মাল্যতত্ত্ব

লাইব্রেরিঘর, টেবিল-ল্যাম্পো জ্বালা,-
লেগেছি প্রুফ-করেক্শনে গলায় কুন্দমালা।
ডেস্কে আছে দুই পা তোলা, বিজন ঘরে একা,
এমন সময় নাতনি দিলেন দেখা।।

সোনার কাঠির শিহরলাগা বিশবছরের বেগে
আছেন কন্যা দেহে মনে পরিপূর্ণ জেগে।
হঠাৎ পাশে আসি
কটাক্ষেতে ছিটিয়ে দিল হাসি,
বললে বাঁকা পরিহাসের ছলে
“কোন্ সোহাগির বরণমালা পরেছ আজ গলে।”
একটু থেমে দ্বিধার ভানে নামিয়ে দিয়ে চোখ
বলে দিলেম, “যেই বা সে-জন হোক
বলব না তার নাম-
কী জানি, ভাই, কী হয় পরিণাম।
মানবধর্ম, ঈর্ষা বড়ো বালাই,
একটুতে বুক জ্বালায়।”

বললে শুনে বিংশতিকা, “এই ছিল মোর ভালে-
বুক ফেটে আজ মরব কি শেষকালে,
কে কোথাকার তার উদ্দেশে করব রাগারাগি
মালা দেওয়ার ভাগ নিয়ে কি, এমনি হতভাগি।”
আমি বললেম, “কেনই বা দাও লাজ,
করোই-না আন্দাজ।”
বলে উঠল, “জানি, জানি, ওই আমাদের ছবি,
আমারই বান্ধবী।
একসঙ্গে পাস করেছি ব্রাহ্ম-গার্ল্-স্কুলে,
তোমার নামে চোখ পড়ে তার ঢুলে।
তোমারও তো দেখেছি ওর পানে
মুগ্ধ আঁখি পক্ষপাতের কটাক্ষসন্ধানে।”
আমি বললেম, “নাম যদি তার শুনবে নিতান্তই-
আমাদের ওই জগা মালী, মৃদুস্বরে কই।”
নাতনি বলে, “হায় কী দুরবস্থা,
বয়স হয়ে গেছে ব’লেই কণ্ঠ এতই সস্তা।
যে গলাটায় আমরা গলগ্রহ
জগামালীর মালা সেথায় কোন্ লজ্জায় বহ।”
আমি বললেম, “সত্য কথাই বলি,
তরুণীদের করুণা সব দিলেম জলাঞ্জলি।
নেশার দিনের পারে এসে আজকে লাগে ভালো,
ওই যে কঠিন কালো।
জগার আঙুল মালা যখন গাঁথে
বোকা মনের একটা কিছু মেশায় তারই সাথে।
তারই পরশ আমার দেহ পরশ করে যবে
রস কিছু তার পাই যে অনুভবে।
এ-সব কথা বলতে মানি ভয়
তোমার মতো নব্যজনের পাছে মনে হয়-
এ বাণী বস্তুত
কেবলমাত্র উচ্চদরের উপদেশের ছুতো,
ডাইডাক্টিক্ আখ্যা দিয়ে যারে
নিন্দা করে নতুন অলংকারে।
গা ছুঁয়ে তোর কই,
কবিই আমি, উপদেষ্টা নই।
বলি-পড়া বাকলওয়ালা বিদেশী ওই গাছে
গন্ধবিহীন মুকুল ধরে আছে
আঁকাবাঁকা ডালের ডগা ধূসর রঙে ছেয়ে-
যদি বলি ওটাই ভালো মাধবিকার চেয়ে,
দোহাই তোমার কুরঙ্গনয়নী,
ব্যঙ্গকুটিল-দুর্বাক্য-চয়নী,
ভেবো না গো, পূর্ণচন্দ্রমুখী,
হরিজনের প্রপাগ্যাণ্ডা দিচ্ছে বুঝি উঁকি।
এতদিন তো ছন্দে-বাঁধা অনেক কলরবে
অনেকরকম রঙ-চড়ানো স্তবে
সুন্দরীদের জুগিয়ে এলেম মান-
আজকে যদি বলি ‘আমার প্রাণ
জগামালীর মালায় পেল একটা কিছু খাঁটি’,
তাই নিয়ে কি চলবে ঝগড়াঝাঁটি।”
নাতনি কহেন, “ঠাট্টা করে উড়িয়ে দিচ্ছ কথা,
আমার মনে সত্যি লাগায় ব্যথা।
তোমার বয়স চারিদিকের বয়সখানা হতে
চলে গেছে অনেক দূরের স্রোতে।
একলা কাটাও ঝাপসা দিবসরাতি,
