মিলনযাত্রা

চন্দনধূপের গন্ধ ঠাকুরদালান হতে আসে,
শান-বাঁধা আঙিনার একপাশে
শিউলির তল
আছন্ন হতেছে অবিরল
ফুলের সর্বস্বনিবেদনে।
গৃহিণীর মৃতদেহ বাহির-প্রাঙ্গণে
আনিয়াছে বহি;
বিলাপের গুঞ্জরণ স্ফীত হয়ে ওঠে রহি রহি;
শরতের সোনালি প্রভাতে
যে আলোছায়াতে
খচিত হয়েছে ফুলবন,
মৃতদেহ-আবরণ
আশ্বিনের সেই ছায়া-আলো
অসংকোচে সহজে সাজালো।

জয়লক্ষ্মী এ ঘরের বিধবা ঘরণী
আসন্ন মরণকালে দুহিতারে কহিলেন, “মণি,
আগুনের সিংহদ্বারে চলেছি যে দেশে
যাব সেথা বিবাহের বেশে।
আমারে পরায়ে দিয়ো লাল চেলিখানি,
সীমন্তে সিঁদুর দিয়ো টানি।”
যে উজ্জ্বল সাজে
একদিন নববধূ এসেছিল এ গৃহের মাঝে,
পার হয়েছিল যে দুয়ার,
উত্তীর্ণ হল সে আরবার
সেই দ্বার সেই বেশে
ষাট বৎসরের শেষে।
এই দ্বার দিয়ে আর কভু
এ সংসারে ফিরিবে না সংসারের একচ্ছত্র প্রভু।
অক্ষুণ্ন শাসনদণ্ড স্রস্ত হল তার,
ধনে জনে আছিল যে অবারিত অধিকার
আজি তার অর্থ কী যে!
যে আসনে বসিত সে তারও চেয়ে মিথ্যা হল নিজে।

প্রিয়মিলনের মনোরথে
পরলোক-অভিসার-পথে
রমণীর এই চিরপ্রস্থানের ক্ষণে
পড়িছে আরেক দিন মনে।

আশ্বিনের শেষভাগে চলেছে পূজার আয়োজন;
দাসদাসী-কলকণ্ঠ-মুখরিত এ ভবন
উৎসবের উচ্ছল জোয়ারে
ক্ষুব্ধ চারি ধারে।
এ বাড়ির ছোটো ছেলে অনুকূল পড়ে এম। এ। ক্লাসে,
এসেছে পূজার অবকাশে।
শোভদর্শন যুবা, সবচেয়ে প্রিয় জননীর,
বউদিদিমণ্ডলীর
প্রশ্রয়ভাজন।
পূজার উদ্যোগে মেশে তারও লাগি পূজার সাজন।

একদা বাড়ির কর্তা স্নেহভরে
পিতৃমাতৃহীন মেয়ে প্রমিতারে এনেছিল ঘরে
বন্ধুঘর হতে; তখন বয়স তার ছিল ছয়,
এ বাড়িতে পেল সে আশ্রয়
আত্মীয়ের মতো।
অনুদাদা কতদিন তারে কত
কাঁদায়েছে অত্যাচারে।
বালক-রাজারে
যত সে জোগাত অর্ঘ্য ততই দৌরাত্ম্য যেত বেড়ে;
সদ্যবাঁধা খোঁপাখানি নেড়ে
হঠাৎ এলায়ে দিত চুল
অনুকূল;
চুরি করে খাতা খুলে
পেন্সিলের দাগ দিয়ে লজ্জা দিত বানানের ভুলে।
গৃহিণী হাসিত দেখি দুজনের এ ছেলেমানুষি-
কভু রাগ, কভু খুশি,
কভু ঘোর অভিমানে পরস্পর এড়াইয়া চলা,
দীর্ঘকাল বন্ধ কথা বলা।

বহুদিন গেল তার পর।
প্রমির বয়স আজ আঠারো বছর।
হেনকালে একদা প্রভাতে
গৃহিণীর হাতে
চুপি চুপি ভৃত্য দিল আনি
রঙিন কাগজে লেখা পত্র একখানি।
অনুকূলে লিখেছিল প্রমিতারে
বিবাহপ্রস্তাব করি তারে।
বলেছিলে, “মায়ের সম্মতি
অসম্ভব অতি।
জাতের অমিল নিয়ে এ সংসারে
ঠেকিবে আচারে।
কথা যদি দাও, প্রমি, চুপি চুপি তবে
মোদের মিলন হবে
আইনের বলে।”

দুর্বিষহ ক্রোধানলে
জয়লক্ষ্মী তীব্র উঠে দহি।
দেওয়ানকে দিল কহি,
“এ মুহূর্তে প্রমিতারে
দূর করি দাও একেবারে।”

ছুটিয়া মাতারে এসে বলে অনুকূল,
“করিয়ো না ভুল;
অপরাধ নাই প্রমিতার,
সম্মতি পাই নি আজও তার।
কর্ত্রী তুমি এ সংসারে;
তাই বলে অবিচারে
নিরাশ্রয় করি দিবে অনাথারে, হেন অধিকার
নাই নাই, নাইকো তোমার।
এই ঘরে ঠাঁই দিল পিতা ওরে,
তারই জোরে
হেথা ওর স্থান
তোমারই সমান।
বিনা অপরাধে
কী স্বত্বে তাড়াবে ওরে মিথ্যা পরিবাদে।”

ঈর্ষাবিদ্বেষের বহ্নি দিল মাতৃমন ছেয়ে-
“ওইটুকু মেয়ে
আমার সোনার ছেলে পর করে,
আগুন লাগিয়ে দেয় কচি হাতে এ প্রাচীন ঘরে!
অপরাধ! অনুকূলে ওরে ভালোবাসে এই ঢের,
সীমা নেই এ অপরাধের।
যত তর্ক কর তুমি, যে যুক্তি দাও-না
ইহার পাওনা
ওই মেয়েটাকে হবে মেটাতে সত্বর।
আমারই এ ঘর
আমারই এ ধনজন
আমারই শাসন,
আর কারো নয়,
আজই আমি দেব তার পরিচয়।”
প্রমিতা যাবার বেলা ঘরে দিয়ে দ্বার
খুলে দিল সব অলংকার।
পরিল মিলের শাড়ি মোটাসুতা-বোনা।
কানে ছিল সোনা,
কোনো জন্মদিনে তার
স্বর্গীয় কর্তার উপহার,
বাক্সে তুলি রাখিল শয্যায়।
ঘোমটায় সারামুখ ঢাকিল লজ্জায়।

যবে, হতে গেল পার
সদরের দ্বার,
কোথা হতে অকস্মাৎ
অনুকূল পাশে এসে ধরিল তাহার হাত
কৌতূহলী দাসদাসী সবলে ঠেলিয়া সবাকারে;
কহিল সে, “এই দ্বারে
এতদিনে মুক্ত হল এইবার
মিলনযাত্রার পথ প্রমিতার।
যে শুনিতে চাও শোনো,
মোরা দোঁহে ফিরিব না এ দ্বারে কখনো।”

শান্তিনিকেতন
৫ ভাদ্র, ১৩৪২