জনৈক মানসিক রোগীর খাতার কয়েকটি পাতা

বাড়িটার এই ঘরে অনিদ্রার গন্ধ খুব তীব্র আর চার
দেওয়ালের না-কামানো দাড়ি যেন বা জঙ্গল
দরজা জানালা মুখ খিঁচিয়ে রয়েছে
টেবিলটা বিড়বিড় করে
সারাক্ষণ, মাঝে-মাঝে শুনি
একটানা ভোরবেলা কিংবা সাঁঝে কাপড় ছিঁড়ছে।
কেউ, দেয় হানা এক পাল
আগুনে নেকড়ে, মাংস ছিঁড়ে খায়, বালিময় ঢেউ
আমাকে আছড়ে চিরে চিরে
দ্যাখে প্লীহা, যকৃৎ যুগল ফুসফুস, বৃক্ক, ঘিলু।

গাছগুলি হেঁটে গিয়ে গলি ছেড়ে চায়ের দোকানে
থামে, কিছু কথা ডানেবামে বলাবলি করে
পরস্পর; চায়ের পিপাসা নেই, উড়ে
যায় দূরে নীলিমায় নক্ষত্রসভায়। এই আমি
গাছের কোটরে বসে বহুদিন আয়ত্ত করেছি
পাখিদের ভাষা, আজকাল
এমন হয়েছে হাল মানুষের ভাষা প্রায় ভুলে
কলা পাতা, গিরগিটি, ধুলো লাল কালো পিঁপড়ে আর
মেঘেদের
সকল শব্দীর্থ শিখে নিয়েছি গোপনে।
এ মর্ত্যের গাছ
কালপুরুষের সঙ্গে নাচ জুড়ে দেয় মধ্যরাতে,
যখন প্রবীণ প্যাঁচা চালায় বুরুশ নিসর্গের ঘন চুলে।

লার্গাকটিলের টিলা থেকে
গড়িয়ে গড়িয়ে দেখি মলিন পাঞ্জাবি পরে চাঁদ
নিজের কবিতা পড়ে মহাশূন্যে, শ্রোতাহীনতায়
হতাশায় নেমে আসে এই ঘরে টেবিলের নিচে।
স্মৃতিভ্রংশের ঘূর্ণাবর্তে পাক খেতে খেতে মনে পড়ে-
পায়নি ব্রাশের স্পর্শ সাত দিন আমার দাঁতের পাটি, মুখ
ধুইনি বস্তুত কিছুদিন, তেলহীন রুক্ষ চুলে
চিরুনির মিহি দাঁত করেনি যে খেলা কতকাল।
কালে ভদ্রে আবছা স্বপ্নে স্খলিত বীর্যের চিহ্নগুলি।
ত্বকে লেগে থাকে আর কোনো খাবার রোচে না মুখে কিছুতেই।

এখন আমাকে দেখে সবাই কেমন
বিপন্ন সন্ত্রস্ত বোধ করে। বন্ধ ঘরে সারাক্ষণ সঙ্গীহীন
বসে থাকা কিংবা পায়চারি করা, দেয়ালের দিকে
দু’চোখ নিবদ্ধ রাখা যেন ওরা বরাদ্দ করেছে

এই না-মানুষ না-জন্তুর জন্যে; শুধু করুণায়
বাঁধেনি শেকলে পাঠায়নি পাগলা গারদে। আমি
পরিত্যক্ত, অস্পৃশ্য এ মনুষ্যসমাজে; ভাই-বোন
পিতার উদ্বেগ আর মায়ের নির্জন অশ্রুধারা ছাড়া কোনো
আশ্রয়ের ধু ধু রেখা নেই। দয়িতার দেখা নেই
কতদিন শুয়োর চিবিয়ে খাচ্ছে নার্সারির উদ্ভিন্ন গোলাপ।

লাওয়ারিশ লাশের মতো পড়ে থাকে আমার খাতা
কখনো টেবিলে, কখনো খাটে-পাতা বিছানায়;
হায়, এর চেহারায় কাদের দাঁত-নখের
কামড় আঁচড় লেগেছে? অথচ আমি ছাড়া এর অন্য কোনো
ধারক বাহক নেই; আমিই কি অজ্ঞাত হিংস্রতায়
তার মুখমণ্ডল ছিঁড়েখুঁড়ে
ফেলতে চেয়েছি বিনিদ্র রক্তজবা-প্রহরে? মাঝে মধ্যে যখন ওকে
মরুতুল্য বুকে জড়িয়ে ধরি তখন সে ডুকরে ওঠে হঠাৎ,
ওর চোখের জলে রাতদুপুর ভিজতে থাকে,
এই ঘর হয়ে যায় থই থই পুকুর।

আমার মাথার ভেতর খাতাটার পাতাগুলি
ঝোলে রক্তপায়ী বাদুড়ের মতো এবং অ্যাম্বুলেন্স, রাত্রির বুকফাটা বিরান
আর্তনাদ, ছিন্ন মস্তক, মর্গের উৎকট গন্ধের মধ্যেই
শেষ পর্যন্ত দুঃস্বপ্নসদৃশ খাতাই আমার সহৃদয় অভিভাবক।