জন্মভূমি


এইনা জনম ভূমি সুখের সদন,
সুশোভিত নানাদৃশ্যে অতুল সুন্দর!
স্থানে স্থানে তরু লতা নয়ন রঞ্জন
রচিয়াছে কত শত কুঞ্জ মনোহর!
অইযেরে ভগ্ন চুড় হর্ম্ম্য শত শত
ছিল ইহা এক দিন অতি সম্মোহন,
নীরবে কালের সনে যুঝি অবিরত
অদৃষ্টের দোষে হায় গতশ্রী এখন!


যেই খানে প্রচুর কৃষক নিকরে
কিঙ্করীর সম সদা অনুজ্ঞা যোগায়!
যেই খানে নর নারী রজনী বাসরে
পলকের মাঝে পায় যেই যাহা চায়!
যেই খানে বার মাস হাসিয়া হাসিয়া
বিরাজিছে সমভাবে বসন্ত সময়!
যেই খানে কচি কচি পাতা নড়াইয়া
সুখময় সমীরণ মৃদু মৃদু বয়!


শৈশব সময়ে আমি যেখানে আসিয়া
কতযে সরলচিত্ত বন্ধুগণ সনে,
কতমত খেলা মরি খেলিয়া খেলিয়া
যাপিতাম সারাদিন প্রমোদিত মনে!
এই নারে সেই স্থান? মানস মোহন
যার সম এজগতে নাহি কোন গ্রাম!
প্রকৃতির লীলা ক্ষেত্র, ভূতলে নন্দন,
দেবতা বাঞ্ছিত চারু অতুলিত ধাম!


এই যে বিস্তৃত মাঠ শ্যামল বরণ,
শরতে বসন্তে পরি নব বেশ ভূষা
ভুলায় দরিদ্র ক্লিষ্ট কৃষকের মন
সায়াহ্নে অথবা এলে সুখময়ী উষা!
অইযে তটিনী, অই কুল কুল স্বরে
প্রবাহিছে অবিরাম, মাতাইয়া ধরা;
তীরে শ্যাম তরু রাজি ধরি পরস্পরে
শোভিছে সুন্দর, কণ্ঠে লতা মনোহরা!


মনোহর দেবালয় পর্ব্বত উপরে
মানব নয়নে কিবা শোভা সম্পাদিত;
কপোত-কপোতিগণ সরস অন্তরে
যাহার চুড়ায় আসি উড়িয়া বসিত!
সেই সব শোভা আমি সায়াহ্ন সময়
কত দিন মুগ্ধমনে দেখিয়াছি হায়!
উটজ বাঁশের ঝাড় অট্টালিকা চয়,
বিম্বিত সে ক্ষুদ্র প্রাণা তটিনীর গায়!


প্রভাত হইত যবে, উদিয়া গগনে
বিতরিত কর রাশি বালার্ক তপন
ফুটায়ে পঙ্কজ-কলি, মানব জীবনে
ঢেলে দিত মধুরতা প্রভাত পবন!
দারুণ মধ্যাহ্নে যবে আসিত ভুবনে,
অগ্নিময় বেশ রবি করিয়া ধারণ!
দগ্ধিয়া মারিত যত জীব জন্তু গণে
অজস্র অনল রাশি করি বরিষণ!


সে সময়ে পান্থ আর রাখাল নিকর,
আতপ-উত্তাপে মরি পিয়াসে দহিয়া!
যুড়াইতে সেই দক্ষ ক্লান্ত কলেবর,
এই তরুতলে হায় বসিত আসিয়া!
এই যেরে তরু পরে ঘন পত্র চয়,
ইহাদের তলাদিয়া শীতল পবন
মৃদু মৃদু সঞ্চারিয়া মধুরতা ময়,
জুড়াইত পথিকের তৃষিত জীবন!


এ সময়ে থেকে থেকে করি সুখস্বন,
গাইত কেমন গীত বসন্ত বউরী!
মাঝে মাঝে কুঞ্জ হতে কোকিল কূজন
উঠিত আকাশ পথে প্রতিধ্বনি করি!
আবার হইত যবে সায়াহ্ন সময়,
পশ্চিম জলধি-জলে সুন্দর তপন
ডুবিতরে ধীরে ধীরে কিবা শোভাময়
ছড়াইয়া বিমোহন রজত কিরণ!


আইলে গোধূলি, মরি পশ্চিম অম্বরে,
মেঘ গুলি স্তরে স্তরে বিবিধ বরণ
শশাভিত কি মনোহর; শ্রান্ত কলেবরে
চাষাগণ গৃহ পানে করিত গমন!
এসময়ে নানা জাতি পুষ্প মনোহর
ফুটিয়া উদ্যানে, শোভ করিত বিস্তার!
বুলবুল নাচিত পাশে, বিমুগ্ধ ভ্রমর,
গাইত মধুর স্বরে বসন্ত বাহার!

১০
ধেনুগণ পালে পালে হম্বা করি,
আসিত ছুটিয়া সবে নিকেতন-পানে;
গোপাল বালক যত সুধার লহরী
ঢালিত শ্রবণ-মাঝে রাখালিয়া গানে!
অই ক্ষুদ্র গিরি পরে শান্তির আগার,
পূৰ্ব্বদিকে সরোবর শোভিত কহ্লারে!
শোভিছে সোপান, চুম্বি চরণ তাহার
শ্রেণীবদ্ধ ঝাউ তরু অন্য তিন পাড়ে!

