শেখ মুজিব ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে ইদানীং প্রচণ্ড বাক-বিতণ্ডা হচ্ছে। বাক-বিতণ্ডার কারণও রয়েছে প্রচুর। একটি নেতৃত্বহীন স্বতঃস্ফুর্ত গণ-বিস্ফোরণকে যে যার মত পুঁজি করার চেষ্টা চালাচ্ছে। এই সশন্ত্র গণ-বিস্ফোরণটি যে মুক্তিযুদ্ধের রূপ নেবে সে ধারণা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বসহ অনেকেরই ছিল না। ২৫শে মার্চ রাতে পাক হানাদারবাহিনীও ঐ রকম বর্বর হামলা পরিচালনা করবে তেমন ধারণাও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের মধ্যে ছিল না। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের কোন ধরনের প্রস্তুতিই ছিল না, তাঁদের মনে ছিল কেবল ক্ষমতা দখলের রঙিন স্বপ্ন ও প্রত্যাশা। তাঁরা যখন নির্দিধায় মন্তব্য করেন যে, পাক সেনাবাহিনীর আক্রমণ ছিল আকস্মিক এবং অপ্রত্যাশিত, এ ধরনের মন্তব্যই কি প্রমাণ করে না যে, তাদের মধ্যে যুদ্ধ চেতনা ছিল সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত?

আওয়ামী লীগের বেশ উচ্চস্থানীয় নেতৃবৃন্দের মন্তব্য পর্যালোচনা করে দেখলেই ঘটনার সত্যতা বেরিয়ে আসবে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এবং যুদ্ধোত্তরকালে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের অনেকের সঙ্গেই আমার কথাবার্তা হয়েছে। ২৫শে মার্চ রাতের কথা স্মরণ করে অধিকাংশ নেতৃবৃন্দই শিউরে উঠে জবাব দিয়েছেন যে, তাদের নাকি কল্পনায়ও ছিল না পাকিস্তান আলোচনার পথ ত্যাগ করে আক্রমণ করবে। অনেকে মার্শাল ল’ জারি হতে পারে পর্যন্ত ধারণা করেছেন।

তবে আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতৃবৃন্দের ভাষায় ‘তাঁরা কল্পনাও করতে পারেননি পাকিস্তান সেনাবাহিনী অমন বর্বরভাবে আক্রমণ করবে’। উপরিউক্ত মন্তব্য থেকে এটা অতি পরিষ্কার যে, আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের চেতনায় মুক্তিযুদ্ধের ধ্যান-ধারণার কোন অবস্থানই ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের বিদ্যমান ধ্যান-ধারণার অধিকারী হলে এ সকল উচ্চ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ শেখ মুজিবের ৭ই মার্চের ভাষণের পর থেকেই সতর্ক হয়ে যেতেন এবং যুদ্ধের জন্য নিদেনপক্ষে মানসিক প্রস্তুতিও গ্রহণ করতেন। তাঁদের নেতা শেখ মুজিব স্বয়ং যেখানে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার যুদ্ধ ঘোষণা করে দিলেন আর সে ক্ষেত্রে প্রথম সারির নেতৃবৃন্দ সুবোধ বালকের ন্যায় সরলভাবে স্বীকার করেছেন যে, পাক বাহিনী যে ঐ রকম বর্বরভাবে বাঙালীদের উপর হামলা চালাবেন, তা তাঁরা নাকি ভাবতেও পারেননি। পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে যুদ্ধ করার ঘোষণা হচ্ছে আর সেই দলের নেতাঁরা বিস্ময় প্রকাশ করছেন শত্রুপক্ষের হামলার ধরন দেখে। সত্যি সত্যি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধটা না হয়ে গেলে ব্যাপারটা বেশ কৌতুককরই ছিল বৈকি।

