আগস্ট ১৯৭১

২ আগস্ট (সোমবার)
সন্ধ্যা ৭টা। আজ দুলুর জন্ম দিন। স্বামী সন্তান সৌভাগ্যবতী হয়ে বেঁচে থাকুক এই আল্লাহর কাছে প্রার্থনা। জানি না কোনো দিন দেখা হবে কি না। আজ মুন্নি এসেছিল, তার কাছে শুনলাম জোহরার বাড়ীতে সে শুনে এসেছে বৃহস্পতিবার ২৯শে বুলু এ দুনিয়া ছেড়ে গেছে। কান্না পেল না। একটা ব্যথার সাথে তৃপ্তি পেলাম। হতভাগিনীর সারা জীবন যন্ত্রণার অবসান হল। আল্লাহ বেহেশত নসীব করুন। স্বামী সৌভাগ্যে সৌভাগ্যবতী কটি নারী আছে। মেয়েরা চির অভিনেত্রী। তারা বুকে আগুন নিয়ে সংসারে শান্তির স্নিগ্ধ ধারা ঢালতেই জীবন শেষ করে। ব্যতিক্রমও আছে বই কি। বুলুর জীবন এতদিনে অন্ততঃ দগ্ধে মরার হাত থেকে নিষ্কৃতি পেল। আজও কারুর কোনো খবর নেই।

৩ আগস্ট (মঙ্গলবার)
কালকে শামীমের রাতের অফিস ছিল, গ্যানিস এ বোমা পড়েছে। উপর তলায়ই তার পি. পি. আই. এর অফিস, আজও অফিসে গেল। আল্লাহ নেগাহবান। সারারাত সারা দিন বৃষ্টির পর সুন্দর জ্যোৎস্না উঠেছে। কারুর কোনো খবর নেই। বৌমা এসেছিলেন। খোকন চাটগাঁ থেকে এল। আহমদ, গিয়াস উদ্দীন, খোকন দেখা করে গেল। আমার বাছারা কত দূর দেশে, একটু খবরও পাই না। ছোটন ত ঠিক চিঠি দেয়ই, কিন্তু আমি পাই না। সারা ঢাকা উত্তেজিত। আজ ইয়াহিয়া খানের আসবার কথা। এল কিনা কে জানে।

৪ আগস্ট (বুধবার)
আজ বৌমার মারফত ২৭শে জুলাইয়ের লেখা শাব্বীরের চিঠি পেলাম আর ওদেরও কিছু খবর পেলাম। এও আল্লাহর কাছে শোকর। বৃষ্টির বিরাম নেই। জ্যোৎস্নাও উঠেছে। দুলুর খবর ক’দিন পাচ্ছি না।

৫ আগস্ট (বৃহস্পতিবার)
রাত ৯টা আল্লাহর কাছে অনেক শোকর। আজ সবার খবরই পেলাম। ওরা ভালো আছে, চিঠি পেয়ে যে কি আরাম বোধ হল। আল্লাহ নেগাহবান থেকে যেন চিরকাল সবাইকে রক্ষা করেন। কতক্ষণ আগে বোম আর গুলীর শব্দ হল। কি জানি কোথায় কি হচ্ছে ও হবে? ঢাকা থমথমে হয়ে আছে, লোকজন চলে যাচ্ছে। শহরের মেঘ বৃষ্টি রোদের খেলাও চলছে। ব্যথা আশা আশঙ্কা উৎকণ্ঠা নিয়ে লোকরে দিন কাটছে। আল্লাহ মানুষকে সুমতি দিন।

৬ আগস্ট (শুক্রবার)
রাত সাড়ে ৮টা। আল্লাহ যখন দেন অনেক কিছুই দেয় কিন্তু আবার কেড়ে নিতেও এতটুকু সময় লাগে না তার। এমনি করুণাময় নিষ্ঠুর সে। আজ দুলুরও ফোন পেলাম। ওরা ভালো আছে, বিব্বুর বিয়ের কথা চলছে। আল্লাহ মোবারক করুন।
এইমাত্র একটা বোম-এর শব্দ হল। গতকাল ২টা থেকে জামাল নিরুদ্দেশ। আল্লাহ যেন সহিসালামতে রাখেন। ছোটবেলা থেকে কারুর মুখঝামটা খাইনি, এখন বুড়ো বয়সে কারাে মুখ ঝামটা বড় লাগে মনে। নিজের উপরই ঘৃণা হয়। এই অবস্থায় মানুষ আত্মহত্যা করে নয়ত পাগল হয়ে যায়।

