আওয়ামী লীগের চার মূলনীতির উৎস

১৯৭০ সনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো ৬ দফার ভিত্তিতে। এই ৬ দফার মধ্যে আওয়ামী লীগ গৃহীত ৪ রাষ্ট্রীয় মূলনীতির একটিরও উল্লেখ ছিল না। তা ছাড়া নির্বাচনী ইশতিহারে আওয়ামী লীগ আরো উল্লেখ করেছিল যে, তারা ইসলাম ধর্ম বিরোধী কোন আইন-কানুনও পাস করবে না। কিন্তু আওয়ামী লীগ ‘৭২ সনের জানুয়ারীতে ক্ষমতাসীন হওয়ার সাথে সাথেই ইসলামের বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু করে দেয় এবং গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জাতীয়তাবাদ নামে রাষ্ট্রের ৪ মূলনীতি নির্ধারণ করে, যা পরবর্তীতে ‘৭২-এর রাষ্ট্রীয় সংবিধানেও সন্নিবেশিত করা হয়। এই ৪ নীতির মূল উৎস কোথায়? কেনই বা উক্ত ৪ নীতিকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করা হলো? এ প্রশ্নগুলোর জবাব জনগণ আজো পায়নি।

যে আওয়ামী লীগ ‘৭০-এর নির্বাচনে অঙ্গীকারাবদ্ধ ছিল কুরআন-সুন্নাহ পরিপন্থী কোন আইন পাস না করার পক্ষে, সেই আওয়ামী লীগই ভারত থেকে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গুটিয়ে নিয়ে এসে ক্ষমতার মসনদে বসার সাথে সাথেই অঙ্গীকার ভঙ্গ করল কেন? স্বেচ্ছাচারী পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ করেও আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব স্বেচ্ছাচারমুক্ত হতে পারল না। দেশের জনমতের কোনরূপ তোয়াক্কা না করেই রাষ্ট্রীয় মূলনীতির মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব জনগণের উপর জবরদস্তিভাবেই চাপিয়ে দিল।

আওয়ামী লীগ শাসনকালের বিশ্বাসঘাতকতার আনুষ্ঠানিক স্বাক্ষর এখান থেকেই শুরু। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে গেলে ‘৭০-এর নির্বাচনের কথায় ফিরে যেতে হয়। ‘৭০-এর নির্বাচন ছিল পাকিস্তান কাঠামোর আওতায় অনুষ্ঠিত নির্বাচন। আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা জনগণের ম্যান্ডেট লাভ করেছিল পাকিস্তানের অধীনে। নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের অধীনে নয়। সুতরাং ‘৭২-এর আওয়ামী লীগ কর্তৃক সংবিধান প্রদান নীতিগত দিক দিয়ে মোটেই বৈধ ছিল না। সমগ্র জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়। অমন একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয় নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশ। এখানে আরো উল্লেখযোগ্য যে, ‘৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সপক্ষে যারা ভোট প্রদান করেনি, তারাও দেশ-মাতৃকার মুক্তির লড়াইয়ে শরীক হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধে শরীক হয়েছিল আওয়ামী লীগ বিরোধী অথবা আওয়ামী লীগ বহির্ভূত বিভিন্ন সামাজিক এবং রাজনৈতিক শক্তিসমূহ। এই অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাতীয় রূপ ধারণ করেছিল।

কিন্তু যুদ্ধোত্তরকালে আওয়ামী লীগ চরম সংকীর্ণতার পরিচয় দেয় এবং মুক্তিযুদ্ধের জাতীয় রূপকে দলীয় রূপ প্রদানের জন্য বিভিন্নমুখী ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেয়। যার ফলে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী আওয়ামী লীগ বহির্ভূত সকল শক্তি হতোদম হয়ে পড়ে এবং তারা তাদের নবতর আশা-আকাক্ষার বাস্তবায়ন করার সুযোগ থেকে প্রায় সম্পূর্ণভাবেই বঞ্চিত হয়। যুদ্ধোত্তর বিধ্বস্ত বাংলাদেশে যখন জাতীয় ঐক্যের সর্বাধিক প্রয়োজন ছিল, ঠিক সেই সময়েই আওয়ামীলীগ একলা চলার নীতি অনুসরণ করার মধ্য দিয়ে জনমত এবং জনগণের আশা আকাক্ষা পদদলিত করে চলতে থাকে। এসব কারণে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তায় রাতারাতি ভাটা দেখা দেয়। আওয়ামী লীগের যুদ্ধকালীন দুর্নীতি এবং ব্যর্থতা এবং যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে জনগণের উপর স্বৈরতান্ত্রিক নির্যাতন জনগণ থেকে আওয়ামী লীগকে বিচ্ছিন্ন করার উপসর্গ সৃষ্টি করে।

বস্তুত সেই ভয়ে ভীত আওয়ামী লীগ ‘৭২-এ জনগণের ম্যান্ডেট নেয়ার চিন্তা থেকে বিরত থাকে। অথচ সংবিধান রচনার পূর্বেই জনগণের তরফ থেকে নতুন ম্যান্ডেট লাভ করা ছিল অত্যাবশ্যকীয়। অতএব, এ কথা নির্দ্বিধায় বলা চলে যে, ‘৭২-এ আওয়ামী লীগের এমন কোন বৈধ অধিকার ছিল না যাতে করে তারা দেশ ও জাতির উপর একটি মনগড়া সংবিধান আরোপ করতে পারে। তবুও তারা তা জবরদস্তি করেছে। দেশের জনগণের চিৎকার প্রতিবাদ কোন কাজেই আসেনি।