কিন্তু জাতির প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ ঘটে গেছে বলে ঐ সকল নেতাদের দায়িত্বহীনতা, চেতনাহীনতা এবং অপদার্থতাই প্রমাণিত হয়েছে তাদের ঐ ধরনের বিস্ময়বোধ থেকে। এতো গেল আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতৃবৃন্দের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার একটি নমুনামাত্র।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আসলে বস্তুটি কি এবং কোথায়, সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা বা ব্যাখ্যা কারো কাছেই পাওয়া যায়নি। তবে মুক্তিযুদ্ধের পরে অনেক মহারথীই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার এক এক ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর প্রয়াস নিচ্ছেন। বিদ্যাবুদ্ধির দৌড় তো আমাদের কম নয়, সুতরাং কোন কিছুর সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে আর কতক্ষণ লাগে। ঘটেছেও ঠিক তাই। যার যার মতন সবাই সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যাও দিয়ে যাচ্ছেন। তবে বক্তব্য বিবৃতিতে সবারই এক কথা ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষা করতে হবে।’ অতি বিজ্ঞতাসুলভ ভঙ্গীতে সকলেই ঐ এক কথাই আওড়িয়ে যাচ্ছেন। এ ছাড়া তো উপায়ও নেই, কারণ এ থেকে সামান্য একটু হেরফের হয়ে গেলেই অমনি প্রমাণিত রাজাকারও একজন মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে এই বলে অভিযোগ দাঁড় করাবে যে, অমুক মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধিতা করেছে। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাটা যে কি এবং কাদের এই চেতনা এ নিয়ে ভয়ে আর কেউ তলিয়ে দেখতে চাচ্ছে না, যাক বাবা! যেমন আহে তেমনই থাক। ‘না বুঝে তসবিহর মত জপে যাওয়াটাই শ্রেয়’র মত চিন্তা-চেতনায়ই আমরা সকলে কমবেশী আক্রান্ত এবং সংক্রামিত। তবে স্বাধীনতার ১৭ বছর পরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তিসমূহ আজ প্রতিনিয়ত নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষা করার নসীহত যখন করে বেড়ান, তখন একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার সাধ জেগেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আসলে কি ছিল এবং এ চেতনার অধিকারী কারা- মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল মুক্তিযোদ্ধারা, না মুক্তিযুদ্ধ বহির্ভূতরা?

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সত্যিই কি নির্দিষ্ট কোন রূপরেখা ছিল বা আছে সেই চেতনার ঐক্যই কি মুক্তিযুদ্ধের ঐক্যের ভিত্তি ছিল? স্বাধীনতার ১৭ বছর পরে এ সকল তথ্যের প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের জন্য না হলেও, আমাদের ভবিষ্যত বংশধরদের জন্য তা অবশ্যই প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সকল ধরনের সংকীর্ণতা পরিহার করে সততার সাথে প্রকৃত সত্য উদঘাটিত করার মধ্য দিয়েই কেবল সম্ভব ভবিষ্যত বংশদরদের জন্য মুক্তিযুদ্ধের সঠিক চেতনা ও চিত্র রেখে যাওয়া। অন্যথায় বাঙালীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ বিভিন্ন কালি কলম আর তুলির আঁচড়ে বিকৃত রূপ ধারণ করতে করতে এক সময় ইতিহাসের পাতা থেকেই বিলীন হয়ে যাবে।

মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার হিসেবে আমি কেবল প্রয়াস চালাচ্ছি প্রকৃত সত্য জানতে ও বুঝতে। আমার জানা ও বুঝার মধ্যে ভুল-ত্রুটি থাকতে পারে, কিন্তু তা হবে আমার অজ্ঞতার কারণে, অসততার কারণে নয়। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ এর ব্যাখ্যা আমার বর্তমান জ্ঞান ও চেতনার স্তরে পৌঁছে যেভাবে দাঁড় করাই তাতে কিছু যায় আসে না। তবে আজ থেকে ১৭ বছর পূর্বে মুক্তিযুদ্ধকে আমি কোন চেতনায় অনুভব করেছিলাম সেটাই হচ্ছে প্রধান কথা। আমার ব্যক্তিগত চেতনার কথা আমি পরেই বলব, তবে মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার হিসেবে আমি যুদ্ধের ময়দানে কর্মক্ষেত্রে এবং আমার বিভিন্ন সংযোগের মাধ্যমে বাস্তবে আমি যা দেখেছি, অনুভব করেছি তা আমি আবেগবর্জিতভাবেই এখানে তুলে ধরতে চাই।

মুক্তিযুদ্ধের কোন নির্দিষ্ট চেতনা ছিল না বলে যাদের ধারণা আমার মনে হয় তাঁরা হয়তো বা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি, না হয় তাঁরা মুক্তিযুদ্ধে কোনরূপ অংশগ্রহণ করা থেকেই বিরত ছিল। অথবা তাঁরা মুক্তিযোদ্ধাদের ঐ অংশ যারা বাধ্য হয়ে প্রাণ বাঁচানোর তাকিদে কিংবা সুবিধা অর্জনের লোভে মুক্তিযুদ্ধে ‘নাম কা ওয়াস্তে’ অংশগ্রহণ করেছে। অথবা তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে সচেতনভাবেই অনুপ্রবেশ করেছিল শত্রুপক্ষকে খবরাখবর দিয়ে সাহায্য সহযোগিতা করার জন্য।

‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র নির্দিষ্ট রূপ যে ছিল না তা নয়, তবে সে চেতনা সীমাবদ্ধ ছিল একটা বিশেষ মহলের মধ্যে এবং তাঁরা হচ্ছে তৎকালীন ছাত্র সমাজের সর্বাধিক সচেতন মহলেরও একটা ক্ষুদ্র অংশবিশেষ বিশেষ করে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সেই অংশটি যার নেতৃত্বে ছিলেন ছাত্র নেতা সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক, কাজী আরিফ প্রমুখ। এই অংশটির চিন্তা-চেতনায় সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তানী চক্র থেকে মুক্ত করে এই অঞ্চলকে বাঙালীর জন্য একটি স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন ছিল। এর বাইরে যারা এই অঞ্চলকে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে মুক্ত করে স্বাধীন-সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন, তাঁরা হচ্ছেন কমিউনিস্ট পার্টি (মণি সীং), ন্যাপ (মোজাফফর), ন্যাপ ভাসানীর একটা অংশ, মরহুম সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টি এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযুক্ত কমান্ডার মোয়াজ্জমসহ অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ। এর বাইরে যে ছাত্র সমাজ বা রাজনৈতিক সংগঠন ছিল তাদের জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা ছিল গতানুগতিক দেশপ্রেমিকদের দায়িত্বস্বরূপ, মুক্তিযুদ্ধের উপরিউক্ত নির্দিষ্ট চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নয়।

মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী, পুলিশ, ই.পি.আর, আনসার, অন্যান্য চাকুরীজীবী, ব্যবসায়ী ইত্যাদি মহলের ক্ষেত্রেও এ কথাই প্রযোজ্য। এদের মধ্যে আবার অনেকেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে নিতান্তই বাধ্য হয়ে প্রাণ বাঁচানোর তাকিদে, কেউ কেউ করেছে সুবিধা অর্জনের লোভ-লালসায়, কেউ করেছে পদ-যশ অর্জনের সুযোগ হিসেবে, কেউ করেছে তারুণ্যের অন্ধ আবেগ এবং উচ্ছাসে এবং কতিপয় লোক অংশগ্রহণ করেছে ‘এডভেঞ্চারিজম’-এর বশে। এ সকল ক্ষেত্রে দেশপ্রেম, নিষ্ঠা এবং সততারও তীব্র তারতম্য ছিল, কারণ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেও যারা যুদ্ধ চলাকালীন অবস্থায় এবং যুদ্ধোত্তরকালে চুরি ডাকাতি, ধর্ষণ করেছে, অপর বাঙালীর সম্পদ লোপাট করেছে, বিভিন্নরূপে প্রতারণা করেছে, ব্যক্তি শত্রুতার প্রতিশোধ নিয়েছে, তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সেই নির্দিষ্ট চেতনা যে সম্পূর্ণভাবেই অজানা ছিল তাতে সন্দেহের কোনই অবকাশ নেই। তবে তাদের মধ্যে মুজিবপ্রীতি ছিল, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কিংবা আদর্শবোধ ছিল না। ‘৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে এ ধরনের লোকদের সংখ্যাই ছিল অধিক। যাদের কাছে কেবল শেখ মুজিবই ছিল চেতনা ও আদর্শের বিকল্প, তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সেই সুনির্দিষ্ট চেতনার অভাবে মুক্তিযুদ্ধে এবং মুক্তিযুদ্ধের পরে অন্ধ আবেগের বশে বিভিন্নভাবে বাড়াবাড়ি করেছে এবং আজ পর্যন্ত করে চলেছে।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকলীন অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের সেই সুনির্দিষ্ট চেতনার ধারাবাহিক বিকাশ ঘটানো সম্ভব হয়নি বলেই অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধাই জানত না তাঁরা কোন লক্ষ্য অর্জনের স্বার্থে ঐ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অবতীর্ণ ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা কেবল একটা কথাই জানত- পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীসহ সকল অবাঙালীকেই পূর্ব পাকিস্তান থেকে তাড়িয়ে দেশকে মুক্ত করতে হবে। পুনরায় বাপ-দাদার ভিটায় স্বাধীনভাবে ফিরে যেতে হবে। এর অধিক তাঁরা আর কিছুই জানত না বা বুঝত না। তাঁরা এ কথাটি জানত না বা বুঝত না যে, কেবল অস্থানীয় শোষকগোষ্ঠী বিতাড়িত হলেই দেশ ও জাতি শোষণহীন বা স্বাধীন হয় না। অস্থানীয় শোষকের স্থানটি যে স্থানীয় শোষক এবং সম্পদলোভীদের দ্বারা অতি দ্রুত পূরণ হয়ে যাবে এ বিষয়টি সাধারণ মুক্তিদ্ধোদের জ্ঞান বা বোধশক্তির বাইরে ছিল। এ সত্যটি কেবল তাঁরা তখনই অনুভব করল, যখন সদ্য স্বাধীন দেশে প্রত্যাবর্তন করে সরাসরি প্রত্যক্ষ করল শাসক আওয়ামী লীগ এবং তাদের অন্যান্য অঙ্গ সংগঠনগুলোর মধ্যে ক্ষমতা এবং সম্পদ ভাগাভাগি এবং লুটপাটের দৃশ্য এবং মহড়া। অপরদিকে মুক্তিযুদ্ধের সেই সুনির্দিষ্ট চেতনায় যারা সমৃদ্ধ ছিল, তাঁরা যুদ্ধ চলাকলীন অবস্থায়ই উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিল আওয়ামী লীগের আচার আচরণ, দেশে ফিরে কি হবে।

সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের ঐ চেতনাধারী সামাজিক এবং রাজনৈতিক শক্তিসমূহ স্বাধীনতা-উত্তরকালে আর আওয়ামী লীগের সহযোগিতা করে চলতে তো পারেইনি বরং স্বার্থপর এবং ভোগী আওয়ামী লীগের বিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। আর যারা মুক্তিযুদ্ধের ঐ চেতনায় উদ্বুদ্ধ ছিল না বা হতেও পারেনি, তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের পরে চরমভাবে আশাহত হয়েই বাধ্য হয়েছে যার যার পুরানো সামাজিক অবস্থানে ফিরে গিয়ে অতৃপ্ত আত্মার কেবল পরিতাপই ভোগ করে চলতে। সংখ্যায় তাঁরা ই অধিক এবং তাদের সাথে রয়েছে সমস্ত জনগোষ্ঠী, যারা পরোক্ষ কিংবা প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধের হয় সমর্থক ছিল, না হয় ছিল মুক্তিযুদ্ধের সুফল লাভের বুকভরা আশায় অপেক্ষমান।

এই বিশাল আশাহত জনগোষ্ঠীর কাছে স্বাধীনতার ১৭ বছর পরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ হওয়ার আবেদন-নিবেদন জানানোর ব্যাপারটি কি সম্পূর্ণই অর্থহীন এবং এক ধরনের প্রতারণা নয়? এই বিশাল জনগোষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধের ১৭ বছর পরে পুনরায় সেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অর্জনের কোন প্রয়োজন বোধ করছে না, কারণ মুক্তিযুদ্ধে তাঁরা তাদের সন্তান হারিয়েছে, পিতা হারিয়েছে, স্বামী হারিয়েছে, মা, বোন, কন্যা এবং স্ত্রী হারিয়েছে, ঘর-বাড়ী এবং সম্পদ হারিয়েছে, হারিয়েছে আরো আরো অনেক কিছু। তাদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তখনও ছিল না, তাদের মধ্যে ছিল শেখ মুজিবের প্রতি ভালবাসা, বিশ্বাস এবং স্বাধীনতা লাভের পর স্বাধীনতা ভোগের নিজস্ব চিন্তা-চেতনা এবং অফুরন্ত আশা। তাঁরা যখন প্রত্যক্ষ করল স্বাধীনতা কেবল শাসক আওয়ামী লীগের লোকজনের জন্যই ভোগ এনেছে, তাদের জন্যে নয়, তখন তাঁরা রাতাঁরাতিই আওয়ামী লীগ থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে, কারণ যেখানেই প্রত্যাশা, সেখানেই হতাশা। এ দেশের হিন্দু সম্প্রদায় যারা আওয়ামী লীগের ঘোর সমর্থক ছিল, তাঁরা দেশে প্রত্যাবর্তন করে যখন দেখল আওয়ামী লীগই তাদের ভিটে-ভূমি ‘শত্রু-সম্পত্তি’র নাম দিয়ে দখল করে নিচ্ছে, তখনই আওয়ামী লীগ সম্পর্কে তাদের মোহভঙ্গ হতে শুরু করে।

