কথোপকথন ২

শুভঙ্কর-
এখন অজ্ঞাতবাস মনে হচ্ছে সাতটা বছর।
সাতটা বছর যেন লেপমুড়ি দেওয়া ঘুমঘোরে
দুঃস্বপ্নের কারফিউয়ে বিকল।
অথচ ছিলাম জেগে ধুলো-ঝড়ে, রক্তে
অগ্নিপাতে।
এই অন্ধ যুগে ঠিক যেভাবে জাগার প্রয়োজন।
পায়ের তলায় জল, খাটে এসে বসে খরস্রোত
বিছানা বালিশসহ স্মৃতিচিত্রে তোড়ের ভাসান।
চুরমার ধ্বংসশব্দ শহরে ও গ্রামে
শহর এবং গ্রাম একই শোকোচ্ছাসে একাকার।
ঈগলের তীক্ষ্ণ নখ শিল্পের আঁতুড়ঘরে ঢুকে
তছনছ ঘাটাঘাটি, রচনা রক্তাক্ত হয়ে যায়।
পত্রিকায় পাতা থেকে বীজ ওড়ে নিবীর্যকরণে,
বক্তৃতায় বেদী থেকে বীজ ওড়ে গণধর্ষণের।

এই অন্ধযুগে ঠিক যতখানি জাগা প্রয়োজন
নিশ্চিত জেগেছি। তবু যেই তুমি হারিয়ে যাওয়ার
চিরস্থির যবনিকা দুহাতে সরিয়ে মঞ্চে এলে
অবিশ্বাস্য আবির্ভাবে রক্তরোলে নবজাগরণ।
তোমার চোখের স্বাতী তারা
আমার আকাশ ছুঁয়ে জ্বলে উঠল যেই
সমস্ত পশ্চাদপট ঘুম হয়ে গেল।
আমি যেন নবজাত, যেন পৌরাণিক
সমুদ্রমন্থন থেকে সদ্য অভ্যুদয়।
ভবিষ্যতে মিশে গেল সমস্ত অতীত
দূর ভবিষ্যৎ ছুঁয়ে ব্যপ্ত হয়ে গেল বর্তমান।

ভীষণ জাগার শব্দে পাহাড়ি নদীর জলোচ্ছাস
নন্দিনী বিশ্বাস করো, রক্তস্রোতে এই তোলপাড়
আমাকে আমার চেয়ে দীর্ঘ করে তুলেছে এখন।

নন্দিনী-
তোমার সীমারেখা দীর্ঘ হোক
আমার সবচেয়ে আন্তরিক
কামনা ছিল, আছে, থাকবে তা।
প্রবাসে যতবার তোমার মুখ
ভেসেছে মনে, খর রোদের রং
ঝিলিক দিয়ে গেছে তৎক্ষণাৎ।

এত যে পাথরের বিঘ্ন পথ
এত যে নিয়মের খাড়া দেয়াল
তবু যে ফিরে আসি সে তো জানোই
তোমার নচিকেতা মূর্তিকেই
জোগাতে সাধ্যের সঞ্জীবন।

শুভঙ্কর-
পুনরায় ফিরে এসে অতিশয় কৃতজ্ঞ করেছ।

সময়ের অভ্যন্তরে এখন ব্যাপক বিস্ফোরণ।
অভিন্ন সম্পর্ক খুঁজে সময়ের যত কাছে যাই
বিচ্ছিন্নতা দূরে ঠেলে, রথের চাকার পাকে পাকে
জড়িয়ে গিয়েছে রশি, ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় তাই
সমগ্রের স্বরূপ। আদিম দামামাধ্বনি থেকে
যৌথনৃত্য জাগানোর ব্রত খসে গেছে।
এখন শিকারই ধ্রুব, হননপ্রধান অভিযান।

যার হাতে হাত রাখি উষ্ণতার বিনিময় খুঁজে
তারই অস্ত্র বুকে বেঁধে। চতুর্দিকে উদ্যত কুঠার।
বৃক্ষের বিকাশ যেন মানুষের কিংবা সময়ের
ঘোরতর প্রতিপক্ষ, জঙ্গলই যথার্থ অভিপ্রেত।
মুক্তির স্থাপত্য ঘিরে আজ শুধু যুক্তির জঙ্গল।

ক্রমে একা হতে হতে জীবনীশক্তির অপচয়ে
রক্তে রক্তে অসুস্থতা কাঁটাতারে ঘিরেছে যখন,
তখনই এসেছ ফিরে। এখন বিশ্বাস করতে পারি
আমার নিজস্ব বিশ্ব পুনরায় রাঙা হয়ে যাবে
সেজানের আপেলের সবুজের আলোর দ্যুতিতে

নন্দিনী-
ভারি কথা শুনতে ভয় করে
অন্য কিছু বলো বা শোনাও
ইদানীং লেখা কবিতার
একটা দুটো, যা ইচ্ছে তোমার।

শুভঙ্কর-
কি হবে ওসব পুরনো কবিতা শুনে?
নতুন কবিতাগুচ্ছ শোনাতে পারি
প্রতি চুম্বনে কালিদাস ভবভূতি
করে দাও যদি, কিংবা কৃত্তিবাস।

কবিতাগুচ্ছ, পদ্মপাতার ঢেউ
কবিতাগুচ্ছ, সন্ত্রাসবাদী চোখ।
কবিতাগুচ্ছ, গোলাগের চেনা কেউ
কবিতাগুচ্ছ, রূঢ়ভাসী কোন লোক।

কবিতাগুচ্ছ, বর্শার নীল ফলা
কবিতাগুচ্ছ, ঝরাপাতাদের নাচ।
কবিতাগুচ্ছ, মোমবাতিদের গলা
কবিতাগুচ্ছ, ভাতের উনোনে আঁচ।

কবিতাগুচ্ছ, নতুন ছবির ফ্রেম
কবিতাগুচ্ছ, শৃঙ্খলে ঝঙ্কার।
কবিতাগুচ্ছ, ঘাস ও ফড়িং এ প্রেম
কবিতাগুচ্ছ, তোমাকে আবিষ্কার।