নাইকো তোমার আপন দরের সাথি।
জগামালীর মালাটা তাই আনে
বর্তমানের অবজ্ঞাভার নীরস অসম্মানে।”
আমি বললেম, “দয়াময়ী, ওইটে তোমার ভুল,
ওই কথাটায় নাইকো কোনো মূল।
জান তুমি, ওই যে কালো মোষ
আমার হাতে রুটি খেয়ে মেনেছে মোর পোষ,
মিনি-বেড়াল নয় বলে সে আছে কি তার দোষ।
জগামালীর প্রাণে
যে জিনিসটা অবুঝভাবে আমার দিকে টানে
কী নাম দেব তার,
একরকমের সেও অভিসার।
কিন্তু সেটা কাব্যকলায় হয় নি বরণীয়,
সেই কারণেই কণ্ঠে আমার সমাদরণীয়।”
নাতনি হেসে বলে,
“কাব্যকথার ছলে
পকেট থেকে বেরোয় তোমার ভালো কথার থলি,
ওটাই আমি অভ্যাসদোষ বলি।”
আমি বললেম, “যদি কোনোক্রমে
জন্মগ্রহের ভ্রমে
ভালো যেটা সেটাই আমার ভালো লাগে দৈবে,
হয়তো সেটা একালেরও সরস্বতীর সইবে।”
নাতনি বলে, “সত্যি বলো দেখি,
আজকে-দিনের এই ব্যাপারটা কবিতায় লিখবে কি।”
আমি বললেম, “নিশ্চয় লিখবই,
আরম্ভ তার হয়েই গেছে সত্য করেই কই।
বাঁকিয়ো না গো পুষ্পধনুক-ভুরু,
শোনো তবে, এইমতো তার শুরু।-
‘শুক্ল একাদশীর রাতে
কলিকাতার ছাতে
জ্যোৎস্না যেন পারিজাতের পাপড়ি দিয়ে ছোঁওয়া,
গলায় আমার কুন্দমালা গোলাপজলে ধোওয়া’-
এইটুকু যেই লিখেছি সেই হঠাৎ মনে প’ল,
এটা নেহাত অসাময়িক হল।
হাল ফ্যাশানের বাণীর সঙ্গে নতুন হল রফা,
একাদশীর চন্দ্র দেবেন কর্মেতে ইস্তফা।
শূন্যসভায় যত খুশি করুন বাবুয়ানা,
সত্য হতে চান যদি তো বাহার-দেওয়া মানা।
তা ছাড়া ওই পারিজাতের ন্যাকামিও ত্যাজ্য,
মধুর করে বানিয়ে বলা নয় কিছুতেই ন্যায্য।
বদল করে হল শেষে নিম্নরকম ভাষা-
“আকাশ সেদিন ধুলোয় ধোঁয়ায় নিরেট করে ঠাসা,
রাতটা যেন কুলিমাগি কয়লাখনি থেকে
এল কালো রঙের উপর কালির প্রলেপ মেখে।’
তার পরেকার বর্ণনা এই- ‘তামাক-সাজার ধন্দে
জগার থ্যাবড়া আঙুলগুলো দোক্তাপাতার গন্ধে
দিনরাত্রি ল্যাপা।
তাই সে জগা খ্যাপা
যে মালাটাই গাঁথে তাতে ছাপিয়ে ফুলের বাস
তামাকেরই গন্ধের হয় উৎকট প্রকাশ।'”
নাতনি বললে বাধা দিয়ে, “আমি জানি জানি,
কী বলে যে শেষ করেছ নিলেম অনুমানি।
যে তামাকের গন্ধ ছাড়ে মালার মধ্যে, ওটায়
সর্বসাধারণের গন্ধ নাড়ীর ভিতর ছোটায়।
বিশ্বপ্রেমিক, তাই তোমার এই তত্ত্ব-
ফুলের গন্ধ আলংকারিক, এ গন্ধটাই সত্য।”
আমি বললেম, “ওগো কন্যে, গলদ আছে মূলেই,
এতক্ষণ যা তর্ক করছি সেই কথাটা ভুলেই।
মালাটাই যে ঘোর সেকেলে, সরস্বতীর গলে
আর কি ওটা চলে।
রিয়ালিস্টিক প্রসাধন যা নব্যশাস্ত্রে পড়ি-
সেটা গলায় দড়ি।”

নাতনি আমার ঝাঁকিয়ে মাথা নেড়ে
এক দৌড়ে চলে গেল আমার আশা ছেড়ে।।

শ্যামলী, শান্তিনিকেতন
৩১ ডিসেম্বর, ১৯৩৮
[১৫ পৌষ, ১৩৪৫]