- মনে হল
যেন শান্ত শায়ামের স্বামিনীর রুষ্ট বিড়ালের মতো
ফুলদানি ভেঙে- জল ঢেলে- হৃষ্ট জানালার
লাল নীল সবুজ কাঁচের ঈর্ষা চুরমার ক’রে
দামস্কস-গোলাপের মতো ঋদ্ধ গোধূলির অবসরে
বাঘা-তেঁতুলের ক্লেদ অকস্মাৎ ছুঁড়ে ফেলে
জ্বলন্ত মোমের বাতি উল্টায়ে বছর বারো’র
সন্নিবিষ্ট প্রতিভার পাণ্ডুলিপি ভস্ম ক’রে ফেলে
তবু তারা কোনও শান্ত সমন্বয় আজও পেল না ক’
শীত-রাতে আমি বাহিরের থেকে খয়েরি রঙের কুটো-
অনেক স্বর্গীয় কাঠ- এনে স্তূপ ক’রে অগ্নি জ্বালি
গনগনে সোনালি গরমে যদি সেই ত্যক্ত বিড়ালেরা
তৃপ্তি পায়;- ধােপর বাড়ির থেকে গাধা যেন
জেরুজালেমের গাধা এসে রেখে গেছে সেই রাস
বহু দিন আগে; গেরো খুলে তার সাদা থানে বিছানা গুছায়ে লই
বৈশাখের দুপুরের মেঘমালভূমিদের মতন ধবল
যেন সেই বিছানার প্রতিটি সূতার লোম- অভিরাম-
পরিশ্রান্ত হৃদয়কে- অগোচর প্রিয় নাম ধ’রে
যেন এক দুরারোহ মীমাংসার মূলসূত্রে ডাকিতেছে
রুধিরের অন্তর্গত সেই সব বিড়ালেরা তবু
স্বপনের আকর্ষণ করে না ক’ অনুভব
কোনও শান্তি কোনও দিন তাহাদের তরে আর নয়।

‘অবশেষে এক দিন শীতের সন্ধ্যায় আমি কলেজ স্ট্রিটের
কোনও এক সমাকীর্ণ বইয়ের দোকানে ঢুকে
আনিলাম প্লেটো আর প্যাসকাল চুরি ক’রে
আমার অন্তরের জিঘাংসার সন্ততিরা- ভারতের কিংবা শায়ামের-
কিংবা তোমাদের কোনও দেশ নেই- কাল নেই- তোমরা মাতুরা নও
তোমাদের যকৃতের বোধ শুধু আছে- এক খণ্ড বোয়ালের হাড় নিয়ে
কিংবা আরও নিরুদ্দেশ মৎস্যাগারে- স্ফটিকের মতো জল
লাল নীল কমলা রঙের মাছ তোমাদের লুব্ধ চোখে
প্রতিভাত হল তাই ব’স না ক’ উনুনের পাশে এসে আজ আর
কুয়াশার মতো প্রেম নিয়ে;
আজ তবু ভারতীয় মায়াবীর দড়ির মতন দীর্ঘ
এই এক ঘড়িঅলা মানুষের শরীরটা ঘিরে
তোমরা স্থানুর মতো ব’সে র’বে?- দু’ মুহূর্ত?
মনে হল যেন তারা স্থিরতর;- সারা-রাত প্লেটো পড়িলাম
অগণন মার্জারের চোখোচোখি ব’সে- তাহাদের আমিষাশী মুখের বিবরে
অনেক ঘিয়ের স্নেহে- মাছের কেকের মতো ভেজে
ধীরে-ধীরে ছুঁড়ে ফেলে- পতঞ্জলি টেনে এনে শেলফের থেকে
চিংড়ির কাটলেট বানালাম- অকস্মাৎ চেয়ে দেখি তবু
তারা কেউ নাই কোনওখানে- বহু ক্ষণ মোম উল্টায়ে
সমস্ত ধূসর বই ভস্ম ক’রে চ’লে গেছে-
অভিরাম,- পেঁচা’র খুলির থেকে কবে আমি ঘিলু এনে
নয়নে মেখেছি যেন- দেখিলাম অন্ধকারে আমার দু’ চোখ
ষড়দর্শনের পুথিগুলো আলোচনা করিতেছে
ছয়টা কড়ির কাঠে- ফুটিফাটা ভীষণ ছাদের
বিছানা, বালিশ, লাশ, গোবিমরুভূ’র মতো ঘড়িঅলা মুস্তফি’র
ভয়ঙ্কর গোঁফ- চেরাপুঞ্জি’র মেঘে সোঁদা ক্লেদ হয়ে গেছে
যেন এক গর্ভবতী মৃত রমণীর মতো
স্ফীত উদরের শীতল শিশুর সাথে মিশে গিয়ে
হিম- শান্ত সমন্বয় হয়ে আছে সব
আহা, এর চেয়ে গাঢ়তর স্বাদ আমি পাই নাই কোনও দিন’

