প্রকাণ্ড বিড়াল এক- কালো ডোরা গায়ে তার- বাদামি শরীর
তারই ভয়ে শান্তি আর নাই বনানীর
শান্তি নাই- স্বপ্ন নাই- অপরূপ ছবি তবু আছে
চ’লে এসো জ্যোৎস্নায় ঘন দীর্ঘ সুন্দরীর অরণ্যের কাছে
ময়নার মতো নীল পাখা মেলে চ’লে এসো তুমি
যেখানে অর্জুনশাখা জ্যোৎস্নায় ওঠে রুমঝুমি
হিমে-ভেজা নাগেশ্বর পুন্নাগের ছাতার উপরে
যেখানে মুক্তার নদী সারা-রাত ঝরে
সেখানে মানুষ নও তুমি আর- রাতজাগা ময়নার প্রাণ
সেখানে মানুষ নও তুমি আর- রাতজাগা ময়নার প্রাণ
বনের কিনারে নদী- খানিকটা পাহাড়ের অন্ধকারে ঢাকা
খানিকটা মণিমালা-কন্যার হাসি দিয়ে মাখা
কবেকার মণিমালা- আমাদের এ-ধূসর পৃথিবীর পথে
কবে সে যে ম’রে গেছে- অরণ্যে পর্বতে
শুয়ে থাকে আজ শুধু- চেয়ে দেখে খেলা করে চিতা
চিত্রিত দেহের এক রুক্ষ অসম্বৃতা
রূপসিরে ল’য়ে,- উল্কা খসে- অরণ্যের অগণন মশা
গান গায়,- বাঘ আর বাঘিনীর প্রাণের লালসা
বালির বিছানা পাতে নদীটির পারে
বনমোরগীর নীল গানের ঝঙ্কারে
রুপালি শেয়াল তার দম্পতির নীড়
ছেড়ে যায়- পান করে জ্যোৎস্না আর সবুজ শিশির
নাগেশ্বরগাছ আর তিত্তিরাজগাছের শরীর
ছায়া ফেলে তার মুখে- বুকে তার বনমোরগীর
সোনালি গানের স্বপ্ন- রজত রোমের দেহে তার
খেলিছে অর্জুন আর জারুল শাখার
আঁকাবাঁকা আঙুলের দ্রুত অন্ধকার
মৃগীর মুখের রূপে দু’ চোখ তাহার
বুজে আসে এক বার- মাকাললতার বনে লাল-লাল ফল
পেঁচার পাখার ঘ্রাণ- জ্যোৎস্না আর শিশিরের জল
ভালো লাগে এক বার- এক বার অপরূপ বাদামের নিচে
শিশির ঝরিছে আর বাদাম ঝরিছে-
চেয়ে দেখে থেমে থাকে- ডিমের মতন এই ফল
ডিমের শাঁসের মতো ফল এই- এই জ্যোৎস্না শিশিরের জল
ভালো লাগে,- মনের আমোদে তার রুপালি লেজের মোটা ঝাড়ু
সাপের মতো খেলে কুয়াশায়,- খচমচ ক’রে এক নরম সজারু
চ’লে যায়- ছুটে যায় কাঠবিড়ালির মতো শুষ্ক পাতাগুলি
দাঁতের রুপায় সাদা বাদামের শস্য খুলি-খুলি
খায় সে চাঁদের তলে গহন কাননে
বনমোরগীর কথা নাই আর মনে
২
শীতের রাতের চাঁদ মাথার উপরে
ঘরে সে যাবে না আর- যাবে না ক’ ঘরে
সমস্ত আকাশ তার খেলিবার মাঠ
অরণ্যের শাল আর অর্জুনের কাঠ
যেখানে সবুজ ঘ্রাণ-হরিৎ মদের গন্ধ ছড়াতেছে আকাশের মুখে
পেটের মতন গোল রুপার গেলাস লয়ে সে-আকাশ বাতাসের বুকে
অরণ্যের এই চাঁদ সারা-রাত জেগে র’বে- র’বে
আমাদের রাত যে কী তাড়াতাড়ি শেষ হয় মানুষের ব্যস্ত কলরবে
তাড়াতাড়ি জ্যোৎস্না নেভে- ব্যথা পেয়ে চাঁদ যায় চ’লে
