একটি ব্যর্থ সরকার চাই

বঙ্গবন্ধুর জুলিও কুরি শান্তি পুরস্কার পাওয়ার ৪০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুধু শান্তি রক্ষার কথা বলেননি, এক-এগারোর পর যাঁরা শান্তির অন্তরায় সৃষ্টি করেছেন, তাঁদের কঠোর সমালোচনাও করেছেন। তাঁর এই সমালোচনার সঙ্গে আমরা দ্বিমত করছি না। একটি গণতান্ত্রিক সরকারের সঙ্গে জবরদখলকারী সরকারের তুলনা হতে পারে না। তবু প্রধানমন্ত্রী সেই তুলনা টেনে বলেছেন, আমরা বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছি। কিন্তু দুই বছরের শাসনামলে সেনা-সমর্থিত সরকারকে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়নি। সে সময়ে বিরোধী দল ছিল না ইত্যাদি ইত্যাদি।

প্রধানমন্ত্রী চ্যালেঞ্জ বলতে বিরোধী দলের আন্দোলন কিংবা হরতালকে বুঝিয়েছেন। প্রশ্ন হলো, গণতান্ত্রিকব্যবস্থায় বিরোধী দল সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হবে কেন? রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা অনুযায়ী সরকার ও বিরোধী দল মিলেই গণতন্ত্র এবং সেখানে একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করে, প্রতিপক্ষ নয়। যেসব দেশে ক্ষমতাসীনেরাই শুধু গণতন্ত্র রক্ষা এবং লালন করার দায়িত্ব নেয়, সেসব দেশে গণতন্ত্র টেকে না।

একটি গণতান্ত্রিক সরকারের সঙ্গে জবরদখলকারী সরকারের পার্থক্যই হলো, প্রথমটি বিরোধী দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে রাষ্ট্রীয় নীতি ও কৌশল ঠিক করে। আর দ্বিতীয়টি রাষ্ট্র পরিচালনার কোনো ক্ষেত্রে বিরোধী দলকে জায়গা দেয় না, দিতে চায় না। এই সংজ্ঞা অনুযায়ী বাংলাদেশে আদৌ গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে কি না, সেটি বিতর্কের বিষয়। পাঁচ বছর পর পর একটি সংসদ নির্বাচন করে ৩০০ প্রতিনিধিকে সংসদে পাঠানোই গণতন্ত্র নয়।

এই মুহূর্তে বর্তমান আমলের উদাহরণ টানলে ক্ষমতাসীনেরা গোসসা করবেন বলেই আমি খালেদা জিয়ার পূর্ববর্তী দুই আমলের উদাহরণটি আগে উল্লেখ করতে চাই। সে সময়ে রাষ্ট্রীয় নীতি-কৌশল নির্ধারণে সরকার কি বিরোধী দল কিংবা বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনা করেছে? এর জবাব- না। কিন্তু একই প্রশ্ন যদি বর্তমানে ক্ষমতাসীনদের কাছে করি শেখ হাসিনার দুই শাসনামলে রাষ্ট্রীয় নীতি-কৌশল নির্ধারণে বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে কি? এরও উত্তর হবে- না। এই ‘না’-এর গণতন্ত্রই আমরা দুই দশক ধরে চর্চা করে আসছি। বিএনপি-জামায়াত যে পদ্ধতিতে সংসদ ও সরকার চালিয়েছে, আওয়ামী লীগ তার থেকে উন্নত পদ্ধতি গ্রহণ করেছে, এ রকম দৃষ্টান্ত নেই।

প্রধানমন্ত্রী যা-ই বলুন, কোনো গণতান্ত্রিক দেশেই বিরোধী দল চ্যালেঞ্জ হতে পারে না। গণতন্ত্রের প্রকৃত চ্যালেঞ্জ হলো দুর্নীতি, বলপ্রয়োগ, সন্ত্রাস ও আইনের শাসনের অভাব। গণতন্ত্রের চ্যালেঞ্জ হলো দলপ্রীতি, স্বজনপ্রীতি। গণতন্ত্রের চ্যালেঞ্জ হলো বিচারহীনতা। গণতন্ত্রের চ্যালেঞ্জ হলো মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা। শেষের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শেখ হাসিনার সরকার কৃতিত্ব দেখালেও আগেরগুলোতে তাদের সূচক মোটেই সন্তোষজনক নয়। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সূচকগুলো পর্যালোচনা করলেই এর প্রমাণ পাওয়া যাবে। বিএনপির আমলে দলীয়করণ ছিল, এখনো আছে। বিএনপির আমলে দুর্নীতি ছিল, এখনো আছে। বিএনপির আমলে সন্ত্রাস ছিল, এখনো আছে। বিএনপির আমলে দুর্নীতির কারণে বিশ্বব্যাংক জ্বালানি ও যোগাযোগ খাতে ঋণ বন্ধ করে দিয়েছিল। আওয়ামী লীগের আমলে দুর্নীতির অভিযোগে পদ্মা সেতু আটকে আছে। বিএনপির আমলে ফিনিক্স ভবন ধসে গিয়েছিল। আওয়ামী লীগের আমলে রানা প্লাজা ধসে পড়ল। বিএনপির আমলে বিচারবহির্ভূত হত্যা হয়েছে। আওয়ামী লীগের আমলেও হচ্ছে। বিএনপির নেতা-কর্মী-সাংসদেরা ঘুষ-দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও সাংসদেরা এর বাইরে, সে কথা জোর দিয়ে বলা যাবে না। তাহলে মানুষ দুই সরকারের মধ্যে পার্থক্যটি কীভাবে করবে?

