সেপ্টেম্বর ১৯৭১

১ সেপ্টেম্বর (বুধবার)
রাত ৯টা। শুনেছ শুনেছ, প্রিয় আমার। বন্ধু আমার। অনঙ্গ অন্তরঙ্গ প্রার্থনা আবদার তুমি শুনেছ, অভিমানের মান রক্ষা করেছ, কত যে মহান মহৎ দয়ালু তুমি। ওরা ফিরে এল। মেয়েটার খবর এনে দাও। আমার সমস্ত ব্যথিত জীবনের সাথী তুমি, তুমি ছাড়া কে বুঝবে আমার কথা, কে শুনবে তুমিইত শুনছ শুনেছ, আরও শুনবে। শোকর, শোকর লাখ লাখ শোকর। তোমার নামের মর্যাদা তুমি রেখেছ, রাখবে। তবু যে মনে বড় ব্যথা। কালকে ছিল আজাব। বাচ্চা বিড়ালটা কুকুরের হাতেই মরল। তুমি কি সদকা নিলে? আহা মেরে মেরে কি যে অবস্থা করেছে বাচ্চার! তবুও হায়াত জোরে ফিরে যে এল সেইত শােকর। আলভী ফিরে এল।

২ সেপ্টেম্বর (বৃহস্পতিবার)
রাত ৯টা। এইমাত্র দুলুর ফোন এল। আল্লাহ ওদের সহিসালামতে রাখুন। কালকে যেন জাকুর খবরটা পাই, আশা করে আছি, আলতুও ফিরে আসবে। আজ বৃষ্টি নেই, ঝকঝকে রােদ। কাটুক বাংলার কালো দিন, রাতের আঁধায়। আশা হচ্ছে ভরসা হচ্ছে,আল্লাহই মুখ তুলে চাইবেন।
মালিক সাহেব গভর্নর। টিককা খান অপসারিত।

৩ সেপ্টেম্বর (শুক্রবার)
রাত ৯টা। একটু আগে খবর পেলাম, খবর ভালাে নয়। বুকটা বসে যেতে চায়। অনেক ভালো না থেকে আল্লাহ বহু ভালো দিতে পারেন, এই আশা করে আছি। ২ দিন থেকে কারুর কোনো খবর নেই, সবগুলোর হল কি। আল্লাহ ত অনেক দিলেন, আবারও আশা করে আছি অনেক পাব। তার ভাণ্ডারে ত কোন অভাব নেই। চারদিকে ধরপাকড়- কোন মায়ের বাছারা কোথায় ধরা পড়ছে কে জানে। আজ নবিকভ, নায়েলা এল। ছবি নিল। কত যে সামলাতে হচ্ছে। আলতাফ মাহমুদকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাবার দিন।

৪ সেপ্টেম্বর (শনিবার)
রাত ১১টা। আজ মনে অনেক প্রশান্তি। কিন্তু যারা রইল এমন জালেমের হাতে, তাদের জন্য নিয়ত এখন প্রার্থনারত। আল্লাহ, তুমি আছ। অতীব সত্য, মুক্তি আসবে একদিন তোমার রহমতে। আপনজনেরা এত অত্যাচার সহ্য করছে, দেশের সোনার ছেলেমেয়েরা আজ কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, ওদের মুক্তিযুদ্ধে সাহস বুদ্ধি দাও। বৌমা আজ প্রথম আমার বাড়ীতে রাত কাটালাে। আহা! কেউ নেই ওর আল্লাহ তুমি ছাড়া। এই দুর্জয় সাহসী মেয়েটার ইজ্জত, শুভ কামনাকে তুমি জয়যুক্ত কর।

৫ সেপ্টেম্বর (রবিবার)
রাত ৮টা। নবিকভ, নায়েলা আজ খেয়ে গেল। বিদেশের মানুষ বড় আপন হয়ে মিশেছিল, ওরা চলে যাবে সেই তুষারের দেশ রাশিয়ায়। কটি বছর কত আপন হয়ে মিশল। কিই বা উপহার দিলাম, তাতে কত খুশী! আবার শামীমাকে যে রেকর্ডগুলাে দিয়ে গেল তাও অনেক।
মানিক হতভাগার বউ জামাই কাল এসে আজ চলে গেল, কি বােকা একা। এখন কেউ ঢাকা আসে। এতগুলাে পয়সা খরচ করে একটা দিন মাত্র থেকে গেল। আজ বৌমা আসবে না। সকালে মেয়েটা গেল। এখন বৃষ্টি। বাড়ীর পাশে ব্যারিকেড, মেয়েটা একা বাড়ীতে, আল্লাহ ওকে দেখবে।

