১৪০০ সাল

আজি হ’তে শত বর্ষ আগে!
কে কবি, স্মরণ তুমি ক’রেছিলে আমাদেরে শত আনুরাগে,
আজি হ’তে শত বর্ষ আগে!

ধেয়ানী গো, রহস্য-দুলাল!
উতারি’ ঘোমটাখানি তোমার আঁখির আগে
কবে এল সুদূর আড়াল?
আনাগত আমাদের দখিন-দূয়ারি
বাতায়ন খুলি তুমি, হে গোপন হে স্বপ্ন-চারী,
এসেছিলে বসন্তের গন্ধবহ-সাথে,
শত বর্ষ পরে যেথা তোমার কবিতাখানি
পড়িতেছি রাতে।
নেহারিলে বেদনা-উজ্জ্বল আঁখি-নীরে,
আনমনা প্রজাপতি নীরব পাখায়
উদাসীন, গেলে ধীরে ফিরে!

আজি মোরা শত বর্ষ পরে
যৌবন-বেদনা-রাঙা তোমার কবিতাখানি
পড়িতেছি অনুরাগ-ভরে।
জড়িত জাগর ঘুমে শিথিল শয়নে
শুনিতেছি প্রিয়া মোর তোমার ইঙ্গিত-গান
সজল নয়নে।
আজো হায়
বারেবারে খুলে যায়
দক্ষিণের রুদ্ধ বাতায়ন,
গুমরি গুমরি কাঁদে উচাটন বসন্ত-পবন
মনে মনে বনে বনে পল্লব-মর্মরে,
কবরীর অশ্রুজল বেশী-খসা ফুল-দল
পড়ে ঝ’রে ঝ’রে!

ঝিরিঝিরি কাঁপে কালো নয়ন-পল্লব,
মধুপের মুখ হতে কাড়িয়া মধুপী পিয়ে পরাগ-আসব!
কপোতের চষ্ণুপুটে কপোতীর হারায় কূজন
পরিয়াছে বনবধূ যৌবন-আরক্তিম কিংশুক-বসন।
রহিয়া রহিয়া আজো ধরনীর হিয়া
সমীর-উচ্ছ্বাসে যেন উঠে নিঃশ্বসিয়া!

তোমা হতে শত বর্ষ পরে-
তোমার কবিতাখানি পড়িতেছি, হে কবীন্দ্র,
অনুরাগ-ভরে!
আজি এই মদালসা ফাগুন-নিশীথে
তোমার ইঙ্গিত জাগে তোমার সঙ্গীতে!
চতুরালি, ধরিয়াছি তোমার চাতুরী!
করি চুরি
আসিয়াছ আমাদের দুরন্ত যৌবনে,
কাব্য হয়ে, গান হয়ে, সিক্তকন্ঠে রঙ্গীলা স্বপনে।
আজিকার যত ফুল- বিহঙ্গের যত গান
যত রক্ত-রাগ
তব অনুরাগ হতে হে চির-কিশোর কবি,
আনিয়াছে ভাগ!
আজি নব-বসন্তের প্রভাত-বেলায়
গান হয়ে মাতিয়াছে আমাদের যৌবন-মেলায়।

আনন্দ-দুলাল ওগো হে চির অমর!
তরুণ তরুণি মোরা জাগিতেছি আজ তব
মাধবী বাসর!
যত গান গাহিয়াছ ফুল-ফোটা রাতে-
সবগুলি তার
একবার-তা’পর আবার
প্রিয়া গাহে, আমি গাহি, আমি গাহি প্রিয়া গাহে সাথে।
গান-শেষে অর্ধরাতে স্বপনেতে শুনি
কাঁদে প্রিয়া, ‘ওগো কবি ওগো বন্ধু ওগো মোর গুণী-‘
স্বপ্ন যায় থামি’,
দেখি, বন্ধু, আসিয়াছ প্রিয়ার নয়ন-পাতে
অশ্রু হয়ে নামি’!

মন লাগে, শত বর্ষ আগে
তুমি জাগো-তব সাথে আরো কেহ জাগে
দূরে কোন্ ঝিলিমিলি-তলে
লুলিত-অঞ্চলে।
তোমার ইঙ্গিতখানি সঙ্গীতের করুণ পাখায়
উড়ে যেতে যেতে সেই বাতায়নে ক্ষণিক তাকায়,
ছুঁয়ে যায় আখি-জল রেখা,
নুয়ে যায় অলক-কুসুম,
তারপর যায় হারাইয়া,-তুমি একা বসিয়া নিঝ্ঝুম।
সে কাহার আঁখিনীর-শিশির লাগিয়া,
মুকুলিকা বাণী তব কোনোটি বা ওঠে মঞ্জুরিয়া,
কোনোটি বা তখনো গুঞ্জরি ফেরে মনে
গোপনে স্বপনে!

সহসা খুলিয়া গেল দ্বার,
আজিকার বসন্ত-প্রভাতখানি দাঁড়াল করিয়া নমস্কার।
শতবর্ষ আগেকার তোমারি সে বাসন্তিকা দূতী
আজি তব নবীনের জানায় আকুতি! …

হে কবি-শাহান-শাহ। তোমারে দেখিনি মোরা,
সৃজিয়াছ যে তাজমহল-
শ্বেতচন্দনের ফোঁটা কালের কপোলে ঝলমল-
বিস্ময়-বিমুগ্ধ মোরা তাই হেরি,
যৌবনেরে অভিশাপি-‘কেন তুই শতবর্ষ করিলি রে দেরী?’
হায়, মোরা আজ
মোম্তাজে দেখিনি, শুধু দেখিতেছি তাজ!

শতবর্ষ পরে আজি হে কবি-সম্রাট!
এসেছে নূতন কবি-করিতেছে তব নান্দীপাঠ!
উদয়াস্ত জুড়ি’ আজো তব
কত না বন্দনা-ঋক ধ্বনিছে নব নব।
তোমারি সে হারা-সুরখানি
নববেণু-কুঞ্জে-ছায়ে বিকশিয়া তোলে নব বাণী।

আজি তব বরে
শত বেণু-বীণা বাজে আমাদের ঘরে।
তবুও পুরে না হিয়া ভরে নাকো প্রাণ,
শতবর্ষ সাঁতরিয়া ভেসে আসে স্বপ্নে তব গান।
মনে হয়, কবি,
আজো আছ অস্তপাট আলো করি’
আমাদেরি রবি!

আজি হতে শত বর্ষ আগে
যে-অভিবাদন তুমি করেছিলে নবীনেরে
রাঙা অনুরাগে,
সে-অভিবাদনখানি আজি ফিরে চলে
প্রণামী-কমল হয়ে তব পদতলে!

মনে হয়, আসিয়াছ অপূর্ণের রূপে
ওগো পূর্ণ আমাদেরি মাঝে চুপে চুপে!
আজি এই অপূর্ণের কম্প্র কন্ঠস্বরে
তোমারি বসন্তগান গাহি তব বসন্ত-বাসরে-
তোমা হতে শতবর্ষ পরে!

[কবি-সম্রাট রবীন্দ্রনাথের ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে’ পড়িয়া]