এটা তাদের দুঃসাহস কিংবা ঔদ্ধত্য ছিল না, আওয়ামী লীগের এই আচরণ ছিল অনুগত তল্পীবাহকের প্রভুর আদেশ-নির্দেশ পালন করার বাধ্যতা বা ব্যস্ততা। কারণ, এ কথা সর্বজনবিদিত যে, বাংলাদেশের ‘৭২-এর সংবিধান প্রণেতা হচ্ছে স্বয়ং দিল্লীর শাসক চক্র। ‘৭২-এর সংবিধানের উৎস তাই বাংলাদেশের জনগণ নয়, সম্প্রসারণবাদী এবং সাম্প্রদায়িক ভারতীয় শাসক চক্রই হচ্ছে মূল উৎস।

এভাবেই যুদ্ধোত্তর বিধ্বস্ত বাংলাদেশের কোটি কোটি বুভুক্ষু মানুষের জন্য অন্নবস্ত্রের পূর্বেই রাষ্ট্রীয় মূলনীতি মাথায় চেপে বসে। এই চার মূলনীতি আরোপ করার মধ্য দিয়ে দিল্লীর কর্তারা তাদের মূল লক্ষ্যই স্থির রেখেছে কেবল। কারণ ভারতীয় সংবিধানও ৪ মূলনীতির ব্যতিক্রম নয়। তাই বাংলাদেশের সংবিধানে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জাতীয়তাবাদ সন্নিবেশিত করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে মূলত ভারতেরই একটি অঙ্গরাজ্য হিসেবে সূক্ষ্মভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং নীতির গোপন সূত্রে বেঁধে দেয়া হয়েছে।

কারণ এ যুগে তো আর দেশ দখল করে রেখে অঙ্গরাজ্যে পরিণত করা হয় , তথাকথিত নীতির জালেই পেঁচিয়ে রাখা হয় কোন দেশকে। শক্তিশালী দেশসমূহ দুর্বল দেশ ও জাতিকে বিভিন্ন চুক্তি এবং শর্তে আবদ্ধ করে রাখে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সক্রিয় অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যই ছিল বাংলাদেশকে এমন কিছু দাসত্বমূলক চুক্তি এবং শর্তের মধ্যে বন্দী করে রাখা। ‘৭২-এর সংবিধান সেই সকল দাসত্বমূলক চুক্তির মধ্যে একটি এবং অন্যতম শর্ত।

এবার তাহলে দেখা যাক, ‘৭২-এর প্রণীত সংবিধানের ৪ মূলনীতি বাংলাদেশের বাস্তবতার সাথে কতখানি সঙ্গতিপূর্ণ। প্রথমে গণতন্ত্র। এখানে সংসদীয় গণতন্ত্রের কথাই বলা হয়েছে। পশ্চিমা ধাঁচের এই সংসদীয় গণতন্ত্র বাংলাদেশের বাস্তবতার মুখে কেবল অচলই নয়, স্বৈরতান্ত্রিকও বটে। সংসদীয় গণতন্ত্র পুঁজিবাদের রাজনৈতিক শ্লোগান। এই সংসদীয় গণতন্ত্র পুঁজিবাদ প্রবর্তিত আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনিক কাঠামোকে বহাল তবিয়তে টিকিয়ে রাখার মূলমন্ত্র। শোষণ-জুলুমভিত্তিক সমাজ কাঠামোই হচ্ছে পুঁজিবাদের ভিত্তি। সম্পদের ব্যক্তি মালিকানায় বিশ্বাসী পুঁজিবাদ তার চরিত্রগত শোষণ-জুলুম অব্যাহত রাখার স্বার্থে প্রবর্তন করেছে আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনিক কাঠামো। এই শোষণমুখী আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনিক কাঠামোয় যাতে কেউ কোনরূপ অনিষ্ট সাধন না করতে পারে তার জন্য সংসদীয় গণতন্ত্র একটি মোক্ষম ফাঁদ সৃষ্টি করেছে যার নাম ‘সংসদীয় নির্বাচন’। সংসদীয় নির্বাচনের কাজই হচ্ছে আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনিক কাঠামোকে ‘নিউ লীজ অব লাইফ’ প্রদান করা, অর্থাৎ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আমলাতান্ত্রিক নতুন জীবন দান করা। এভাবেই সংসদীয় গণতন্ত্র সংসদীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদভিত্তিক শাসন-জুলুমমুখী আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনিক কাঠামোকে ধারাবাহিকভাবে টিকিয়ে রাখে। অন্য কথায়, সংসদীয় গণতন্ত্র পুঁজিবাদী শোষণ-শাসনের ভিতকেই কেবল টিকিয়ে রাখেনা, উত্তরোত্তর মজবুতও করে তোলে।

