কী এক দ্বায়িত্ব আছে

কী এক দায়িত্ব আছে, জানে না ক’ কেউ
যেইখানে জলসিড়ি নদীটির ঢেউ
ফুরায়ে গিয়েছে ম্লান মাটির ভিতরে
সেইখানে পথিকের হৃদয়ের ‘পরে
পথ এসে হাত রাখে- চেয়ে দেখি বিমর্ষ প্রান্তর
বাইরে ছড়ায়ে আছে- পৃথিবীর গোল
সীমা-রেখা আপনাকে ভুলে গিয়ে একটি সরল
সন্তুষ্ট রেখার মতো টানে
(সূর্য নেই, তবু সেই সূর্যোদয় পানে)
মানুষের সব প্রণয়ের প্রতিদানে
চ’লে গেছে আপনার অন্য সত্যের অনুরোধে
মাঝে-মাঝে জ্ব’লে ওঠে বিকেলের রোদে
পথের সীমায় গিয়ে পথাবয়ব চেয়ে আছে
চোখ দিয়ে যা দেখেছি ভুলে যাই পাছে
সেই ভয়ে অকস্মাৎ অগণ্য দেয়াল
নিঃসঙ্গ লোককে তার প্রচুর ব্যাপ্তির পরকাল
দেখাল স্তিমিত এক অববাহিকার পার থেকে
কোথাও বর্ষণ নেই- তবুও বৃষ্টির শীত মেঘে
প’ড়ে আছে আকাশের মতো এক মহৎ বিধান
কাহাদের বিম, বরগা, মিনার, খিলান
এমন কালিমাময় হয়ে ভেঙে আছে
পরপুরুষের মতো স্পর্শাতুর আকাশের কাছে
সেই দূরে গিয়ে মাটি নিজেকে আবার সৃষ্টি করে
কোথাও আশ্রয় নেই, শোকাবহ আত্ম-নির্ভরে
তরঙ্গায়িত সেই মাটির উপর
বড়ো এক প্রাসাদের মতো পরিসর
চুপ ক’রে রয়ে গেছে লুপ্ত এক নগরীর মতো
মানুষ মৃত্যুর পরে (আপনার) স্বভাববশত
ঐখানে চ’লে যায়- এই মনে হয়
তবুও জীবিত থেকে মানুষের বিখ্যাত হৃদয়
যখনই স্মরণ করে তারা নেমে আসে
এই কড়ি বরগা বিম এ-রকম মেঘের সকাশে
নীরবে ঘোষণা করে নিজের উদয়
জীবিত বা মৃতদের তরে কিছু নয়
কুচিন্তায় অন্ধ হয়ে অন্ধকারে ভেঙে
শাশ্বত চিন্তার মতো আছে তারা জেগে
লন্ডন, প্যারিস, উর, দিল্লি, বেবিলনে
এই প্রাসাদের ছবি মানুষের মনে
মাঝে-মাঝে দেখা দেয় অপ্রত্যক্ষ-বৎ
সেই সব নগরীর নির্মাণ মহৎ।

তবুও মহান তার নিজ ভূমিকায়
চোখ নেই ব’লে, দেখ, স্বচক্ষে তাকায়
ঢের আগে ফুরায়েছে যেই সব কাল
এখানে স্বয়ম্ভূ শিব; পৃথিবীতে ফোপল-দালাল।
অথবা যা লুপ্ত হয়ে তবু ফিরে আসে
হরতন রুহিতন ইস্কাপনের মতো মায়াবীর তাসে
অথবা যা নিভে যেত ক্লান্ত হয়ে নিজের খাতিরে
সে-সব আগুন ঐ জ্ব’লে যায় তীর থেকে তীরে
যে-সব মশাল আরও দূর থেকে জ্বলে
ব্রহ্মার প্রতিভা ছাড়া অন্য মায়া-বলে
সেইখানে থাকে না সকলে
কেউ-কেউ আছে শুধু- চিনি মনে হয়
গান্ধি ভাবে, লিংলিথগোর মনে যত নয়
ততোধিক ইহাদের মুখের বিনয়
এক বার ভালো ক’রে দেখে ফেলে এদের বিহনে
গভীর বিভ্রম এক জন্ম নেয় পৃথিবীর জীবিতের মনে
মেধাবী আগুন তাই রেশমের মতো আস্তরণে
সেই সব প্রিয় নর-নারীদের দেহ ঘিরে
নীরব জেনেনা লোক বানায়েছে নিজের ফিকিরে
সব সমসাময়িকতার হাল থেকে ফেঁসে
কোনও এক দিন মহাসময়ের শেষে
আমিও কি যাব ঐ দেশে
কী পাপ করেছি তাহা ভুলে গিয়ে সব
ব্রহ্মা ও ঢেঁকির তর্ক ছাড়া এক স্তব্ধ অনুভব
আমাকেও ক’রে দেবে স্বভাবনীরব।