(এত ব’লে সোমেশ্বর এক টিপ নস্য নিতে গিয়ে
শীর্ণ বিহঙ্গের মতো উড়ুক্কু দক্ষিণ হাত
ঢুকাল পকেটে- ধীরে- কেঁপে-কেঁপে- সাদা মুখে
খানিকটা রক্তের আভাস দেখা গেল,- ‘অভিরাম-‘
আধেক চামচে তেল ঢেলে যেন
স্ফীত সমুদ্রের মতো নিঃস্বতায়:
‘ছিপি খুলে সব নস্য টেলে গেছে জেভের ভিতরে
সব- সব- সব- সব- সব- সব- হায়
সব- সব- সব- সব- সব- সব- সব- সব-‘
যেন অন্ধ স্থবির- স্থবিরতম সিংহের গর্জন শোনা যায়
যখন সিংহীরা তারে খেয়ে ফেলে জঙ্ঘা খুলে
জীবনের সব-শেষ-সৈনিকের দিন তার
অবশেষে উৎসাদিত বিছানার পক্ষাঘাত হয়ে আছে ব’লে
তবু সেই জীবনের নিরাবিদ্ধ সপ্তপর্ণ
নিজেরে গুছায়ে নিল প্রতিভায়।
লক্ষ বর্গমাইল তেল ঢেলে দিল অভিচারে যেন
অসহিষ্ণু সমুদ্রের অরাজক লঙ্কাপুরে- ব্যাপৃত রাক্ষসমুণ্ডে
তারা সব মেষপালকের শান্ত দুগ্ধবতী ভেড়ার মতন
আমার সে-শিক্ষকের পানে নীরবে রহিল চেয়ে
অনেক বাদামি স্নিগ্ধ চোখ তুলে- প্রেমে- করুণায়-
জেভের ভিতরে পরিষিক্ত নস্যি যেন লজ্জা পেল
গভীর বেদনা পেল- ব্যথার জননী তবু স্মিত মুখে
লালন করিল ফের- বিক্লান্ত শিশুকে তার এক-মেঘ হাওয়া ছেড়ে দিয়ে
দূর প্রান্তরের স্থির- স্থিরতর টেলিগ্রাফ-পোস্টের ও-পার থেকে)