এছাড়াও সংসদীয় গণতন্ত্র সম্পদশালীদেরকেই আইন প্রণয়নকারী সংস্থার প্রতিনিধিত্ব অর্জনে সাহায্য করে। সংসদীয় গণতন্ত্র হচ্ছে বিত্তবানদের গণতন্ত্র, বিত্তহীনদের গণতন্ত্র নয়। সংসদীয় গণতন্ত্রে আইন প্রণয়নকারী সংস্থার প্রতিনিধি হিসেবে বিত্তবান শ্রেণীর লোকেরা নিজেদের স্বার্থ এবং মরযীমাফিক নতুন নতুন আইন প্রণয়ন এবং আইন ভঙ্গেরও বেপরোয়া ক্ষমতার অধিকারী হয়। সমগ্র প্রশাসনই বিত্তবানদের অনুগত তাবেদার হয়ে থাকে। এই ধরনের সমাজ কাঠামোতে কোটি কোটি বিত্তহীন শ্রমজীবী মানুষের যেখানে কর্মসংস্থান হয় না, তারা খুঁজে পায় না এক মুঠো অন্ন, সে সমাজেই মুষ্টিমেয় বিত্তবানদের কাছে জমে ওঠে সম্পদের পাহাড় এবং দারুণ স্বেচ্ছাচারিতার সাথে তারা বিভিন্ন আরাম-আয়েশ, ভোগ-বিলাস এবং অনুৎপাদক কর্মকাণ্ডে বেশুমার অর্থ-সম্পদ অপচয় করে বেড়ায়। সংসদীয় গণতন্ত্রের রাজ্যে এ সকল বিত্তবানের জন্য আইন থাকে নীরব এবং অন্ধ। কারণ আইনের মালিকও তারা।

সংসদীয় গণতন্ত্র এমন একটি ‘মনোহরিণী ডাইনী’ যা মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং বিত্তহীনদেরকে সংসদীয় নির্বাচনের রঙিন ফানুস উড়িয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল এবং শেয়ার করার জন্য অব্যাহতভাবে প্রলুব্ধ করে বেড়ায়। কিন্তু বিত্তহীনরা আশায় আশায় নিরর্থক ঘুরতেই থাকে কেবল। মরুভূমির ক্লান্ত পথিকের ন্যায় বিত্তহীনরাও ‘সংসদীয় গণতন্ত্র’ নামক মরীচিকাটির পেছনে ছুটতেই থাকে। গণতন্ত্র বিত্তহীনদের কাছে ধরা দেয় না।

কোটি কোটি মানুষকে ভুখা নাঙ্গা এবং অবহেলিত রেখে পুঁজিবাদ সংসদীয় গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজে মুষ্টিমেয় বিত্তবানের হাতে যাবতীয় সম্পদ এবং উৎপাদন যন্ত্রের মালিকানা কেন্দ্রীভূত করে- এটাই পুঁজিবাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য, চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য। এমন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন একটি রাজনৈতিক দর্শনকে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মূলনীতির প্রথম স্তম্ভ করার মধ্য দিয়ে জনদরদী, দেশদরদী নামে পরিচিত শেখ মুজিব এবং তার আওয়ামী লীগ কিভাবে বাংলাদেশের কোটি কোটি দুঃস্থ, শোষিত মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন? পুঁজিবাদী সমাজ কাঠামো বহাল রেখে যারা সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ শোষিত নির্যাতিত মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর স্বপ্ন দেখেন, কিংবা ওয়াদা করেন, তারা হয় অজ্ঞ না হয় তারা চরম প্রতারক।

এতো গেল আওয়ামী লীগ কর্তৃক প্রণীত ৪ রাষ্ট্রীয় মূলনীতির প্রথম স্তম্ভ সম্পর্কে কিছু কথা।

এবারে ৪ মূলনীতির দ্বিতীয় স্তম্ভকে আলোচনায় আনা যেতে পারে। দ্বিতীয় স্তম্ভ হচ্ছে সমাজতন্ত্র। ভাল কথা। সমাজতন্ত্রের বিস্তারিত সংজ্ঞা দেয়ার কোন প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। সমাজতন্ত্র হচ্ছে পুঁজিবাদ বিরোধী দর্শন। বস্তুবাদভিত্তিক সমাজতান্ত্রিক দর্শন পুঁজিবাদের কবর রচনার মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে। পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে আপোষহীন লড়াই করার মধ্য দিয়ে যেক্ষেত্রে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হয়, সেক্ষেত্রে একই রাষ্ট্রে পুঁজিবাদী দর্শন এবং সমাজতান্ত্রিক দর্শন একই সঙ্গে কি করে রাষ্ট্রীয় মূলনীতির অন্তর্ভুক্ত হতে পারে? শেখ মুজিব এবং আওয়ামী লীগের দাপটে বাঘ-মহিষকে যেমন একঘাটে জল খাওয়ানোর চেষ্টা চলেছে, ঠিক তেমনি হয়ত পুঁজিবাদ এবং বেচারা সমাজতন্ত্রকে একইভাবে একই ঘাটের জল গিলানোর অপচেষ্টা চলেছিল আর কি! উপরিউক্ত দু’টি দর্শনের ভিন্ন ভিন্ন উৎপাদন সম্পর্ক রয়েছে। পূর্বেই উল্লেখ করেছি, উৎপাদন যন্ত্রের ব্যক্তিমালিকানাভিত্তিক সম্পর্কের অধিকারী হচ্ছে পুঁজিবাদ। আর, উৎপাদনযন্ত্রের সমষ্টিগত কিংবা রাষ্ট্রীয় মালিকানাভিত্তিক সম্পর্কের অধিকারী হচ্ছে সমাজতন্ত্র। প্রথমটি ব্যক্তির হাতে অর্থ-সম্পদ কেন্দ্রীভূত করে আর দ্বিতীয়টি সমষ্টির মধ্যে অর্থ-সম্পদের বণ্টন করে এবং উৎপাদন যন্ত্রের ব্যক্তিমালিকানার ভিত সম্পূর্ণভাবেই উপড়ে ফেলে। সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী এবং বৈরী সম্পর্কের এই দু’টি দর্শনকে কোন ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠী বিশেষের জনপ্রিয়তার দাপটে বাঘ-মহিষের মত একই ঘাটে জল গিলানো সম্ভবই নয়। কিন্তু কেউ যদি তা সম্ভবে পরিণত করার প্রয়াসও চালায়, তাহলে অবশেষে একই ঘটনার অবতারণা ঘটবে যা মুজিবকে কেন্দ্র করে ঘটেছে ১৫ই আগস্ট, ১৯৭৫ সনে। পুঁজিবাদ এবং সমাজতন্ত্রের মধ্যকার সম্পর্ক ঠাট্টা-তামাশার সম্পর্ক নয়, সে সম্পর্ক হচ্ছে রক্তক্ষয়ী আপোসহীন সম্পর্ক- একে অপরের নিঃশেষের মধ্যে টিকে থাকার সম্পর্ক।

রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে একই সাথে পুঁজিবাদ প্রবর্তিত সংসদীয় গণতন্ত্র এবং মার্কসবাদ প্রবর্তিত সমাজতন্ত্র এই দুই বিপরীতমুখী নীতির সংমিশ্রণের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিব এবং তার আওয়ামী লীগ তাহলে কি লক্ষ্য অর্জন করতে চেয়েছিল? আমার মতে তাদের দু’টি প্রধান লক্ষ্য ছিল। প্রথমত সংসদীয় গণতন্ত্রের নামে রাতারাতি একটি বিত্তবান গোষ্ঠী সৃষ্টি করার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা সেই নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মধ্যে কেন্দ্রীভূত রাখা। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে- সংসদীয় গণতন্ত্রের অধীনে কোটি কোটি ভুখা-নাঙ্গা মানুষ এবং শিক্ষিত ও বেকার যুবক শ্রেণী ক্রমশ লাঞ্ছনা ও বঞ্চনার কশাঘাতে বিদ্রোহী হয়ে উঠে যাতে সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার দাবীতে সশস্ত্র বিপ্লবের পথে ধাবিত না হতে পারে, সে জন্য কেবল প্রতারণার খাতিরেই রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে ‘সমাজতন্ত্রকে’ একটি স্তম্ভ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। এটা নিছক আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। সমাজতন্ত্র দিয়ে সমাজতন্ত্র ঠেকানোর পুরানো অপকৌশল। চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতির সঙ্গে সমাজতন্ত্র জুড়ে দিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব তাৎক্ষণিক ফায়দা বেশ লুটে নিয়েছে , পাকিস্তানী পুঁজিপতি এবং কিছু কিছু উঠতি বাঙালী পুঁজিপতির দ্বারা প্রতিষ্ঠিত শিল্প, কল-কারখানাগুলোকে বিনা পরিকল্পনায় রাতারাতি রাষ্ট্রীয়করণ করার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ এবং তার অঙ্গ সংগঠনসমূহ মূলত বেপরোয়া লুটতরাজ করার সুবর্ণ সুযোগ লাভ করেছিল। রাষ্ট্রীয়করণ করার নামে আওয়ামী লীগ ঘেঁষা ব্যক্তিকরণ ও গোষ্ঠীকরণ করা হয়েছিল। শিল্প-কলকারখানাসমূহের লুটতরাজের প্রতিযোগিতা বর্বর চেঙ্গিস-হালাকু খানদেরকেও হার মানিয়েছে। শাসক কর্তৃক নিজ দেশের এবং জাতির সম্পদ বেপরোয়া লুণ্ঠনের দৃশ্য জাতি এই সর্বপ্রথম প্রত্যক্ষ করল। এখানে যে বিষয়টি অত্যন্ত বিস্ময়কর তা হচ্ছে পুঁজিবাদী ভারত বাংলাদেশের জনগণের জন্য সমাজতন্ত্র উপহার দেবে এমন একটি দূরাশা আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব করলই বা কি করে? আদৌ কি তারা তা করেছে না করলেও ভারত থেকে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গুটিয়ে আনার সময় সমাজতন্ত্রের নামাবলী জড়িয়ে তো তারা এসেছে বাংলাদেশের মসনদে।