তবে প্রধানমন্ত্রী বলতে পারেন বিরোধী দল একের পর এক হরতাল ডেকে সরকারকে ব্যতিব্যস্ত রাখছে। অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে দিচ্ছে। জনজীবনে বিপর্যয় ঘটাচ্ছে। কিন্তু কেন বিরোধী দল হরতাল আহ্বান করছে? গত সাড়ে চার বছরে বিরোধী দল জনজীবনের সমস্যা, নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি কিংবা পদ্মা সেতু না হওয়ার প্রতিবাদে হরতাল ডেকেছে বলে মনে পড়ে না। তারা দুই বছর ধরে হরতাল-লংমার্চ-সমাবেশ-মহাসমাবেশ করছে বাতিল হওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে। তাদের দাবি যৌক্তিক না অযৌক্তিক, তা নিয়ে তর্ক হতে পারে। কিন্তু সেই দাবি করলেই কেউ গণতন্ত্রবিরোধী হবে- এ রকম চিন্তাভাবনা স্বৈরতান্ত্রিক। ক্ষমতাসীনদের মনে রাখতে হবে, ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল না করেও বিএনপি তথা চারদলীয় জোট নির্বাচন করতে পারেনি। বরং নির্বাচনকে নিজেদের মতো করে সাজাতে গিয়ে তারা দেশ ও জাতির পাশাপাশি নিজেদেরও সর্বনাশ করেছে। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে একধরনের অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। তাঁরা সকালে সংলাপের কথা বলেন, বিকেলে সংঘাতের তোপ দাগেন। আজ এক মন্ত্রী এক কথা বলেন, কাল আরেক মন্ত্রী সেটি উল্টে দেন।

প্রধানমন্ত্রী হেফাজতের চ্যালেঞ্জের কথা বলেছেন। এটাকে আমরা আসলেই চ্যালেঞ্জ মনে করি। বিএনপি, জামায়াত ও জাতীয় পার্টি- পঁচাত্তর-পরবর্তী রাজনৈতিক ধারার তিন কুশীলবই হেফাজতকে নিয়ে খেলেছে। তারা নিজ নিজ অবস্থান থেকেই অরাজনৈতিক সংগঠটির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা করেছে। এর মধ্যে কোন দল কত বেশি সক্রিয় ছিল, সরকারের দায়িত্ব তা খতিয়ে দেখা। চক্রান্তকারীদের মুখোশ উন্মোচন করা। কিন্তু এখানেও সরকার দ্বৈতনীতি নিয়েছে। তারা বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে বুলন্দ আওয়াজ তুললেও মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টি সম্পর্কে একটি কথাও বলছে না। একটি তথ্য দেওয়া জরুরি যে, ৫ মের সহিংসতায় বিএনপির কোনো নেতা-কর্মী নিহত না হলেও জাতীয় পার্টির দুই নেতা নিহত হয়েছেন। সেই সূত্র ধরেও সরকার সেদিন যারা সহিংসতা ঘটিয়েছে, তাদের খুঁজে বের করতে পারে। বাইরের শত্রুর চেয়ে ঘরের শত্রু আরও ভয়ংকর।

গত সাড়ে চার বছরে সরকারের ভালো পদক্ষেপগুলোর মধ্যে রয়েছে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারকাজ শেষ করা, জঙ্গি দমন, শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন, নারী উন্নয়ন নীতি গ্রহণ, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন, মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তি এবং যুদ্ধাপরাধের বিচার। এর মধ্যে এক যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচালে জামায়াতের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে বিরোধী দল আঁটসাঁট বেঁধে সরকারের বিরুদ্ধে নেমেছে- এ রকম উদাহরণ নেই। আর যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরোধিতা করে তারাই বেশি ধিক্কার কুড়িয়েছে। সে ক্ষেত্রে বিরোধী দলের কাছ থেকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ আসার কারণ দেখি না। তবে মেয়াদের শেষে এসে সরকারের সামনে শক্ত চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে দুর্নীতি ও দলীয় সন্ত্রাসের লাগাম টেনে ধরতে না পারা।

প্রধানমন্ত্রী ওই দিনের বক্তব্যে দ্বিতীয় যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির ওপর জোর দিয়েছেন সেটি হলো, ‘ব্যর্থদের কথা কেন সরকার শুনবে।’ তিনি বলেছেন, ‘দেশে এক-এগারোর পর যাঁরা সাধারণ নির্বাচনই দিতে পারেননি, আমরা কেন তাঁদের সবক শুনব?’