১১
তার নিকটস্থ ক্ষুদ্র শ্যামল প্রান্তরে
শোভিছে দক্ষিণে যার নিকুঞ্জ কানন,
বসি সব সখা সনে প্রফুল্ল অন্তরে
করিয়াছি কত দিন কত আলাপন!
বিহঙ্গম স্ব স্ব রবে কোলাহল করি
ঝাঁকে ঝাঁকে নীড় পানে যাইত উড়িয়া!
কেহ বা সুউচু ঘন বাঁশ ঝাড়’পরি
আশ্রয় লইত আসি সন্ধ্যা নিরখিয়া!

১২
অনুঢ়া বালিকাদল দাসীদের সনে
নিকুঞ্জ কাননে এসে করিত ভ্রমণ!
দেখিতে দেখিতে সব সদনে সদনে
প্রদীপ জ্বালিত মরি কুলবধুগণ!
মুকুতা জিনিয়া চারু তারকা নিকর,
একে একে কি সুন্দর ফুটিত গগনে!
চন্দ্রমা পরিয়া দেহে কনক অম্বর
হাসাত জগত, স্নিগ্ধ বিমল কিরণে!

১৩
স্থানে স্থানে তরুতলে কিসুন্দর মরি
পল্লব বিচ্ছেদে পড়ি সুধাংশু কিরণ,
চিত্ৰিত আঁধার পটে কুরঙ্গ কেশরী,
ভুলাইতে ভাবুকের চিন্তাকুল মন!
গভীর নিশীথে স্তব্ধ অচেতন প্রায়
প্রকৃতি ঘুমের ঘোরে দেখিত স্বপন!
একটীও জন প্রাণী, ডাকিত না হায়,
মাঝে মাঝে শুনা যেত কুকুর নিস্বন!

১৪
চন্দ্রমার স্নিগ্ধ করে তরঙ্গিণী-জল,
খেলিত কি মনোহর চঞ্চল লহরী!
নাচিত নীরবে যেন করি ঝলমল
অগণিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কনক-সফরী!
অদূরে সুদূরে কত বিটপীর গায়
কোটি কোটি সমুজ্জ্বল খদ্যোত নিকর
নিবিত জ্বলিত,- চিত্ত বিমোহিয়া হায়,
হীরকের পুষ্প-তরু অতি, মনোহর!

১৫
প্রকৃতির এত শোভা নিরখি নয়নে,
মুগ্ধ প্রাণে বসি এই তটীনী সৈকতে,
শৈশবের কত কথা ভাবিলাম মনে,
হেরিতাম কত দৃশ্য জীবনের পথে!
তখন ছিলাম শিশু ভাবি নাই মনে
বিদেশে দৈবের বশে করিব গমন!
এই ভাবে কষ্টে কষ্টে পর প্রপীড়নে
জন্মভূমি জননীর যাইবে জীবন!

১৬
এ রাজ্যের অধিপতি জনক আমার,
চক্রীদের ষড়যন্ত্রে জনমের মত
হ’য়েছেন দেশত্যাগী, সম্পত্তি তাহার
জ্ঞাতি শত্রুদের হস্তে; পর পদানত
আমি হতভাগা; ভাসি শোক, অশ্রুজলে
শৈশবের কত কথা করিয়া স্মরণ!
সবি গেছে ধন রত্ন পর পদতলে
ভিক্ষুকের বেশে আজি যাপি এ জীবন!

১৭
অই যে দ্বিতল বাড়ী নয়ন রঞ্জন
দীর্ঘ বটবৃক্ষ যার উঠিয়াছে শিরে!
অই যে উদ্যান উৎস শোভার সদন,
অই যে বকুল বৃক্ষ সরসীর তীরে!
অই গৃহে একদিন পুতুলের মত,
জনক জননী ক্রোড়ে শোভেছি কেমন!
অই ছাদে দাসী সনে ভ্রমি ইতস্ততঃ
সেবিয়াছি সুশীতল সান্ধ্যসমীরণ!

১৮
অই পুষ্প বনে পুষ্প করিয়া চয়ন
কত দিন কত মালা গাঁথিয়াছি হায়!
কত দিন মুগ্ধ প্রাণে করিয়া যতন
দিয়াছি সে মালা এক ক্ষুদ্র বালিকায়!
সেই দিবা, সেই রাতি হইছে ভুবনে
সেই রবি, সেই শশী সকলিত সেই!
এখনো তো সেইরূপ উদিছে গগনে
তবে কেন এবে আর সেই ভাব নেই?

১৯
আরতো বিহগবৃন্দ বসি তরু পরে
প্রভাতে উল্লাসে মাতি ভৈরবী না গায়!
আরতো পাপিয়া উড়ি প্রদোষ অম্বরে
সাধের পুরবী নাহি আলাপিছে হায়!
আরতো প্রভাতে হায় জননী আমার
জাগে না সে হাসি মুখে পূর্ব্বের মতন!
গেছে যদি সব,- তবে কেন বেঁচে আর?-
-জননীর মত কেন যায় না জীবন!