৬ সেপ্টেম্বর (সোমবার)
রাত ৯টা। কাল সন্ধ্যা থেকে প্রবল বৃষ্টি। উতল বাতাস আজ সারা দিন চলল। দুপুরে বৌমা এলাে। আজ প্রতিরক্ষা দিবস। প্রহসন চলছে। ধরপাকড় চলছে। নতুন খবর নেই। মিথ্যা প্রচারে ঢাকায় শহর গুলজার। কেউ বিশ্বাস করছে না। মিরজাফরী দল মিথ্যার মধ্যেও আলাে জ্বালিয়ে চলছে, এই আলােতে ত ওদেরই বিভ্রান্তির সৃষ্টি হচ্ছে। মূঢ়, মুর্খ স্বখাত সলিলে ডুববে একদিন।

৭ সেপ্টেম্বর (মঙ্গলবার)
রাত ৯টা। রাশিয়ান নতুন ভাইস কনসাল জেনারেল ও ইসলামাবাদ থেকে আগত মিনিস্টার কাউন্সিলার মি. নিকোলাই, আই, ভয়নভ আজ ১টায় এসে ঠিক ৩টা পর্যন্ত অনেক আলাপ আলোচনা করে গেলেন। মি. নবিকভও সাথে ছিলেন। নুরুল ইসলাম ও শামীম আমার কথা ওদের ভালােমতাে বুঝিয়ে বলায় অনেক পরিষ্কার কথাবার্তা হল। ১৫ তারিখে নবিকভ চলে যাচ্ছে। খুবই খারাপ লাগছে বড় অমায়িক লোক। নায়েলা ও নবিকভ বড় আন্তিরকতার সাথে মেলামেশা করত। আল্লাহ সবার ভালো করুন। বৌমা আজ আসে নি। মিনিষ্টার একটি সুন্দর বাক্স উপহার দিয়ে গেলেন।

৮ সেপ্টেম্বর (বুধবার)
রাত ১০টা। আজ বৌমা এসেছিলো, এতদিনে একটা শান্তির খবর পেলাম। আল্লাহর কাছে হাজার শােকর। এইমাত্র দুলুর ফোন পেলাম। মােরাদ পরীক্ষা ভালাে দিয়েছে। সিমিন ভালো আছে, আব্বু করাচী যাবেন। বাচ্চুর মেয়ে বিব্বুর বিয়ের কথাবার্তা চলছে। ভালাে। আল্লাহ সবার ঠিকানা যেন ভালো মতাে করে দেন। আজ সারা দিন ঝকঝকে রােদ ছিল। ভাদ্র মাসের দিন। শিশির ঝরানাে রাত। শরৎকাল। রজবের চাঁদ, রমজান আগত। কারা কোথায়, আল্লাহ সবার নেগাহবান থাকুন।

১০ সেপ্টেম্বর (শুক্রবার)
রাত ৯টা। ৪টার সময় ঝিনুর মা এল। কি দুর্ভাগ্য। ছেলে চারটি ফিরে এলো, জামাইটা না আসায় মেয়ের মুখের দিকে কি করে চাইতে পারে। রুমিকেও ছাড়েনি। আল্লাহ রহম কর। আর কত দুঃখ দেবে মানুষকে। কাহারকে আইয়ুব পিণ্ডি ডেকেছে, না যেন যাওয়া হয়, এটাই প্রার্থনা। শয়তান, ছল, খলদের মনে কি আছে কেউ জানে না, আল্লাহ ত জানেন, তিনি যেন এদের হাত থেকে আমার বাছাদের রক্ষা করেন।