এতো রইলো রাষ্ট্রীয় মূলনীতির দ্বিতীয় স্তরের কিছু কথাবার্তা।

এবারে তৃতীয় স্তম্ভটির কিছু রহস্য উদঘাটন করা যাক। আওয়ামী লীগের ৪ রাষ্ট্রীয় মূলনীতির তৃতীয় স্তম্ভ হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ। গভীর ধর্মীয় আবেগ অনুভূতিসম্পন্ন বাংলাদেশের জনগণের উপর ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ আরোপ করার বিষয়টিকে মোটেই হালকা করে দেখার কোনভাবে অবকাশ নেই। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত বাংলাদেশের জনগণের গভীর ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিফহাল থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের উপর ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’ চাপিয়ে দেয়ার মত এতবড় একটি ভুল পদক্ষেপ নিতে গেল কোন সাহসে? ভারতেরই অনুগত তাবেদার আওয়ামী লীগ সরকারের মাথায় এতবড় একটা ভুলের বোঝ চাপিয়ে দিয়ে ভারত কি এভাবে আওয়ামী লীগেরই রাতারাতি ধ্বংস কামনা করেছিল? যদি উপরিউক্ত প্রশ্নের একটিও সঠিক না হয়ে থাকে, তাহলে বাংলাদশের জনগণের উপর ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ চাপিয়ে দেয়ার অন্তরালে ভারতের আসল উদ্দেশ্য কি ছিল? বাংলাদেশের জনগণ কেবল ধর্মপ্রাণই নয়, এ মাটির শতকরা ৯০ ভাগেরও অধিক জনগণ পবিত্র ইসলাম ধর্মের অনুসারী। সংখ্যাগরিষ্ঠ এই বিশাল জনগোষ্ঠীর কাছে পবিত্র ইসলাম একটি সার্বিক জীবন সত্তা, কেবল একটি গতানুগতিক ধর্ম নয়। ইসলামভিত্তিক গড়ে ওঠা এই সার্বিক জীবনসত্তা বোধকে রক্ষা করার জন্য এদেশের এই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ অকাতরে জীবন বিলিয়ে দিতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। প্রতিবেশী ভারত এ ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞ থাকার কোন কারণই নেই। এতো কিছু অবগতির পরেও ভারত আজ্ঞাবহ আওয়ামী লীগকে বাধ্য করেছে ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজা বহন করতে। এর স্পষ্ট জবাব হচ্ছে ভারত মোটেই ভুল করেনি। আওয়ামী লীগের উপর ধর্মনিরপেক্ষতা চাপিয়ে দিয়ে ভারত আওয়ামী লীগেরও সর্বনাশ কামনা করেনি। ভারতের হিসেবে বিন্দুমাত্র ভুল নেই। আধ্যাত্মিকতার দিক দিয়ে সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে ভারতের প্রধান শত্রুকে ভারত চিহ্নিত করতে মোটেও ভুল করেনি। দর্শনগতভাবে মার্কসবাদভিত্তিক সমাজতন্ত্রও তাদের শত্রু, কিন্তু সে শত্রু তেমন জোরালো নয়। সে শত্ৰু আধ্যাত্মিকতার দিক দিয়ে শূন্য এবং রাজনীতিগতভাবে দুর্বল। ভারতীয় পুঁজিবাদের দাপট এবং ভারতীয় আধ্যাত্মিকতা এবং নৈতিকতার জোর দিয়ে তারা সমাজতন্ত্র নামক শক্রটির শ্বাসরুদ্ধ করে রাখতে সক্ষম হবে।