৮ আগস্ট (রবিবার)
রাত ৮টা। কাল আবদুল বাড়ী গেল। সারা ঢাকায় লোকরে চলে যাওয়ার হিড়িক। শাদু এসেছিল। ধানমণ্ডিতে চোরাগোপ্তা ধরপাকড় চলছে। আর শুনলাম গুলশানেও খুব গোলযোগ। কালকে আজকে খুব বোমারু উড়ল। বৌমাদের বাড়ীর পথে ৮টার পর কেউ বের হতে পারবে না। বের হলে গুলী করা হবে। ২ বছর পরে বেথেলহেম স্টার ফুল ২টি কালকে ফুটল। আল্লাহ দেশের ভালো করুন। আজ স্বপ্নে দেখলাম ধানমণ্ডির পথ হারিয়েছি, নানা পথে জ্যান্ত, জবেহ করা মুরগী পড়ে আছে। একটি বন্দী ছেলেও আমার সাথে এল। পরে কে একজন ধানমণ্ডিতে নিয়ে যাবে বলে সাথে এল।

১০ আগস্ট (মঙ্গলবার)
রাত ৯টা। আজ ১২টায় সোভিয়েত কনসাল জেনারেল ও নবিকভ এসেছিলেন। প্রচুর সহানুভূতির সঙ্গে অনেক আলোচনা করলেন। আল্লাহ বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করেন। আজ মুজিবুর রহমানের গোপন বিচার সভা বসছে, কি প্রহসন। কার বিচার কে করে ।
আজ ভোর রাতে স্বপ্নে দেখলাম আরবান চুপি চুপি এসে আমার হাতের মধ্যে ৪টা সিকি, রূপার সিকি গুজে দিয়ে চলে গেল। কি অদ্ভুত স্বপ্ন। আরবানের সাথে দেখা নেই আজ প্রায় পনের বছর ধরে। কি যে স্বপ্ন দেখি আমি।

১১ আগস্ট (বুধবার)
রাত ৭টা। শাদু, আলু, জাদু এসেছিল। লিখে দিলাম ওদের কাছে। শান্তি হোক পৃথিবীর। শান্তি হোক, সুমতি হোক পৃথিবীর মানুষের। অবুঝ মন বোঝে না অস্থির হয় ক্ষণে ক্ষণে। যার কাছে সব সঁপেছি সেও নিষ্ঠুর লীলায় মেতেছে। তবুও বলছি, ওগো, এবার শেষ কর এ লীলা। ধ্বংস থেকে এবার সৃষ্টির খেলায় মাতো। মানুষের অসহায় খেলার পুতুল মানুষ আর কত ধৈর্য ধরবে। তুমি পার এত সহ্য করতে?

১২ আগস্ট (বৃহস্পতিবার)
রাত ৯টা। আজ ছোটনের চিঠি পেলাম। ওরা ভালো আছে। সবার ভালো হোক। কিন্তু মনটা যে কি অস্থির। আজ দুপুরে একটু ঘুমিয়েছিলাম। স্বপ্নে দেখলাম দুধভাত খাচ্ছি, এ বড় ভয়ানক স্বপ্ন, যত বার দুধ খাওয়া স্বপ্নে দেখেছি, একটা না একটা কঠোর নিষ্ঠুর মৃত্যু শোক লাভ করেছি। কুকুরটাও কাল থেকে কেঁদে উঠছে, এসব লক্ষণ মোটেই ভালো নয়। বড় তিক্ত বিষাক্ত অভিজ্ঞতা। কিন্তু কাকে বলি এসব দুঃখের কথা। কি ভীষণ নিঃসঙ্গ যে আমি! ওগো অনন্ত অন্তর্যামী। তুমি ছাড়া এ নিঃসঙ্গ অন্তরের সঙ্গী আর কে আছে। কাকে রেখেছ! তোমাকেই বলি আর দুঃখ দিয়ো নাকো মরণ দাও, শান্তি দাও। তোমার ইচ্ছা ছাড়াও ত কিছুই হবার নয়। এবার মঙ্গল ইচ্ছায় ইচ্ছুক হও।

১৪ আগস্ট (শনিবার)
রাত ১১টা। ১৪ই আগস্ট। কত রক্ত স্নানের পর স্নিগ্ধ চন্দ্র তারকা পতাকাবাহী এ দিনটি এসেছিল ২৩ বছর আগে পাকিস্তানের সব মানুষের নিপীড়িত সর্বহারা জনের আশা আনন্দের প্রতীক হয়ে। দস্যু দুরাচার বর্বর পশ্চিম পাকিস্তানিদের জঘন্য নিষ্ঠুরতায় আজ তা সারা বিশ্বসভায় ম্লান, উপহসিত। মুসলিম নামরে উপর কলঙ্ক কালিমা লেপন করে দস্যু বর্বর তার হনন কার্য চালিয়ে যাচ্ছে। ধিক। কদিন দিন-রাত কুকুরটা কাঁদছে। আজও স্বপ্ন দেখলাম দুধ খাচ্ছি। এ যে কি অন্তর্দাহ অমঙ্গলের আশঙ্কায় পুড়ে মরা, কেউ বুঝবে না। সকাল থেকে বৃষ্টি সারা ঢাকাও সকাল থেকে মৃত্যু নগরী। বিকাল থেকে আবার লোকজন চলাফেরা করছে।