১২ সেপ্টেম্বর (রবিবার)
রাত ১০টা। কত দিন হয়ে গেল, ওদের খবর পাচ্ছি না। আল্লাহ আর কত দুঃখ দেবে? আজ পাশের বাড়ী বিয়ে খেয়ে খবর শুনলাম। আলতুর দশা কি হয়েছে আল্লাহ জানেন। সত্য মিথ্যা ঠিক নেই, আল্লাহ সব করতে পারেন। চারদিকের অবস্থা জঘন্য, ঘৃণ্য ফাতেমা সাদেক যাচ্ছে দালালি করতে। লজ্জা করে না এদের। সারা দেশের মানুষ মরে যাচ্ছে জালেমের জুলুম, এরা তামাশা করছে।

১৩ সেপ্টেম্বর (সোমবার)
রাত ১০টা। রাশান কনসাল জেনারেল মি. পপোভ এর গুলশানের বাড়ীতে নবিকভের বিদায় সংবর্ধনা ছিল। সে কাল চলে যাবে। আপন আত্মীয় বিদায় বেদনা অনুভব হচ্ছে। এই সর্বনাশা জুলমাতি দিনে, সাহায্য আশ্রয় সমবেদনা সহানুভূতি দিয়ে সর্বক্ষণ ওরা স্বামী স্ত্রী খবরাখবর রেখেছে, প্রায়ই নানা উপহারে আমাকে খুশী রাখতে চেয়েছে। স্বদেশের কোনাে উচ্চ পদস্থ অফিসার, আমাকে এত সম্মান মর্যাদা দেয়নি। আল্লাহ ওদের ভলাে করুন। আপন দেশে স্বজনদের মধ্যে শান্তিতে থাকুক। আতাউর রহমান খান সাহেবের সাথে দেখা হল। ৩ মাস পর ছাড়া পেয়ে ভালোই আছেন।

১৪ সেপ্টেম্বর (মঙ্গলবার)
৩ মাস পূর্ণ হয়ে ৪ মাসে পড়ল। আমার সোনা লক্ষীমণিরা কেমন আছে, জানি না। আল্লাহর হাতে সঁপেছি, ইজ্জতের সাথে তিনি জীবন রক্ষা করুন। মনে হয় বছর হয়ে গেল। আমার দেশের সােনার ছেলেমেয়েরা ভেসে বেড়াচ্ছে। আল্লাহ আর কত দুঃখ দেবে, এবারে মায়ের কোলে সন্তান যারা আছে বাঁচাও, ফিরিয়ে দাও, শূন্য ঘর ভরে দাও আবার শান্তিতে। চোখের উপর উনি শুকিয়ে শুকিয়ে কাবু হয়ে যাচ্ছেন, কিছু করতে পারি না, যতটুকু পারি যত্ন করতে ত্রুটি করি না, কিন্তু চিন্তা রোগের কি ওষুধ আমি দিতে পারি!

১৫ সেপ্টেম্বর (বুধবার)
আজ ১৫ তারিখ। আমার সােনামণিরা আজ এতক্ষণেও আমার কাছে। কোথায় কখন গেল যেন মনে করতে পারছি না। ৩ মাস আজ পূর্ণ হয়ে গেল। লিখতে গিয়েও মাথা ঠিক থাকে না। গতকালও এই কথা লিখেছি, আজই কালকের লেখাটা ঠিক খাটে। ওলট পালট হয়ে যায়। মনকে কত বুঝাই, তবু কেন যে দিশাহারা হই। আল্লাহ নেগাহবান থাকুন। সবার ভালাে হোক। কোথাও থেকে কোনো একটা খবর নেই।

১৮ সেপ্টেম্বর (শনিবার)
রাত ১০টা। মিনু সাজুর প্রথম বিবাহ বার্ষিকীর দাওয়াত খেয়ে এলাম। কোনাে ঘরে শান্তি নেই। মিনুর শাশুড়ির কান্না, ছেলে একটি কোথায় গেছে তার কোনাে খবর নেই। অথচ বেঁচে থেকে সংসারের সব কিছু করতে হচ্ছে- আনন্দ উৎসব আবার দুঃখ ধান্দা। আল্লাহ কবে সবার ঘরে শান্তি এনে দেবেন, সেই প্রতীক্ষায় আছি। ছােটন, রোজীর চিঠি নেই, সােনামণিদের কোন খবর নেই। আল্লাহ নেগাহবান থাকুন। নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হল। কি ছিরি কি ছাঁদ। ঘৃণা জন্মে যাচ্ছে, কি দেশে আছি।