এ-দিকে মানুষী এক দাঁড়ায়েছে নিকটের পথে
রাঙা শাপলার মতো কোনও এক নদীর শরতে
মনে হয় মুখ তার- মহনীয় কপালের বিভা
সবুজ আরামে, তার চারি-দিকে ঢেউয়ের প্রতিভা
ঘিরে আছে- অসংখ্য সাপের মতো দ্বিখণ্ডিত জিভ
জল নয়- অনুপম আগুনের মতো
মহিলাকে রমণীয় মনে ক’রে স্বভাববশত
শরীর লেহন ক’রে কাটাতেছে কাল
তবু তার স্মরণীয় মাথা ও কপাল
মোহরে রানির মুণ্ড মনে হয় জাল
এক বার এই মুখ দেখে নিলে এমন আগুনে
এক পা দুই পা ক’রে অনেক পা গুনে
হলুদ মেশাতে আছে অতিকায় পাতিলের চুনে
অনেক নারকী দূত অহরহ এসে
কটাক্ষে যেতেছে এই নারীপ্রদীপ্তিকে ভালোবেসে
তবু তার মহনীয় মাথা ও কপাল
পৃথিবীর পরীক্ষায় মানুষের চাল
হয়তো বজায় থাকে মাথা উঁচু ক’রে
জীবনের প্রসাধন শিঙের মতন তুলে ধ’রে
স্বতই বাহবা পায়- এইখানে তবুও সে উলঙ্গ একাকী
এই মেয়েটির হাত বিকেলের হরিয়াল-পাখি
নীর খুঁজে নেমে আসে আবহাওয়া ভালোবেসে: বুকের উপরে।
তবু কেউ নেই বলে আর কিছু নেই তার তরে
তবুও সে কী কারণে- কার তরে- কেন এই মহনীয় ভাবে
দাঁড়ায়েছে- এ-রকম দাঁড়ালে দাঁড়াবে
গুড়ুনির গুণে- কাজে সব সময়ের ঘড়ি কেটে যাবে
লক্ষ প্রাণ বধ ক’রে হয়েছিল আত্তিলা অমর
একটিও পিপড়েকে দিয়ে গিয়েছিল পরিসর
পৃথিবীর অন্য ঢের সুসীম করুণা
গুণাগার দিয়ে তবু শোধ ক’রে দিতে হয় গুণা
আমি জানি- জেনেছিল আধো-অন্ধকার দরায়ুস
তবুও সকলই শূন্যে রঙিন ফানুস

এক অনন্তের মুখে যখন পুরুষ-নারী নির্বাণের মতো তবু
তবুও প্রতিটি পলে রয়ে গেছে অনন্ত সময়
পরিনির্বাণের শান্তি ব্যতিরেকে চারি-দিকে তথাপিও সব
শাশ্বত চিন্তার মতো যখন যে-সময়ে রক্তিম, নীরব
যখন হৃদয়ে মনে সে এ-রকম করে অনুভব
চেয়ে দেখি নারী, নর, সূর্য আর ভাঁড়
পৃথিবীর মৃত যুদ্ধ, মৃত তরবার
অবরুদ্ধ মৃত নগরীর জনগণ
অথবা নক্ষত্র ভ’রে ঘুরেছিল যাদের ডিমন
মনের গণিকালয়ে কেটেছিল যাদের জীবন
সকলেই নিজ-নিজ স্বতন্ত্র অগ্নির পথে ধীরে
আগুনের রকমারি ঢঙে ছাঁটা রসিক শরীরে
জানে না কোথাও আছে নিয়মের ব্যতিক্রম কী না
সর্বদাই মনে হয় উকিলের উদ্বাহ এ-বার সপি না
ছেঁকে ঝেড়ে দেবে ক্ষুর-ঘর্ষণের মতো অনলের গায়
আগুনের গিনিগুলো হয়তো তবুও তাকে টেনে নিয়ে গেছে দায়রায়।