প্রধানমন্ত্রী এক-এগারোর পরের নয়, সম্ভবত আগের উপদেষ্টাদের কথা বলেছেন। কেননা, এক-এগারোর পরের উপদেষ্টারা তো নির্বাচন করেছেন, যার মাধ্যমে তিনি এখন প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর দল ক্ষমতায়। এর আগে তিনি বলেছিলেন, যাঁরা একটি নির্বাচন করতে পারেননি তাঁরাই নির্বাচনকালীন সরকারের নানা ফর্মুলা দিয়ে পরিস্থিতি জটিল করে তুলছেন। ফর্মুলা একটি প্রস্তাব মাত্র। এটি মুগুর নয় যে ঠুকে দিলেই সরকারের মাথা ভেঙে যাবে। যে কেউ ফর্মুলা দিতে পারেন। সেটি গ্রহণ বা বর্জন করা সরকারের মর্জি। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীকে স্মরণ করিয়ে দেব ১৯৯৪-৯৫ সালে এবং ২০০৬ সালে সংকট নিরসনে দেশি-বিদেশি বহু ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান সমঝোতার বহু প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু খালেদা জিয়া কিংবা তাঁর উপদেষ্টাদের কেউ সেসব মানেননি, যার ফলও আমরা জানি।

প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তাঁরা (উপদেষ্টা) নির্বাচন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু তাঁদের সেই ব্যর্থতার কারণেই কিন্তু ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ দেশবাসীর ওপর বিএনপির সাজানো নির্বাচন চাপিয়ে দিতে পারেননি। তাঁদের এই ব্যর্থতাকে মহৎ ব্যর্থতাই বলা যায়।

প্রধানমন্ত্রী আজ উপদেষ্টাদের ব্যর্থ বলে নিন্দা-মন্দ করছেন। কিন্তু সেদিন তিনি ও তাঁর দল ভিন্ন প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল।

২০০৬ সালের ১১ ডিসেম্বর ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করে চার উপদেষ্টা যথাক্রমে আকবর আলি খান, শফি সামি, সুলতানা কামাল ও হাসান মশহুদ চৌধূরী পদত্যাগ করেন। ওই দিনই আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা মন্তব্য করেছিলেন, ‘তাঁর (প্রধান উপদেষ্টা) কার্যক্রমের জন্য উপদেষ্টারাও তাঁকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। দেশবাসী কীভাবে তাঁকে বিশ্বাস করবেন? আর অবাধ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি না হলে আমরা কোন ভরসায় নির্বাচনে যাব?’

একই দিন দলের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল ১৪ দলের এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘এই চারজন উপদেষ্টা অবাধ নির্বাচনের একটি চেষ্টা করেছিলেন। তাঁরা পারেননি। এ রকম নিরলস চেষ্টার জন্য চার উপদেষ্টাকে ১৪ দলের পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানাই। তাঁরা বিবেকের তাড়নায় পদত্যাগ করেছেন।’ (প্রথম আলো, ১২ ডিসেম্বর, ২০০৬)

উপদেষ্টারা যদি সেদিন ব্যর্থ হয়েই থাকেন তার বিনিময়ে গণতন্ত্র জয়ী হয়েছে। চার উপদেষ্টা চোখে আঙুল দিয়ে দেশবাসীকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের অধীনে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন সম্ভব নয়। সেদিন যদি তাঁরা সে রকম একটি সাজানো নির্বাচন করতে ব্যর্থ হয়ে থাকেন তাহলে প্রধানমন্ত্রীর উচিত তাঁদের অভিনন্দন জানানো। এর অর্থ এই নয় যে পরবর্তীকালে এই উপদেষ্টাদের মধ্য থেকে যদি কেউ না-হক কাজ করে থাকলে পার পেয়ে যাবেন। তাই বলে উপদেষ্টাদের সেই মহৎ ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন করা বা তাঁদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা উন্নত রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিচয় নয়।

সেদিন চার উপদেষ্টার পদত্যাগের শক্তি যে ১৪ দলের সংঘবদ্ধ আন্দোলনের চেয়ে মোটেই কম ছিল না, সে কথা প্রধানমন্ত্রী আজ অস্বীকার করলেও সেদিন কিন্তু স্বীকার করে নিয়েছিলেন।

গত চার দশকে বাংলাদেশে অনেক সফল ও কীর্তিমান সরকার আমরা পেয়েছি। এবার আমরা একটি ব্যর্থ সরকার চাই, যার ব্যর্থতার বিনিময়ে দেশবাসী একটু শান্তি ও স্বস্তি পেতে পারে।

প্রকাশকালঃ মে ২৬, ২০১৩।