কিন্তু যে শত্ৰুটির ভয়ে তারা প্রকম্পিত তাকে তো পুঁজিবাদ, কিংবা পৌত্তলিকতাবাদ ভিত্তিক ঠুনকো আধ্যাত্মিকতার জোরে কোনক্রমেই বশ করা যাবে না। তৌহিদবাদভিত্তিক পবিত্র ইসলামই হচ্ছে ভারতের প্রধানতম ভীতি। ইসলামের ঐতিহ্যবাহী নীতি-নৈতিকতা, ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতি, মূল্যবোধ এবং আশ্চর্যজনক আধ্যাত্মিকতার সম্মুখে ভারত যে কোন এক সময় নিরুপায় হতে বাধ্য হবে সে তত্ত্ব ও রহস্য আমরা অনুভব করতে সক্ষম না হলেও হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদের ধারক-বাহক ভারতীয় শাসকচক্রের মোটেও অজানা নয়। বিশাল ভারতের বিভিন্ন সংকটের মধ্যে সাংস্কৃতিক সংকট হচ্ছে একটি অন্যতম প্রধান সংকট। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারত নীতিগতভাবে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ প্রচার করলেও ভারতীয় সমাজ জীবনের বুনোট এখনো হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদের অভিশপ্ত বর্ণবৈষম্যের প্রভাবমুক্ত মোটেও নয়। হিন্দু ধর্মের এই বর্ণবৈষম্য অথবা ‘জাত ও শ্ৰেণী’ ভেদ-এর কারণে প্রায়শই ভারতের বুকে যে উদগীরণ ঘটে, তা আগ্নেগিরির লাভার চেয়েও ধ্বংসাত্মক। এ ধরনের উদগীরণ ভারতীয় জীবনের অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ছক তছনছ করে দেয়। ভারতের ৭৫ কোটি জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ হিন্দু ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও ভারত হিন্দু ধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে ঘোষণা না করে ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’ অবলম্বন করতে বাধ্য হলো কেন? কারণটা সহজ। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের চাপের মুখে ভারতকে যদি ১৯৪৭ সালে হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা হতো তাহলে তাতে আপত্তির কিছুই থাকতো না। কিংবা ভারতে বসবাসরত ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের তেমন কিছু করারও থাকত না। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সমাজ তাতে বরং খুশীই হতো। কিন্তু তা করা হয়নি কেবল আন্তর্জাতিক সম্পর্কে ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য। কারণ ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা হলে ভারতের জন্য আন্তর্জাতিক সম্পর্ক রক্ষা এবং উন্নয়নের ক্ষেত্রে জটিল সমস্যা দেখা দিতে পারত। ভারতের বাইরে কোন হিন্দু রাষ্ট্র নেই, তাই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বন্ধু হিসেবে সহজে কাউকে নীতিগতভাবে পেত না। দ্বিতীয়ত, ভারত হিন্দুরাষ্ট্র হিসেবে ঘোষিত হলে ভারতের আভ্যন্তরীণ সাংস্কৃতিক সংকট তীব্রভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকত এবং সে কারণেই ভারত জাতীয়ভাবে থাকত বিধ্বস্ত এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে হয়ে পড়তো বন্ধুহীন। এই দ্বিমুখী সংকট উত্তরণের লক্ষ্যেই ভারত সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সমাজকে নাখোশ করেও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদকেই রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে ঘোষণা করতে বাধ্য থেকেছে। ভারতীয় শাসকচক্র এ কথা ভাল করেই জানে যে, হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদের জাত শ্রেণীভেদের বিষবাষ্প কেবল তথাকথিত ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’ ঘোষণার প্রলেপ দিয়ে মুছে ফেলা যাবে না। তবু তো বাহ্যত চক্ষুলজ্জা থেকে কিছুটা হলেও নিস্তার পাওয়া গেল। দেশের অভ্যন্তরে হিন্দুধর্মের জাত-শ্রেণীভেদের অনলে দেশ ও জাতি ঝুলতে থাক, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ-এর আনুষ্ঠানিক লেবাস দিয়ে বন্ধু সন্ধানে তো কোন বেগ পেতে হবে না। ভারতের ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ হওয়ার মূল ব্যাপারটা এখানেই। তবে ধর্মনিরপেক্ষতার আড়ালে ভারত যে একটি সাম্প্রদায়িক হিন্দুরাষ্ট্র এ সত্য আজ বিশ্বে কার না জানা?

এই হিন্দু-ভারত হিন্দু ধর্মের জাত-শ্রেণীভেদের বিপরীতে ইসলামী সাম্যবাদকে যমের মতই ভয় পায়। ভয় তো পাওয়ারই কথা, কারণ জাত শ্ৰেণীভেদের কঠিন অভিশাপের বিরুদ্ধে নির্যাতিত মানুষ বিদ্রোহ যে একদিন করবেই তা ধ্রুব সত্য এবং ইসলামের সাম্যবাদী নীতি ভারতের নির্যাতিত মানব গোষ্ঠীকে আকস্মিকভাবেই ইসলামের পতাকাতলে সমবেত করতে পারে। বাংলাদেশের ১১ কোটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে ১০ কোটিই হচ্ছে ইসলাম ধর্মের অনুসারী।

তাছাড়া, বাংলাদেশে বিস্ময়কর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের দৃষ্টান্ত বিদ্যমান। বাংলাদেশের মাটিতে সাম্প্রদায়িকতা নেই বলেই অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা কখনই নির্যাতিত কিংবা সামাজিকভাবে সংকটাপন্নও হচ্ছে না। তেমন একটা কিছু হলেও না হয় আধিপত্যবাদী ভারতীয় চক্র বাংলাদেশের উপর সরাসরি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার একটা সুযোগ লাভ করত। তেমন তো কোন সুযোগ নেই, কিন্তু বাংলাদেশের উপর ভারতের কর্তৃত্ব কোন না কোন উপায়ে তো প্রতিষ্ঠা করতে হবেই। বাংলাদেশের উপরে সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হলে সামরিক কর্তৃত্ব স্থাপনের তেমন কোন প্রয়োজন পড়বে না। সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার মধ্য দিয়ে ভারতের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব বাংলাদেশের উপর অটোম্যাটিক প্রতিষ্ঠা লাভ করে যাবে। বাংলাদেশের মূল সংস্কৃতি হচ্ছে ইসলামভিত্তিক, কারণ ইসলামই হচ্ছে শতকরা ৯০ ভাগ জনগণের ধর্ম এবং এই ধর্মকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের মানুষের সাংস্কৃতিক জীবন। তাই ইসলাম ধর্মের গভীর আবেগ-অনুভূতির শিকড় থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণকে বিচ্ছিন্ন করতে হলে প্রয়োজন এমন একটি দর্শন, যা মানুষকে ইসলাম ধর্মের কঠিন অনুশাসন মেনে চলার পথে নিরুৎসাহিত করে তুলবে। অপরদিকে, তরুণ-যুবক শ্রেণীকে প্রলুব্ধ করবে এক বাঁধনহারা, জীবনযাপনের ফাঁদে পা দিতে। ধীরে ধীরে ধর্মীয় অনুশাসনের অনুপস্থিতি তরুণ-যুবক শ্ৰেণীকে বেপরোয়া আরাম-আয়েশ, ভোগপূর্ণ উচ্ছল জীবন পদ্ধতির দিকে ঠেলে দিলেই তারা হয়ে পড়বে শিকড়হীন পরগাছার মতন। তাদের আবেগ-অনুভূতি সমাজের গভীরে প্রোথিত থাকবে না বলেই তারা হবে ভাসমান উচ্ছল জনগোষ্ঠী। তখন তারা আর ইসলামের ঐতিহ্যে গর্ববোধ করবে না এবং ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের জোয়ারে গা ভাসিয়ে চলতে অভ্যস্ত হয়ে পড়বে। কারণ তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ তরুণ-যুবকদেরকে ধর্মের প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তোলে এবং ধর্মীয় অনুভূতি একেবারেই মিটিয়ে দেয়। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ধর্মহীনতারই লেবাসী নাম। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ হচ্ছে বস্তুভিত্তিক দর্শনের সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি। এই দৃষ্টিভঙ্গি চূড়ান্তভাবেই বস্তুকেন্দ্রিক এবং অধিবিদ্যামুক্ত। এই দৃষ্টিভঙ্গির আওতায় স্রষ্টা কিংবা পারলৌকিক কোন শক্তির কোন স্থান নেই, সুতরাং ধর্মের ও কোন স্থান নেই। মুসলিম তরুণ-যুব গোষ্ঠী এই নাস্তিক্যবাদী তত্ত্বে প্রভাবিত হলে তারা স্বেচ্ছায়ই ইসলাম বিদ্বেষী হয়ে উঠবে এবং তাহলেই ভারতীয় শাসক চক্রের গোপন স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়ে যায় অর্থাৎ বাংলাদেশের উপর ভারতীয় সাংস্কৃতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদই হচ্ছে ইসলামের বিরুদ্ধে একটি সুকৌশল ঠাণ্ডা যুদ্ধ। ভারত তাই বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ জুড়ে দিয়ে মোটেও ভুল করেনি, অথবা নিছক লক্ষ্যহীনভাবেই ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ জুড়ে দেয়নি।