১৫ আগস্ট (রবিবার)
রাত ৭টা।
শ্রাবণের অবিরাম ধারা বর্ষণ। কার চিত্ত স্নিগ্ধ হল কে জানে। হাট বাজার নেই। আজ রোববার বলে রক্ষা।
২ মাস হয়ে গেল। সন্ধ্যায় মনটা বড় ব্যাকুল হয়। কেউ কেউ আসেন, বৌমা আসে, তাই কথাবার্তায় কেটে যায়। কি নিঃসঙ্গ। কারু কাছে বলার নয় এ অন্তর্বেদনা। ওগো অনঙ্গ অন্তরঙ্গ। তুমি যে অন্তর্যামী। তাই তুমিই যে ব্যথা, সুখ, আনন্দ দাও, তা তোমারই কাছে ফিরে যায় না কি। কত অমঙ্গল চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি। তার মধ্যেও আশা, প্রত্যাশা করে আছি, সব সরিয়ে তোমার মঙ্গল আলোকে উদ্ভাসিত করবেই।

১৭ আগস্ট (মঙ্গলবার)
রাত ৭টা
কালকে খবর পাওয়া গেল রফিককে (রফিকুল ইসলাম) সুদ্ধ ৪জন ইউনিভারসিটির প্রফেসরকে ১৩ তারিখ রাতে ধরে নিয়ে গেছে। স্ত্রীদের আবেদনক্রমে আজ তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়ার কথা। কিন্তু আজ সামরিক অফিস হতে তাদের কাপড় চেয়ে নেওয়া হয়েছে। আল্লাহ জানেন, ওদের ভাগ্যে কি আছে। এখনও দানব বর্বরদের পাশবিকতা অব্যাহত। আল্লাহ রহম করুন।
সন্ধ্যা ৬টায় দুলুর ফোন পেলাম। আল্লাহ নেগাহ্‌বান থাকুন। আজ গেন্দু এসেছিল। নওয়াব ঢাকার ডি.সি. হয়ে এল। সোমবার থেকে অফিস করবে। কি কার ভাগ্যে আছে কে জানে।

১৯ আগস্ট (বৃহস্পতিবার)
ভাদ্রের আজ ২ তারিখ। অনেক বৃষ্টির পর যেন আজ রোদের আভাস এল, শরতের স্নিগ্ধতা নিয়ে। বিকালটা মনে হল শরতের বিকাল। শান্তি কোথাও নেই। ধরপাকড় রোজ চলছে। স্বামীবাগ, আজিমপুর, ধানমণ্ডি সবখানে রাতের আঁধারে দিনের আলোয় হানাদাররা হানা দিচ্ছে। দেশের মানুষ মরিয়া হয়েই এবার মরছে।

২০ আগস্ট (শুক্রবার)
রাত ৯টা
কতকাল পরে আজ সালু, রুমী, আলু, শাদু, রবি, শাহরিয়ার এল। ওদের যে দেখলাম, ওরা যে বেঁচে আছে, এও শোকর। একটু আগে মেশিন গানের গুলী চলার শব্দ হল ২৭ নং রোডের এদিক থেকে। কার কোল খালি হল আল্লাহ জানেন। ছোটনের, শমুর কোনো খবর নেই। আজ বৃষ্টিটা ধরেছে, কাল নাকি সূর্যগ্রহণ, আমরা দেখব না।

২১ আগস্ট (শনিবার)
রাত ৯টা
বার বার দুঃস্বপ্ন দেখছি। এত অমঙ্গলের চিহ্ন, আশঙ্কা; মন আর কত যে শক্ত করি। সর্ব মঙ্গলময় সর্ব নিয়ন্তা আল্লাহ রহমানুর রহিম। তিনি রহম করলে সব অমঙ্গল মঙ্গল হয়ে উঠবে, সেই আশা করে নিশ্চিন্ত হবার প্রাণপণ চেষ্টা করছি। শুধু আমার ভালো হলেই তো হবে না। আমার সন্তান, আমার দেশ, দেশের মাটি, মাটির মানুষেরা সামরিক নির্যাতন, বন্যা মহামারীতে আর কত মরবে। আল্লাহ ভালো কর। রহম কর। মুজিবের হায়াত দাও, বাংলাদেশের ভালো কর। আমারও ভালো হোক। আজ স্বাধীন বাংলা বেতারে বদরুন (বদরুন্নেসা আহমদ) বলল। সবাই চলে গেল, আমিই রইলাম।