‘তবু আমি জীবনের এই ভয়ঙ্কর শান্ত মনীষার হাত থেকে মুক্তি চেয়ে
বাজারে- বন্দরে- হাটে- নর্দামায় ঘুরিতেছি কিছু কাল
না হলে আমার শস্য অননুভূতের কাছে- পৃথিবীর চারি-দিকে- আমারও হৃদয়ে-
মায়াবীর সোনা ব’লে মনে হবে- কিংবা ক্ষার- তার কোনও অর্থ রবে না ক’
এক দিন বাজারের পথে আমি অপ্সরির মতো এক নারী দেখিলাম
অবশ্য সে মানুষেরই ঘামপুরীষের থেকে- ঠিকুজির বৃশ্চিক-রাশিতে
চিন্তাবেদনার সূত্রে জন্মেছে এ-পৃথিবীতে
তবুও কেমন যেন অদ্ভুত আভা দেখিলাম- বড়ো বেশি রূপসি সে নয়-
শরীরকে ঘিরে আছে তার- মেটে হাঁড়িকলশির দোকানের পাশে
একাকী দাঁড়ায়ে আছি- নস্য টানিতেছি দেখে
খানিকটা উপহাসিকার মতো- মৃত হাসি সামলায়ে
থেমে গেল;- সে-ও যেন একাকিনী বধির ছাতার বাঁট ধ’রে
ভিজে বর্ষার রাতে জমাট মেঘের দিকে চলেছিল
এই সব ঘর্ষণের হাত থেকে বহু দিন মুক্ত আমি
দেশলাইয়ে ছাতকুড়া প’ড়ে গেছে বহু কাল
হৃদয়ে তবুও এক বৈদ্যুতিক ভাঁড়ার রয়েছে
যে তাহার পরিমাপ পরিচয় জানে
ত্রৈমাতুর সন্তানের মতো যেন ধরা দেয় তার হাতে
কত শত শতকেরও পর-
মনে করে সব-চেয়ে প্রিয়তম জননীর পর-‘
ব’লে সে নীরব হল কিছু ক্ষণ- ‘প্রিয় প্রিয়তম
অভিভাবিকার মতো-‘ বলিল সে সংশোধন ক’রে
একাদশী জ্যোৎস্নাকে চূর্ণ ক’রে সমুদ্রের মতো স্ফীত হয়ে
শিক্ষকের প্রাণে এত অসম্পূর্ণ আবিলতা
এর আগে কোনও দিন দেখেছি কি আমি?

‘প্রিয়- প্রিয়তম হৃদয়ের বোন নেই-
অনুভব করিলাম তবু চুপে- ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ধরিবার তরে
বন্দরের প্রব্রজ্যা নেয় কি কেউ? আচ্ছন্ন ট্যাকের থেকে
নস্যের শিশি খুলে সংবেদনা শুধিলাম বার-বার
সেই দেবদূত-রমণীর দীপ্তি থেকে
নির্ভয়ে বাঁচায়ে নিতে আপনাকে
হাঁড়িকুড়িকলশির আস্তানার পাশে
মৃতবৎসা এক ভিক্ষুণীর সদ্য-মরা শিশুরেও অবহেলা ক’রে
আমার সে-হৃদয়ের বোন চলে মার্কনি’র বিজ্ঞানের মতো বেগে
ফিরেও সে তাকাল না সেই মড়া- কাঠমড়া সন্তানের পানে
এ এক আশ্চর্য বিস্ময়- অভিরাম- হয়তো বিমুক্ত তারা
হয়তো-বা অপ্সরি-ই- হয়তো-বা অমরার চাঁদনির চকে
থাকে তারা অন্য এক হিরণ্যের পাশে- যোনির ভিতর থেকে
বার-বার জ’ন্মে- দীর্ণ হয়ে- অবশেষে বর্ণলাভ করে
বালটিক সমুদ্রের বড়ো সাদা বিহঙ্গের মতো উড়ে যায়
আমাদের কাজ আমাদের হাতে ফেলে রেখে।
য়ুরোপের মধ্যযুগে এদেরই কি বলেছিল সিলফ্- সালামান্ডার?
কোনও রাতে মোম জ্বেলে পতঞ্জলি খুলি যদি আর-এক বার আমি
হয়তো সে- সেই আভা আমার উরসে এসে বাসা নেবে-‘
ব’লে সোমেশ্বর হাড়গিলা-হাসি হাসিল নিরেট-
সমস্ত পাঁজর তার যেন ডিম ডাইনোসর-যুগে
আভাময়ী নিসর্গের সাথে ল’ড়ে প্রাঞ্জল আঁধার মমি হয়ে গেছে
মৃৎকাপাসের মতো মেঘে পায় নাই অরুণকে তবু
অনন্ত অবজ্ঞা থেকে বলিতেছে যেন সেই ক্লান্ত পিতৃলোক:
‘কিছু নাই- নাই কিছু- কোনও দিন আমাদের তরে নাই’

