ভূমিকা নয়, রক্তে লেখা শোক

একাত্তরের ডায়েরীর সব ক’টা পাতা ভরে তুলতে পারি নি, অনেক কথাই রয়ে গেছে অব্যক্ত। ডায়েরীটা পেয়েছিলাম ১৯৭০-এর ডিসেম্বরে। ভেবেছিলাম ৭১ এই শুরু করবো।

এর মধ্যে ঘটে গেল ৭০-এর ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস। যেতে হলো দক্ষিণ বঙ্গে রিলিফের কাজে। ডায়েরীটা হাতে নিয়ে গেলাম। নিঃস্ব মানুষের শোকে দুঃখে শরিক হয়ে ঢাকায় ফিরে কিছুদিন পরই মানুষের সংগ্রামের মিছিলে অংশ নিলাম। ২৫ মার্চ শুরু হলো পাক সামরিক বাহিনীর মরণযজ্ঞ। অনেক কিছুই দেখলাম শুনলাম বাসায় বসে বসে। সব কথা লেখা সম্ভব হয়ে উঠে নি। কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা লেখা হয় নি যা বলা প্রয়োজন। তাই এ মুখবন্ধ।

মুক্তিযুদ্ধে এদেশের কোটি কোটি কিশোর যুবা, তরুণ-তরুণী যোগ দিয়েছিল। শহীদ হয়েছে ত্রিশ লক্ষ মুক্তিযোদ্ধা এবং সম্ভ্রম হারিয়েছে তিন লক্ষ নারী। তাদের উদ্দেশ্যেই আমার ডায়েরীটি উৎসর্গ করলাম। ওদের অনেকেই আমার চেনা জানা ছিল। ওদের জন্য আমি বড়ই উদ্বেগ নিয়ে কাটিয়েছি মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টা। ওরা ফেরে নি।

মুক্তিযুদ্ধের নয়টি মাস আমি বারান্দায় বসে দেখেছি পাকিস্তানী মিলিটারীর পদচারণা। আমার পাশের বাসায় ছিল পাকিস্তানী মিলিটারীর ঘাঁটি। ওখানে দূরবীন চোখে পাকবাহিনীর লোক বসে থাকতো। রাস্তার মোড়ে, উল্টো দিকের বাসায় সবখানে ওদের পাহারা ছিল। নিয়াজী শেষ সময়ে আত্মরক্ষা করতে ঐ বাসায় লুকিয়েছিল।

কাঁথা সেলাই করেছি নয় মাসে নয়টি। প্রত্যেকটি ফেঁড় আমার রক্তাক্ত বুকের রক্তে গড়া। বড় কষ্ট ছিল। কষ্ট এখনো আছে। স্বাধীন বাংলা গড়ার জন্য যারা ছিল অমূল্য সম্পদ- সেই মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, শহীদুল্লা কায়সার, আলতাফ মাহমুদ, ডা. আলিম চৌধুরী ও ডা. মোর্তুজা এরকম আরো সোনার ছেলেরা মেয়েরা রাজাকার আলবদরের হাতে শহীদ হয়েছে। এদের কথা আমি কি করে ভুলি!

মুনীরের কথা ভুলতে পারি না। প্রত্যেক সভা শেষে মুনীর আমার কাছে এসে দাড়ায়: ‘চলুন আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি, কণ্ঠ আর শুনি না।’ ডিসেম্বরের ১০/১২ তারিখ মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী ফোন করেছিলেন, আমি বাড়ি থেকে সরে কোথাও যাব কিনা তা জানতে চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘শুনেছি অনেককে মেরে ফেলার লিস্ট হয়েছে, তার মধ্যে আপনার আমারও নাম আছে, কি করবেন? কোথাও সরে যাবেন?- বলতে বলতেই ফোনের লাইন কেটে দেয়া হলো। আর কথা হয় নি। জালেমের দল তাকে মেরে ফেলেছে। আমি কোথাও যাই নি। কিন্তু প্রায়ই উর্দুতে হুমকি পেয়েছি ওরা আসবে বাসায়। আমিও বলেছি মোকাবেলা করবো, আস।

আমার বাসার পেছনে সোভিয়েত সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কার্যালয় ছিল। একাত্তরের দুঃসময়ে ওরা অনেক সহযোগিতা করেছে।

আমার বাসায় ৭ নভেম্বরে সোভিয়েত কন্সাল মি, নভিকত এসেছিলেন। শহীদুল্লা কায়সার এসেছিল। চায়ের টেবিলে বসে কথা হচ্ছিল। শহীদুল্লাকে ওরা বললো ঢাকায় থাকা নিরাপদ নয়, সীমান্ত পেরিয়ে যাও।

শহীদুল্লা হেসে উড়িয়ে দিল বললো, খালাম্মা কোথাও যাচ্ছেন? আমি বললাম, না আমাকে কিছু করবে না। তুমি যাও। বললো, তা হয় না। খালাম্মা থেকে গেলেন, আমিও যাব না। ৭ ডিসেম্বরের পরেও খবর দেয়া হয়েছিল সোভিয়েত বন্ধুদের কাছে গিয়ে থাকতে, গেল না। ১৪ ডিসেম্বর রাজাকার আলবদরের দল ওকে মেরে ফেলল।

ভুলবো কি করে গিয়াসউদ্দিনের কথা?

মাথায় গামছা বেঁধে লুঙ্গি পরে গিয়াস প্রায়ই রাতে চুপিসারে পিছন পথ দিয়ে দেয়াল টপকে আসততা রিক্সাওয়ালা সেজে। চাল নিয়ে যেত বস্তায় করে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। প্রতিবেশী অনেকেই ঢাকা ছেড়ে যাবার আগে আমার কাছে রেশন কার্ড রেখে গিয়েছিলেন। সেই কার্ডে আমি চাল চিনি উঠিয়ে রাখতাম। সেগুলো গিয়াস নিয়ে যেত। গিয়াসের উপর পাকসেনা রাজাকারদের চোখ ছিল অতন্দ্র। ১৪ ডিসেম্বর ওকেও রাজাকাররা হত্যা করেছে।

একাত্তরের মাঝামাঝি সময়ে যখন মেয়েদের ওপর পাকসেনাদের নজর পড়লো, ঘটনা ঘটতে থাকলো মেয়েদের বাড়ি থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া, তখন বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, বেবী মওদুদ, আইনজীবী মেহেরুন্নেসা খাতুন, নাহাস আরো অনেকে মিলে এর প্রতিকারের জন্য চেষ্টা করেছিল, এরা সবাই মিলে মেয়েদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতো। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কাপড়, খাবার এসবের যোগান দিত। ওদের সভায় আমাকেও নিয়ে গিয়েছিল। ওদের আমাদের কারে তেমন কিছু করার ক্ষমতাই ছিল না মেয়েদের ওপর অত্যাচার বন্ধ করার। আমার ডায়েরীতে সংক্ষেপে তখনকার অবস্থা কিছু কিছু লিখে রেখেছিলাম। স্নেহাস্পদ কন্যাসম মালেকা বেগম একাত্তরের ডায়েরী প্রকাশে আগ্রহী হওয়ায় ওর হাতে ডায়েরী তুলে দিয়েছি। কালের স্বাক্ষর হিসেবে আমার ডায়েরীটি সামান্যতম অবদান রাখতে পারলে ধন্য হব।

সুফিয়া কামাল
১৮.২.৮৯