অন্ধকার রজনীতে

যখন বাতাস আসে অন্ধকার রজনীতে
কোনও দূর আকাশের শূন্য হ’তে
‘নক্ষত্রলোকের থেকে এল যেন’ বলিতে পারি না আজ আর;-
পৃথিবীর কাছ থেকে অবসর কেড়ে নিয়ে- কোনও নাক্ষত্রিকে দৃষ্টি তুলে বহু ক্ষণ
আমাদের নাসিকার নিচে যাহা ঘটিতেছে সারা-দিন তার-ই দৌত্য নিয়ে
আজ ব্যস্ত আমরণ-
সমস্ত দুপুর ভ’রে গূঢ় রৌদ্রে স্ফিংক্স যেন চেয়ে থাকে
প্রতি মানুষের বিবর্ণ চুলের বিচ্ছৃঙ্খল কেশরের থেকে- মুখ থেকে

প্রতিটি ভ্রাতার- প্রতি ভগিনীর কম্পমান ঠোঁটের ভিতর থেকে
যেন এক পাখির শাবক দুরন্ত শিশুর হাতে ধরা প’ড়ে কাঁপিতেছে;
যদিও মাথার ‘পরে নীলাকাশ- দীপ্ত রৌদ্র চারি-দিকে।
এরা তবু সাটিনের নীল কোট গায়ে পরিচ্ছন্ন দর্শকের মতো
নিজেদের স্বাস্থ্য নিয়ে তৃপ্ত- রূপ নিয়ে-
রূঢ়তার সমবায় নিয়ে
(এই সব দেখি আজ এই পৃথিবীতে- মধ্যাহ্নের রৌদ্রে ভেসে থেকে-
এই সব বিবর্ণ রূপক ক্রীড়া করে
বিচ্ছিন্ন ডানার শেষ প্রয়াসের জোরে- মরণের হাতে ব’সে থেকে-
মরণকে ক্রীড়নক ভেবে
কেরোসিন-কুপি হাতে নিয়ে গোধূলির পবিত্র আরামশালা আবিষ্কার ক’রে- রোজ)

জীবনের ইন্দ্রজিৎ সেনাদের মতো হুল্লোড় করার দিন শেষ হয়ে গেছে
তুচ্ছ এক মক্ষিকার মতো- মানবের আত্মা পেয়ে
মননের সমাকীর্ণ তীরে-তীরে উড়ে ফিরি
হৃদয়ের কক্ষ থেকে যত বার মোম আর মধু ধূলায় লুটায়ে পড়ে- অন্ধকারে
তত বার আরও নগ্ন মানবক হয়ে।

গুদামের করুগেট টিনের গরম যেন বিসুবিয়সের অগ্নি উদ্গারিছে অন্তরিন
নগর- বন্দর- রীতি- ধর্ম- পুরোহিত
কামনা- বাসনা- পুঁজ- রক্ত;- মৃত্যু তবু- অন্ধ এক সম্রাটের মতো
বিকেলে উদ্যানে হেঁটে বায়ু পান করিতেছে
পরিপক্ক পার্শ্বচরদের কাঁধে জীবনের বোঝা রেখে- লঘু ক’রে;
বিষুবরেখা’র পথ ধ’রে তবু গোল হয়ে ফিরে আসে সব
লাঘব হয় না কিছু;

অতীতের মনীষার ব্যবহৃত নিরুত্তর সঙঘারাম ভেঙে ফেলে
মদ্য- ধূমা- লেমনেড- ফরসেপ- এঞ্জিনের নিচে
শববাহকের মতো অবিরল ছায়া চলিতেছে- চেয়ে দেখি-
সমস্ত রজনী ভ’রে চলিতেছে-
সমস্ত রজনী ভ’রে এইখানে কারু আঁখিতারকার অবসর নাই
চোখের খোঁড়লে শুধু ঊর্ণনাভ ঘুরিতেছে-
কে কারে দেখিবে- ধ্যানিবে এই সীমানায়?

কোনও উষা- হয়তো-বা তবু কোনও উষা উদ্গীরিত হবে ব’লে
এই প্রশ্ন ধ্যানের মতন হয়ে জেগে থাকে:
যখন অগুন্তি ক্যাম্প অনেক আড়ষ্ট জানু জড়ো ক’রে নরনারী শিশুদের
বিবর্ণ চাবির মতো তাহাদের ধীরে-ধীরে নৈসর্গিক অন্ধকারে হারাবার অবসর দেয়
যখন স্ট্রেচার অগণন, চলিতে-চলিতে থেমে রাজপথে প’ড়ে থাকে
মৃত্যু ছাড়া তাহাদের তুলে ধরিবার দায়িত্ব কাহারও নেই জেনে।
ক্রমে-ক্রমে আরণ্যক অন্ধকার আসে; মানবের লিপ্ত আত্মা
উড়ু-উড়ু উঁচু তরুদের শব্দ শোনে
দুলে-দুলে পৃথিবীর হৃৎপিণ্ডযন্ত্রের অবিরাম পৌরাণিক অবসর অনুভব করে।