‘চোখ চেয়ে দেখিলাম আমার সে-সালামান্ডার
গ্যাসের আলোর নিচে দীর্ঘ এক আগুনের মেনকা’র মতন দাঁড়ায়ে
পৃথিবীর কোনও এক ব্যূঢ় উৎসাহীর সাথে বুঝিতেছে জীবনের দাম
তার পর ক্লান্ত এক খরিশের প্লীহা আর যকৃৎ ঘেঁষে
দুইটা লোহার রড হঠাৎ উঠিল নেচে- রিকশায়- ভৌতিক বাতাসের মতো
দুই জন চ’ড়ে উড়ে চ’লে গেল সব-শেষ গ্যাসপোস্ট কুয়াশার দিকে
হয়তো সে দার্শনিক উচ্চতর- অভিরাম?-
নিয়ে গেল গূঢ় ভালোবেসে সিলফ্ যারে
দর্শনীয় কোলে সিলফ্ নেমে আসে: পৃথিবীর মধ্যযুগ কহিতেছে
আধুনিক ভারতীয় দীপ্তিও: মহামনীষীর সাথে তাদের মিলন হয়
মোমের আলোর পাশে নির্মল বয়স্ক শীত-রাতে-
আমার ট্যাঁকের থেকে চারটি পয়সা তুলে দিলাম পথের শৃগালীকে
মৃত শিশুটির ব্যথা ভুলে আহরণ করিল তা
বুঝিলাম হয়তো সে জননীও নয়- কিংবা জননীর দিন
বহু কাল শেষ হয়ে গেছে তার
গভীর সেচের চালনায় যেন সপ্রতিভ সিক্ততায়
কুষ্ঠবিছানায় শুয়ে; অমৃতের মতো ক’রে হাইড্রেন্ট থেকে ক্ষোভ গিলে
জীবধাত্রী নিসর্গের মতো হয়ে গেছে সে-ও আজ।’

‘তার পিছে আর-এক জন আমি দেখিলাম- দাঁড়ায়েছে এসে
অন্ধকার থেকে যেন- পাকস্থলী থেকে মশাল উদ্বৃত্ত ক’রে
মার’এর কন্যার মতো;- কোনও বোধিদ্রুম ঘিরে- আমি তবু বুদ্ধ নই
এরা সব পঙ্গপাল- পুস্তক-স্বপ্নের থেকে যেই সব অরুন্তুদ বিম্ব জন্মে
সোনার ফানুস হয়ে উড়ে যায়- কড়িবর্গার দিকে লাইব্রেরির
সেই সব দিন শেষ হয়ে গেছে মোর- আমি আজ গ্রন্থিল শিকড়:
কাঁচের গেলাসে জল, রেড়ির প্রদীপ, কপালের বলিরেখা থেকে খ’সে গিয়ে।
এই সব কুমড়ো-খেতের প্লুত কাঁকড়ার দল- আধােভয়ে, আধেক গুমরে
দাঁড়া প্রসারিত ক’রে দেয়- যেন তারা বুলবুল হয়ে উড়ে যেতে চায়
কোনও নীল চক্রবালে- মর্মরিত সেগুনের কুঞ্জের ভিতরে?
তারা অত ভ্রান্ত নয়;- গৃহকোণে সমীচীন গ্রন্থ-মনীষার ব্যাপারিরা ছাড়া
সকলেই জীবনের দাম জানে- যে যাহার স্থলে উকুনের মতো
(উকুনের মতো) অভিষিক্ত হয়ে থাকে- রমণীর জটার ভিতরে
কিংবা কুরূপার কিংবা রূপসির মুণ্ড? এই ভেবে জীবনকে ভাঁড়ায় না।’

‘দেঁতো হাসি নয়- নিমের মতন সুস্থ পরিচ্ছন্ন নির্জলা আমোদে
তাহার কুৎসিত গাল লঘু আরক্তিম যেন এক অন্যতর ছায়া-প্রক্রিয়ায়
আমার হৃদয়ে তার হৃদয়ের মেধাবী ইশারা ঢেলে দিল
চোয়ালে প্রাঞ্জল পেশি ব্যক্ত ক’রে তবু আমি
ঘাড় হেঁট ক’রে- মিনিট পাঁচেক- সেখানে দাঁড়ায়ে থেকে
তৌলদণ্ডে মাপ ক’রে দেখিলাম- বরং এ নিম্ন নারীটির সম্ভাষণ
আমার এ-জীবনের ব্যাপ্ত প্রণিধানে কোনও ব্যূঢ় ঈর্ষা আনিবে না
সে যেন নদীর মতো- চলাচল পাহাড়ের মুখে
রুদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়েছে- মনে হল- একটি হিমানী রজনীর
প্রকাণ্ড চাঙড় ভেঙে তাহার শকুন-পাখা পরিস্রুত ব্যাসের প্রবাদে-
হয়তো-বা কোনও দিগন্তের নিরুদ্দেশে- কেউ এসে ছেড়ে দেবে এক দিন।
আমি তবু মৃত্যু নই- জ্যোতির্গময় নই- নির্বাণের তথাগত নই।’