বেকার ছাত্র-যুবক যখন দেখল স্বাধীনতা তাদের যোগ্য স্থান কিংবা কর্ম সংস্থান করতে ব্যর্থ হচ্ছে, শিক্ষক যখন দেখল স্বাধীনতা তার মান-মর্যাদা রক্ষা করতে সমর্থ হচ্ছে না, বুদ্ধিজীবীরা যখন দেখল সমাজে তাদের মূল্য নেই, সেনাবাহিনী যখন দেখল স্বাধীনতা তাদের গৌরব অক্ষুন্ন রাখতে সক্ষম হচ্ছে না, তখনই কেবল তাঁরা নিজ নিজ মানসিকতা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ব্যাখ্যা প্রদান করা শুরু করল। এ দোষ বা ব্যর্থতা তাদের নয়, এ ব্যর্থতার জন্য দায়ী সমাজের সেই সচেতন অংশই, যারা যুদ্ধের সময় ব্যাপক জনগোষ্ঠী এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ঐ চেতনা উপস্থাপন করতে অপারগ হয়েছে।

তাই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ, সমর্থন কিংবা সহযোগিতা করলেই কেবল মুক্তিযোদ্ধা হওয়া যায় না। মুক্তিযোদ্ধা প্রকৃতপক্ষে তাঁরা ই কেবল হতে পারে, যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পরিপুষ্ট।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যারা পরিপুষ্ট ছিল, তাদের মধ্যে হতাশা নেই। তাদের মধ্যে রয়েছে নবতর সংগ্রামের তীব্র যাতনা-দাহ।

মুক্তিযুদ্ধের জনক হিসেবে পরিচিত মরহুম জনাব শেখ মুজিব মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সম্পর্কে অবগত থাকলেও সেই চেতনায় তিনি পরিপূর্ণভাবে বিশ্বাসী ছিলেন না বলেই ক্ষমতালাভের পরে তাঁর মধ্যে পরিলক্ষিত হয়েছে মারাত্মক দ্বন্দ্ব এবং অস্থিরতা, যার ফলে তিনি কখনো হয়েছেন রাষ্ট্রপতি আবার কখনো দায়িত্ব নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীত্বের। আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতৃত্বের মধ্যেও তদ্রুপ পরিলক্ষিত হয়েছে দোদুল্যমানতা এবং সীমাহীন ক্ষমতা-সম্পদ লাভের মোহ। তাঁরা সকলেই কেবল ক্ষমতার সখ মিটিয়েছে কারণ মুক্তিযুদ্ধ তাদের কাছে ছিল কেবল ক্ষমতা লাভের হাতিয়ার মাত্র, চেতনার উৎস নয়।

এর বাইরে রয়েছে জনগোষ্ঠীরই আর একটি বিরাট অংশ যারা আদর্শগত ভাবে পাকিস্তানের পক্ষে থেকে ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান করেছে। এদের কাছে সেই ‘৭১-এও যেমন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কোন মূল্য ছিল না, আজও তেমন নেই। এরা বরং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বলে কথিত শাসক গোষ্ঠীর ব্যর্থতা অবলোকনের পরে নিজস্ব যুক্তি, আদর্শ এবং অবস্থানের দিক দিয়ে পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী অবস্থানে বিরাজ করছে বর্তমানে। এমতবস্থায় সমাজের সর্বাধিক সচেতন গোষ্ঠীর কাছ থেকেও যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য আহ্বান জানান হয়, তাতেও দেশের বঞ্চিত জনগণের সাড়া পাওয়া যাবে কি না সে বিষয়টি এখন আর গবেষণারও বস্তু নয়। যে মুক্তির জাগরণ মানুষকে নিরাশ করেছে, সে মুক্তির আহ্বানে নতুন করে সাড়া না দেওয়াই স্বাভাবিক। মুক্তির নতুন আহ্বান কেবল নতুন চেতনা জাগরণের মাধ্যমেই সম্ভব। সমাজের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটি অংশের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সীমাবদ্ধ রেখে সেই চেতনাকে মুক্তিযুদ্ধে জনগণের চেতনা হিসেবে আরোপিত করার প্রবণতা এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতারই সামিল। এ ধরনের প্রবণতা না উক্ত চেতনাকে পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম, না সক্ষম সেই চেতনার পুনঃবিকাশ ঘটাতে। জনগণের অতি ক্ষুদ্র একটা অংশের খেয়ালী এবং রোমান্টিক চেতনা কোনদিনই বাস্তবতাকে মুছে দিয়ে জাতীয় চেতনা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে সক্ষম হয় না।