১৯ সেপ্টেম্বর (রবিবার)
স্বপ্নে দেখলাম তারবাগের পুকুরে কাপড় ধুচ্ছি, ইকবাল এস টিপি টিপি হেসে ঘাটের উপর দাঁড়াল, খুব বকা দিলাম। কিন্তু কথা বল্ল না। পরিষ্কার পাঞ্জাবী পায়জামা পরা। আল্লাহ জানেন- ছেলেটি বেঁচে আছে কি না। কারুরইত কোনাে খবর নেই।

২০ সেপ্টেম্বর (সোমবার)
রাত ৯টা। ছোটনের চিঠি পেলাম- ওরা আল্লাহর ফজলে সবাই ভালো আছে, এইটুকু জেনে শােকর করি। আজ হাসপাতালে গিয়ে রক্ত পরীক্ষার জন্য দিয়ে এলাম। ওষুধ খাচ্ছি। এত ভালােবাসে সবাই আমাকে, এ যে কি সৌভাগ্য। ডাক্তার, নার্স বেয়ারা পর্যন্ত কি আদরে কথা বলল। নার্সরা চা না খাইয়ে ছাড়ল না। আমার দেশের বাংলাদেশের মেয়েরা কত খাটছে, কত কম পয়সা পায়, তবুও কত যে উদার।
হাসপাতালে গন্ধে টেকা যায় না। ডাক্তার নার্স বেয়ারা একদম কম। আজ দুপুরেও ইউনিভারসিটির অধ্যাপক রশীদুল হাসানকে ধরে নিয়ে গেছে। বােমারু উড়ছে, গ্যাস বন্ধ।

২২ সেপ্টেম্বর (বুধবার)
রাত ৮টা। গতকাল গ্যাস এসেছে। আজ শাগিয়েভ এসেছিল- অনেক কথা, আলােচনা হল। ফোন আজ ৩ দিন থেকে মরা। দুলুরা ফোন করেও সাড়া পাবে না। কি যে পরিস্থিতি। কবে এর নিরসন হবে। কারুর কোনাে খবর নেওয়া দেওয়া অসম্ভব।

২৪ সেপ্টেম্বর (শুক্রবার)
আজ চাটগাঁ থেকে কাহ্হার এল দুপুর ২টায় আমার সাথে দেখা করে খেয়ে ঠিক ৩টায় এয়ারপাের্ট গেল, করাচী যাচ্ছে ২ সপ্তাহের জন্য। কি জানি ছলনা না কি। আল্লাহর হাতে সঁপলাম তিনি যেন সহিসালামতে ফিরিয়ে আনেন। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা থেকে আটটা পর্যন্ত নিষ্প্রদীপ মহড়া হয়ে গেল। কলকাতায় যুদ্ধের সময় ব্ল্যাক আউটে ময়দানে যেতাম, কলকাতার অন্ধকার আকাশ কেমন তাই দেখতে। এখানে ত কাফেরদের ভয়ে দুয়ার বন্ধ করে থাকতে হল। কারুর কোনো খবর আজও নেই। আল্লাহ নেগাহবান থাকুন।

২৫ সেপ্টেম্বর (শনিবার)
আজ কুফরি জুলমাতের ৬ মাস পুরাে হল। মুক্তি সংগ্রামী সন্তানদের সংগ্রাম অব্যাহত। আল্লাহ অসহায়ের রক্তেস্নাত বাংলার জনগণকে পূত পবিত্র শপথে উদ্বুদ্ধ করে যেন শান্তিময় জীবনের সন্ধান দেন। ঘর খালি, বুকখালি, কোল খালি, আবার পূর্ণ হোক।
আজ রোজী আহাদ হাঁপানীর ওষুধ দিয়ে গেল। কি ভাগ্য, একটা যােগ্য মেয়ের জীবনে সুখ হয়ত হল, শান্তি পেল না।