এতো গেল বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ৪ মূলনীতির তৃতীয় স্তম্ভ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা।

সর্বশেষে আসে জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গ। রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে জাতীয়তাবাদ জুড়ে দেয়ার পেছনেও ইসলাম বিদ্বেষী মতলব রয়েছে। কারণ জাতীয়তাবাদও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ- এর ন্যায়ই জাতিকে ধর্মবিমুখ করে তুলতে সহায়তা করে এবং ভাষা, কৃষ্টি এবং জাতীয় ঐতিহ্যভিত্তিক মনমানসিকতা গঠন করে। এহেন মনমানসিকতা মানুষকে অহেতুক অহঙ্কারী করে তোলে এবং পার্শ্ববর্তী দেশ ও জাতির বিরুদ্ধে জাত্যাভিমান হিংসা-বিদ্বেষের জন্ম দেয়। এই জাত্যাভিমান ইসলামী সাম্যবাদী চেতনার পরিপন্থী। তাছাড়া ‘বাঙালী জাতীয়তাবাদ’ বাংলাদেশে বসবাসরত মুসলিম জনগণের সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহ্যগত ধ্যান ধারণার প্রতিফলনও সঠিক অর্থে ঘটায়। বাংলাদেশের মুসলিম বাঙালী এবং পশ্চিম বাংলার হিন্দু বাঙালীর সাংস্কৃতিক চেতনার উৎসস্থলকে এক ও অভিন্ন করে দেখার কোন অবকাশ নেই। দুই বাংলার সাংস্কৃতিক অঙ্গনের রূপ বাহ্যত এক মনে হলেও সাংস্কৃতিক চেতনার উৎস বিপরীতমুখী। স্বাধীন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক চেতনার উৎস হচ্ছে ‘তৌহিদবাদ’, যা ইসলাম ধর্মভিত্তিক। অপরদিকে পশ্চিম বাংলার জনগণের সাংস্কৃতিক চেতনার উৎস হচ্ছে ‘পৌত্তলিকতাবাদ’, যা হিন্দু ধর্মভিত্তিক। সুতরাং ‘বাঙালী জাতীয়তাবাদ’ পশ্চিম বাংলার বাঙালী ভাই-বোনদেরকে যতটা অনুপ্রাণিত করবে, বাংলাদেশের মুসলিম বাঙালীকে ততটা অনুপ্রাণিত করবে না। কারণ, ‘বাঙালী জাতীয়তাবাদের’ সাংস্কৃতিক চেতনায় পৌত্তলিকতাবাদ-এর প্রভাব অধিক। এই দর্শনগত পার্থক্যের কারণে উভয় বাংলার ভাষা, খাদ্য, পোশাকসহ সংস্কৃতির বাহ্যিক দিকের একটি সাদৃশ্য থাকা সত্ত্বেও উভয়ের মধ্যে বিরাজ করছে এক সুকঠিন প্রাচীর, যা কখনো তাদেরকে এক হতে দেবে না ‘বাঙালী জাতীয়তাবাদের’ মধ্য দিয়ে সেই প্রাচীর ভেঙে চুরমার করা সম্ভব হবে না, তবে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর একটা অংশকে সেই প্রাচীর টপকিয়ে হয়ত ওপারের সাথে একাত্ম করা যাবে। কিন্তু তাতে ফল হবে বিপরীত। এপারের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর মধ্যে জন্ম নেবে আজন্ম অবিশ্বাস এবং রেষারেষি। ভারতীয় শাসকচক্র মূলত উভয় বাংলার মধ্যে এই স্থায়ী রেষারেষিই কামনা করে। যার ফলে সবকিছু জেনেশুনেই ভারতীয় শাসকচক্র বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মূলনীতির ৪র্থ স্তম্ভ হিসেবে বাঙালী জাতীয়তাবাদকে জুড়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের কতিপয় বুদ্ধিজীবী ‘মুসলিম বাঙালী’ এবং ‘হিন্দু বাঙালীর’ সংস্কৃতিগত পার্থক্য উপলব্ধি করতে না চাইলেও পশ্চিম বাংলার বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় কিন্তু পার্থক্যটা অনেক পূর্ব থেকেই জানেন। এখানে একটা উদাহরণ দিলেই ধারণাটা পরিষ্কার হবে বলে আমার বিশ্বাস। উভয়েই একই হিন্দুধর্মের লোক হওয়া সত্ত্বেও যখন উচ্চবর্ণ হিন্দু নিম্নবর্ণ হিন্দু হরিজনকে জীবন্ত অবস্থায় পুড়িয়ে হত্যা করে, সেই উচ্চবর্ণ হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে মুসলিম বাঙালীদের গ্রহণযোগ্যতা আদৌ থাকতে পারে কি? কেন পারে না? সে উত্তর বাংলাদেশের মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা দিতে লজ্জাবোধ করলেও পশ্চিম বাংলার বুদ্ধিজীবীরা অনেক পূর্বেই সে প্রশ্নের উত্তর যুগে যুগে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠেই দিয়েছে।