‘গ্যাসের আলোয়- গলির আঁধারে- নিমজ্জিত ভিড়ে
অনন্ত ঢেকুর তুলে মনে হল আর-এক বার
সময়ের কোল থেকে মুহূর্তেরা শশকের ছানার মতন
ফণিমনসার থেকে লাফ দিয়ে লজ্জাবতী কাঁটার আঁধার ঝোপে
চরিতেছে;- মানুষেরা তৃপ্তি কুড়াতেছে তাহাদের পিছে ধেয়ে
উত্তেজনা- রাক্ষসিক কল্পনার অভিচার- শশকের মূঢ় স্বচ্ছ মাংসের উষ্ণতা
অনুভব ক’রে;- কিংবা অবসরে- শিকারের অপস্রিয়মাণ
ভীরু জঙ্ঘা থেকে চোখ তুলে
পথের পাশের কোনও অর্জুন তরু-বীথিকার
রহস্যের ক্রমণীয়মান কুজ্ঝটিকাময় সবুজ কপাটে
চশমার সমুজ্জ্বল ব্রেজিল-পাথর চুর্ণ ক’রে ফেলে
অমোঘ চাঁদের পাশে ধবল মেঘকে তার দুর্গ ব’লে মনে হয়
যেখানে সে ছিল এক দিন- হয়তো-বা যাবে- সকলেই যাবে এক দিন।
তবু তার দানবীয় কল্পনার স্পেন-দুর্গ নিমেষেই বৈজ্ঞানিক হাসির ক্ষমায়
অনৃত ধোঁয়ায় ভরা দূর নীলিমাকে পরাহত ক’রে ফিরে আসে
সাধু ঋদ্ধ সঙ্কল্পের ক্ষোভে যেন আবার সে মৃত্তিকায় আসে নেমে
অধীর ধূসর এক অধর্ষণীয়তাকে লক্ষ ক’রে
নাসিকার নিম্নভূমিটিকে, আহা, বধ ক’রে, শূল্যমাংস খায়
মুহুর্তের- মুহুর্তের;- এই সব অনুপল নিপল তবুও
বাতাপীর মতো যেন কোনও মায়াবীর নিশিডাক শুনে
মানবকে চূর্ণ ক’রে চ’লে যায়। জননীর ধীর স্তন
শিশুটির মুখে- আধােঘুমে- নিমেষের বিমূঢ়তা;-
একটি সুদীর্ঘতম দিন ঘিরে সংজ্ঞা পায়- দীপ্তি পায়- জননীর প্রাণের নিকটে।’

‘ক্ষয়িষ্ণু রাত্রির শেষে এই বার জেগে উঠে ত্রস্ত পদে বিড়ি তুলে নিয়ে
ঘনিষ্ঠ অব্যয় কেরোসিন-দীপ হাতে ক’রে হয়তো-বা টের পাবে দ্বিপদ মানুষ
পেঁচা’রা মিশিয়া গেছে ধাঁধা হয়ে সুদূরের অরণ্যের অন্ধকারে
নামিতেছে স্মরণীয় দিনের প্রবাদ- প্রবাল-প্রেমিক এক
ভয়াবহ ভারতীয় যুবার মতন
ঝিনুকের রক্ত কারাগার থেকে
প্রাথমিক রূঢ় আনন্দের অমোঘ বিলাপে
দুরূহ মানুষ-ব্যান আবিষ্কার ক’রে- আবিষ্কৃত হয়ে।’