মানুষের মূঢ়তার ব্যর্থতায় পৃথিবীর রাত যায় গ’লে
কিন্তু এই অরণ্যের চাঁদ, এই জ্যোৎস্না- এই রাত
রুপালি সুতার ফাঁসে বেঁধে রাখে সময়ের হাত
চেয়ে দেখ চাঁদ ঐ- হাতে তার টলমল হিরা
রুপোর চামচ কত- শাল আর পুন্নাগের সবুজ মদিরা
ঢেলে লয়; গল্প বলে- ছবি দেখে- স্বপনের তাঁত
বুনে চ’লে; রুপালি সুতার ফাঁসে বেঁধে রাখে সময়ের হাত
৩
নাহরের শাখা থেকে নাহরের শাখার ভিতরে
দেহ নয়- ছায়া শুধু, ছায়া যেন কাহাদের নড়ে
নাহরের শাখা থেকে পলাশের নরম শাখায়
পাখা নাই- তবু যেন একরাশ পাখির পাখায়
ধুসর স্বপ্নের মতো ভেসে যায়- উড়ে যেন যায়-
পাখা নাই, তবু যেন একরাশ পাখির পাখায়
জ্যোৎস্নায় ঘুম নাই আজ রাতে তাহাদের চোখে
মুনিয়া ময়না টিয়া ঘুমায়েছে যেইখানে চাঁদের আলোকে
সেইখানে এই সব লঘুচোখ বানরের দল
যাবে না জানিতে আজ রং আর শিশিরের জল
তুলিবে না মূঢ় কোলাহল আর, ভাঙিবে না নীড়
ডানা টেনে ডিম ভেঙে হরিয়াল কোরাল পাখির
শান্তি নষ্ট করিবে না নীল বনানীর
জ্যোৎস্নায় আজ প্রাণ তাহাদের নিবিড়- গভীর
বানর বানর তবু: পাতা ছিঁড়ে একরাশ পেয়ারার ঢিল
ছুঁড়ে মারে নিরীহ পেঁচার গায়ে- হেসে-হেসে পেটে-পিঠে ধ’রে যায় খিল
ধূসর পেঁচারা সব উড়ে যায় দিগন্তের পানে
নীরব গম্ভীর মুখ- জীবনের গাঢ়তর রূপের সন্ধানে
নির্জন হাওয়ার দিকে- মায়াসিড়ি নদীটির তীরে
অতিদূর নিঃশব্দ শিশিরে
ব’সে গিয়ে মাদারের প্রসারিত ডালে-ডালে তারা
এক বার আধ-বার ইঁদুরের সাড়া
তাহাদের স্বপ্ন ভাঙে- এক বার- দুই বার- এক-আধ বার
হলুদ ধানের গন্ধ- ধানের ছায়ার অন্ধকার
তাহাদের স্বপ্ন ভাঙে- গাছ থেকে গাছে-গাছে এক বার করে কলরব
তার পর বহু ক্ষণ কবরের মতন নীরব
এক বার হামাগুড়ি দিয়ে দূর মাঠের ভিতরে
জলসিড়ি ধানসিড়ি নদীদের জলের উপরে
নিজের ডানার ছায়া দেখে আসে- শুঁকে আসে ভাঁড়ারের সোনার আঘ্রাণ
তবুও তাদের দেহ ম্লান- স্বপ্ন আরও আরও আরও ম্লান
যখন সবুজ মাঠে সোনালি ধানের স্তূপ চুমো দিয়ে গভীর শীতের জ্যোৎস্না নামে
সোনার গোলার কাছে সারা-রাত পেঁচা এসে থেমে থাকে- আর তার কবি এসে থামে
কেন থামে? সারা-রাত থেমে থাকে?- এই ধান- এই শীত- এই জ্যোৎস্না নীরবতা: কী মানে ইহার?
‘এক বার যা হয়েছে, হবে না ক’ আর!’
‘এক বার যা হয়েছে, হবে না ক’ আর-‘
এই কুহকের কবি পেঁচা তুমি- থেমে থাকি তাই বারবার
সোনালি ধানের ছবি, জ্যোৎস্না আর শীত আর নীরবতা এলে
থেমে থাকি পৃথিবীর সব কথা সব কাজ ফেলে…