নিজেদের সত্যিকার পরিচয় প্রদান করতে যে জাতি হীনম্মন্যতার শিকার হয়, সে জাতির অস্থি-মজ্জা শুকিয়ে যেতে এক শতাব্দীর অধিক প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই ‘সত্তার সংকট এতই তীব্র রূপ ধারণ করেছে যে, আজ তারা ‘নিজ সত্তা’ প্রকাশে দ্বিধাগ্রস্ত। এ ধরনের আচরণ মুক্তবুদ্ধি কিংবা কোন বাহাদুরীর লক্ষণ মোটেও নয়, বরং এটা হচ্ছে আত্মপরিচয় দানে হীনম্মন্যতা এবং আত্মপ্রবঞ্চনার বহিঃপ্রকাশ। পরগাছাবৃত্তি প্রগতিশীলতার লক্ষণ নয়। বাস্তবতার স্বীকৃতির মধ্যেই প্রগতি। তাই ‘জাতীয়তাবাদ’ সম্পর্কে আমার মতামত বাংলাদেশের ব্যাপক জনগোষ্ঠী আজ এই বাস্তবতারই স্বীকৃতি চায়- কারো কোন করুণা ভিক্ষা করে না। সংক্ষেপে রাষ্ট্রীয় চার নীতির ‘পোস্ট মর্টেম’ এখানেই শেষ।

আওয়ামী লীগ কর্তৃক প্রণীত বাংলাদেশের ‘৭২-এর সংবিধানকে যারা দেশ ও জাতির জন্য পবিত্র আমানত বলে মনে করেন, তাদের কাছে একজন মুক্তিযােদ্ধা হিসেবে আমার সবিনয়ে আশ্বাসবাণী দেশ ও জাতির জন্য- আপনারা ব্রাহ্মণ্যবাদী ভারতীয় শাসকচক্রের তরফ থেকে যে সকল পবিত্র আমানত (!) ১৯৭১ সন থেকে বহন করে নিয়ে এসেছেন, তার মালিকানা নিয়ে আপনাদের সাথে বাংলাদেশের তৌহিদী জনগণের কোনদিনই প্রতিযোগিতা হবে না। তবে রাষ্ট্রীয় মূলনীতির ৪ স্তম্ভ বিশিষ্ট ইমারতটির উপর যে একটি নির্ভরশীল এবং স্থায়ী ছাদ নির্মাণের প্রয়োজন ছিল, সে বিষয়টি আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব কার উপর ছেড়ে দিয়েছিল- ভারত না রাশিয়ার উপর?

জনমত এ বিষয়ে বিভ্রান্ত। ছাদহীন স্তম্ভের উপরে আধিপত্য বিস্তারের উন্মাদশক্তি মাত্রই ছাদ বিছাতে আগ্রহী থাকবে। এটাই তো স্বাভাবিক। হলোও তাই, হচ্ছেও তাই এবং হবেও তাই। আর তাই তো কখনো ভারত, কখনো রাশিয়া এবং কখনো আমেরিকার ইচ্ছামাফিক লীলাখেলা চলছে আমাদের ৪টি স্তম্ভের অভ্যন্তরে।

একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা অবুঝের মত কেবল ৪টি স্তম্ভই ধার করলাম, নিরাপদ একটি বাসগৃহ তৈরি করার প্রস্তুতি নিলাম না।

দেশের কোটি কোটি নির্যাতিত মানুষ এবং তৌহিদী জনগণ আজ সেই নিরাপদ একটি বাসগৃহই কামনা করে, বিদেশী প্রভুদের কাছ থেকে পাওয়া স্তম্ভবিশিষ্ট ইমারত নয়।