২২ আগস্ট (রবিবার)

সোভিয়েত কনসাল জেনারেল লাঞ্চ খাওয়ালেন। সময় কাটল। নওয়াব এল। খসরুর কথা শুনলাম। জানি না ওর জগ্যে কি হয়েছে। মাঝে মাঝে গুলী মেশিনগান-এর শব্দ পাচ্ছি। গুলশানের ব্যাপারে যা শুনলাম অভাবনীয়। কি যে হবে? আমার জন্য ভাবি, ও হতচ্ছাড়ার ভাগ্যে যে কি আছে আল্লাহ জানেন। আজকে ইন্ডিয়ার বেতার কেন্দ্রে আমার কবিতা পড়া হল।

২৩ আগস্ট (সোমবার)
আল্লাহর কাছে শোকর। ছোটনের চিঠি পেলাম। লালাদের চিঠি পেলাম। আলুর মুখ দেখলাম। সব ভালো রাখুন আল্লাহ তার নেগাহবানীতে। আজ জাফর সাহেব উধাও। কাণ্ড যা করে তুলেছিলেন, এ ভালোই হল। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য করেন। রোজ রাতে গোলাগুলী চলছে, আশপাশে ধরপাকড়ও হচ্ছে, আল্লাহ রহম করুন।
সিকান্‌দার আবু জাফর ওপারে চলে যাওয়ার দিন।

২৪ আগস্ট (মঙ্গলবার)
রাত ৯টা
আজ জাকুদের কলেজে গ্রেনেড চার্জ হল। জাকু আসেনি, আলভীও এল না। বড় দুশ্চিন্তায় কাটছে সময়। গ্রীন রোড কলাবাগান সব জায়গায় গণ্ডগোল।

২৫ আগস্ট (বুধবার)
আজ জাকুও এল। তবুও সান্ত্বনা কোথায় যে কি হচ্ছে। ১৮ নং রোডে বন্যাদের বাড়ীর পাশে চার শহীদ হো গিয়া। অত্যাচারীর শক্তি যত প্রবল হোক। আল্লাহর শক্তি তার চেয়ে যে কত প্রবল। কত শক্তি তিনি অত্যাচারিতকেও দিতে পারেন বাংলাদেশ তার প্রমাণ। আজ পাঁচ মাস গত হতে চলছে! কি দুঃসহ দিন।
মাইনুর সাথে দুলুদের কাপড় আজ ত পাঠালাম। কবে আবার ওদের খবর পাব সেই আশায় আছি।

২৬ আগস্ট (বৃহস্পতিবার)
আলভী এতদিনে এল। অনেক কথাই শুনলাম। দুই দিন দুই রাত পর শামীম আজ বাড়ী এল। আল্লাহ যেখানে যাকে রাখেন যেন তার নেগাহবানীতে রাখেন। সবার ভালো হোক।

৩০ আগস্ট (সোমবার)
সন্ধ্যা ৭টা
বর্ণাঢ্য পৃথিবী বিবর্ণ হয়ে যায়, ক্ষুধার খাদ্য তৃষ্ণার পানীয় বিস্বাদ হয়ে ওঠে, বিষাক্ত মনে হয় নিঃশ্বাসের বায়ু। ওগো অকরুণ। আর কত! তুমি ও ত সহ্যের সীমা অতিক্রম কর, কর গজব নাজেল। মায়ের বুক কি তোমার ধৈর্যের চেয়েও সহনশীল। আল্লাহ গো আল্লাহ। বাঁচাও মায়ের বাছাদের। রক্ষা কর মেয়েদের ইজ্জত, তোমার দেওয়া শ্রেষ্ঠ সম্পদ। এ কি অকরুণ লেখা। আর পারি না। আশেপাশে কারুর ঘরেই যে আলো নেই, আর কত। আলভী, আলতাফ মাহমুদরা জালিম পাক সৈন্যের হাতে ধরা পড়েছে।

৩১ আগস্ট (মঙ্গলবার)
রাত ১০টা
দিনরাত কেটে আজও রাত এল। কে কি ভাবে কাটাল এতক্ষণ। ওগো আল্লাহ, এবার প্রসন্ন হও, তোমার নামের মর্যাদা রাখ। আমার মতো ঘরে ঘরে তোমাকে ডাকছে- তুমি কি শুনতে পাওনা?